আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমানুষ

অমানুষ জ্যোৎস্না এখনও জ্বলেনি কারাগারের গ্রিল ধরে তাকিয়ে আছি গাড়ির বিকট আওয়াজ যেন কর্ণকে বিকর্ণ করে দিচ্ছে মনে ভেসে উঠল বাবার স্বপ্ন ভরা চোখ নৌকার গলুই এ মাথা রেখে কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেল তা জানি না। মাছরাঙ্গার মতন তীক্ষ্ম চোখে শাপলা পাতার পোকাগুলি দেখি বাবা বলেছিল, 'দিপু, তুই বড় খারাপ হয়ে যাচ্ছিস। তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। ' দিদিমার কোলে মাথা রেখে গল্প শুনি সেই রাজকুমারির; বহু কাহিনীর সেই স্বপ্নপুরী গল্প শুনে শুনে চলে যাই অচিন পুরির রাজকুমারির বুকে ফিরে আসে না রাখাল ছেলেটি দিদিমার কথা ভারি হয়ে আসে বল না দিদিমা, তারপর? রাখাল ছেলেটা রাজ্য জয় করে কিন্তু? আর বলে না দিদিমা। আমি ঘুমে পড়ি স্বর্ণখাটখানা আলো করে ঘুমে আছে রাজকুমারি আমি নিস্পলক চেয়ে থাকি রাজকুমারির মুদিত আঁখির পানে যাদুর পাটিতে ভেসে যাই দেশ দেশান্তর রাজকুমারি আমার বুকে মাথা রেখে সোনার টিয়ার বাঁধন খুলে দেয়।

বলে, 'তুমি ছাড়া আমি সব মুক্তি দিতে পারি। অপেক্ষা করতে পারি কোটি কোটি জনম। ' ডাংগুলির স্বপ্ন মুদিত চোখে ভেসে ওঠে ননীর কুল বাগান হাজার যোজন গতিতে ছুটে চলি ঢিল ছুড়ি ঠিক মগডালে বৃষ্টির মতই ঝরে কঁচি কুল লম্বা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে ননী বাপ তুলে কতগুলি গাল ছাড়ে কাঁচা কুল চিবাতে চিবাতে কেতুকে বলি, কেমন হলোরে? কেতু তার কুলগুলি পকেটে রাখতে রাখতে বলে, দারুণ। তোর খুব তাক মা পিছনে লাঠি নিয়ে ছোটে পার হয়ে যাই রজনী দাসের পুকুর চণ্ডীতলীর শ্মশানঘাট জেলে পাড়ার ভাঙ্গা ব্রীজ জেলেদের ছেলেরা আমাকে দেখে হাসে আমি তবুও ছুটি মা আমাকে ধরতে পারে না মাতো বয়সের ভারে ক্লান্ত গাড়ি থেকে নামতে নামতে কাঁধের ঝুলানো ব্যাগটা সামনের দিকে ফিরে আসে। গড়িয়ে যাওয়া ঘাম স্তপ বাধে পীচ ঢালা রাস্তার উপরে।

সহজেই শুকিয়ে যায় ঘামগুলি। উঁচু ডিবিটায় বসে পড়ি। পত্রিকায় চোখ রাখতেই সামনে একটা নগ্ন হাত এসে পড়ে একটা পয়সা দেবে? একটা পয়সা, মাত্র একটা পয়সা তার দিকে তাকাতে তাকাতে পত্রিকার গন্ধটুকু বাতাসে মিলে যায় প্যান্টের পকেটে থেকে দুটো পয়সা টেনে নিই ওর ক্ষুধার্ত মুখে আলো ঝিলিক দেয় সরু পা দুটো দোলাতে দোলাতে ঢুকে যায় গলির মোরে তিনতলার জানালা দিয়ে নেমে আসে ছোট্ট শিশুর চিকন হাসি মা আদর করে বার বার ডাকে, খোকা, খোকা; কৈ গেলি? এদিকে আয় বাবা। শিশু মার দিকে চোখ রাখে না। তার চোখে মস্ত বড় পৃথিবীর আলো।

ওর চোখে নতুন আলোর আগুন। শক্ত হাতে ধরে জানালার গ্রীল। কলেজের গেটে মৌসুমী দাঁড়ানো তরুনীর বুকে যেন প্রথম অরুনোদয় দাঁতের উন্মুক্ত অংশ দিয়ে বেরিয়ে যায় শব্দটা ও আমার কান ধরে বলেছিল, শয়তান। ফের যদি বলিস তোর চোখে -- -- মৌসুমী আমার প্রিয় বান্ধবী ছিল। ওকে আজও ভুলিনি।

রীতাকে চিকন রাস্তার মোরে দেখেছিলাম। ও মুখটা বাঁকা করে বলেছিল, তুমি অমানুষ। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। আমাকে পাওয়ার মত কোন যোগ্যতাই তোমার নেই। ছিন্ন ভিন্ন হলো পৃথিবীর আদিম অবস্থানের কেঁপে উঠল মাথাটা।

ধুলিতে আমার চোখ অন্ধ। দুই হাতের শক্ত মুঠি চন্দ্র সূর্যকে ছিড়ে ফেলতে চাইল অবশেষে ঝড় থেমে গেল। কিন্তু চোখ দুটি আমার আজও পরিস্কার হলো না। অ-নে-ক দিন কেটে গেল মা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তুই একদিন নাম করবি। তোর নাম বড় বড় অক্ষরে লেখা হবে।

মার কথা মিথ্যে হয়ে গেল। বড় বড় অক্ষরে নামটা আমার উঠল না। মার চোখে এখন বিরহ আগুন ঝলসে গেছে বাবার স্বপ্ন চোখ দাদার হৃদয়ে নিভু নিভু অগ্নি গ্রেনেডের দাবানলে পুড়ে ছাই করেছি আমার হৃদয়ের শান্তি কিন্তু কেন? নদী ছুটে চলছে উদাসীন বনের ফেলা আসা আলিঙ্গনে আষাঢ়ের কান্নায় নিভে গেছে দিদিমার জ্বলন্ত কবর বনানীর বীণা ধ্বনী থেমে গেছে শহরের বুকে অপমৃত্যুর দাগ মানুষের চোখে এখন আমি অমানুষ। শুধুই অমানুষ অমানুষ পরিচয় আমার বাবা এখন আর স্বপ্ন দেখে না মার সোহাগ জড়ানো আবেগ এখন শুধুই হাহাকার ননীর লাঠি তেড়ে আসে না কোথায় হারিয়ে গেল সে দিনগুলি? আমার সে দিনগুলি যেন ঝড়ো বাতাসে ধুলি গগন স্পর্শ করে শীতল জলকণায় মিশে গেল ধরণীতে বেলকনির গল্পগুলো ভুলে গেল রীতা ওর চোখ এখন অন্যের স্বপ্নে বিভোর দিদিমার রাজকুমারী? সে এখন অন্য রাজরানী শোনার টিয়ার গল্প শোনে না আর আমার? আমার সামনে জেলখানার শক্ত গ্রীল, পিছনে ফাঁসির মঞ্চ, মধ্যে আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত আগুন উর্ধ্বে খোলা আকাশ-শুধুই রৌদ্রময়, শুধুই মেঘময়, শুধুই অনির্বাণ অগ্নিশিখা আর একবিংশ শতাব্দীর পাপিষ্ঠ পৃথিবী আমি অমানুষ। আমানুষ আমার পরিচয়।

শুধুই অমানুষ। ৪ আগস্ট ২০০৫ইং, ডায়না প্যালেস ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।