আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোবাইল বোমা: স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও শঙ্কায় আগামী প্রজন্ম : বিপরীত স্রুত।

ছাত্র পলিউশন বা দূষণ শব্দটি আজ আমাদের খুব পরিচিত। কারণ, বিভিন্ন প্রকার দূষণ আমাদের পরিবেশকে দিন দিন বিষাক্ত করে তুলছে। ফলে পৃথিবী নামের গ্রহটি ক্রমেই অনাবাসযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। দূষণের পরিচিত নামগুলো হলো বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, আলোকদূষণ ইত্যাদি। এখন এমন আরেকটি দূষণের কথা বলব যার নাম অনেকেই হয়তো শোনেননি, এটা গন্ধহীন, বর্ণহীন, শব্দহীন ও অদৃশ্য কিন্তু মানবদেহ ও জীবজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

এমনকি অন্যান্য সব দূষণের চেয়ে এটা অধিক ভয়ংকর। এই দূষণের নাম তড়িৎ দূষণ, ইংরেজিতে যাকে ইলেকট্রো পলিউশন বলে। এই দূষণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির তড়িৎ কৌশলসমূহ (যেমনÑমাইক্রোওয়েভ ওভেন, হেয়ার ড্রায়ার, টোস্টার ইত্যাদি) এবং কোটি কোটি ডলারের তারহীন (ওয়্যারলেস) যোগাযোগশিল্প (যেমনÑমোবাইল ফোন)। তারহীন মোবাইল ফোন প্রযুক্তির মহাবিস্ফোরণ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ উপহার দিচ্ছে। ফলে দুই দশক আগের তুলনায় মানবসমাজ আজ কোটি গুণ বেশি তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ দূষণে আক্রান্ত।

তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ দ্বারা ক্ষতির ব্যাপকতা এতই বিশাল যে মোবাইল শিল্প দ্বারা সৃষ্ট তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্র ও তড়িৎ দূষণ আজ সমার্থক হয়ে পড়ছে। তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: (ক) আয়নাইজিং (খ) নন-আয়নাইজিং। আয়নাইজিং বিকিরণের উদাহরণ হলো এক্স রশ্মি (১০১৬ -১০১৯/এস), গামা রশ্মি (১০২০ -১০২২/এস) ইত্যাদি। আয়নাইজিং বিকিরণ মানবদেহের ভেতর দিয়ে গমন করলে রক্ত কণাসহ দেহ কোষের অণুসমূহকে আয়নিত করে। কোষের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হয় ও কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয় এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যু বা পরবর্তীকালে লিউকেমিয়া ও ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি হয়।

আয়নাইজিং বিকিরণের ভয়াবহতা আমরা দেখতে পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আণবিক বোমা বিস্ফোরণে। সেদিন হিরোশিমায় বোমা পতনের স্থান থেকে এক কিলোমিটার দূরেও যারা বিকিরণে উন্মুক্ত ছিল, প্রত্যেকে তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করে এবং বিকিরণে এদের দেহ সিদ্ধ টমেটোর মতো গলগলে হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে যারা আয়নাইজিং বিকিরণে সরাসরি উন্মুক্ত ছিল না, এরা তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করেনি বটে কিন্তু তাদের অনেকেই বিকিরণের আঘাতে পরবর্তীকালে ক্যানসারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এখন দৃষ্টি ফেরাই নন-আয়নাইজিং বিকিরণের দিকে। অপেক্ষাকৃত কম শক্তিসম্পন্ন তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ, যা রক্তকণা বা দেহকোষের অণুকে ভাঙতে পারে না তাদেরকে নন-আয়নাইজিং বিকিরণ বলে।

যেমনÑমাইক্রোওয়েভ (১০৯ -১০১১/এস), রেডিও ওয়েভ (১০৫ -১০৬/ এস) ইত্যাদি। এই নন-আয়নাইজিং বিকিরণকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়, (ক) তাপ উৎপাদনকারী ও (খ) তাপ-অনুৎপাদনকারী বিকিরণ। প্রথম ও দ্বিতীয়টির উদাহরণ যথাক্রমে মাইক্রোওয়েভ ও রেডিও ওয়েভ। বেশি তীব্রতার মাইক্রোওয়েভ দ্বারা আমরা খাবার সিদ্ধ ও গরম করে থাকি, এটার কার্যকারিতা বাড়িতে বসে অথবা ফাস্ট ফুড- এর দোকানে গেলেই দেখতে পাবেন। কিন্তু কম তীব্রতার মাইক্রোওয়েভ বিকিরণে অনেকক্ষণ অবস্থান করলেও মানবদেহের নরম টিস্যুসমূহ সিদ্ধ হয়ে যেতে পারে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বিশেষ করে চোখ ও ব্রেইনের নরম টিস্যুসমূহ এই বিকিরণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অকালে দৃষ্টিশক্তি হারানো বা ব্রেইন ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হয়। তাপ অনুৎপাদকারী নন-আয়নাইজিং তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ, যেমন রেডিও তরঙ্গ, লিউকেমিয়া, ব্রেইন ক্যানসার, স্মৃতিশক্তির হ্রাস ও অন্যান্য মারাত্মক রোগের জন্য বহুলাংশে দায়ী, তা আজ সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত। এ প্রসঙ্গে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাশীল মেডিকেল জার্নাল আমেরিকান জার্নাল অফ এপিডেমিওলজি-তে প্রকাশিত কয়েকটি গবেষণার ফলাফল নিম্নে উল্লেখ করলাম। পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য যারা শক্তিশালী তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণে বেশিক্ষণ অবস্থান করছে, প্রথমে তাদের ওপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফল আলোচনা করি।

এসব পেশাজীবী লোক হলো পাওয়ার লাইনম্যান, টেলিফোন লাইনম্যান, ইলেকট্রিক রেলওয়ে অপারেটর, ইলেকট্রিশিয়ান, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি। বিভিন্ন গবেষকের দ্বারা পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে অবস্থানকারী লোকজন অন্য পেশাজীবীর তুলনায় ব্রেইন ক্যানসার, লিউকেমিয়া ও লিমফোবিয়ায় অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। লস-অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরস্কুল অফ পাবলিক হেলথ -এর গবেষক সুসান প্রেস্টন মার্টিন এবং তাদের সহকর্মীবৃন্দের দ্বারা শুধু ইলেট্রিকাল ওয়ার্কার-এর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, অন্যান্য পেশার লোকদের তুলনায় এই পেশায় নিয়োজিত লোকদের ব্রেইনে অ্যাস্ট্রোসাইটোমা নামের ম্যালিগন্যান্ট টিউমার দশ গুণ বেশি। অন্যদিকে ১৯৯৪ সালে মনট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ফ্রান্স ও কানাডার ২,২৩,০০০ জন ইলেকট্রিক ওয়ার্কারের ওপর গবেষণা করেন। এই গবেষণায় দেখা যায়, যারা অত্যধিক তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে অবস্থান করে, তাদের মধ্যে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার কম তড়িৎ ক্ষেত্রে অবস্থানকারীদের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি।

নর্থ ক্যারলাইনা ইউনিভার্সিটি-তে এর অপর একটি গবেষণা, আমেরিকার ৫টি বড় ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানিতে কর্মরত ১,৩৮,০০০ জন পুরুষের ওপর পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যায় তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে বেশি সময় অবস্থানকারী লোকদের মধ্যে ব্রেইন ক্যানসারে মারা যাওয়ার সংখ্যা কম তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে অবস্থানকারীর তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। উল্লেখ্য, ওপরের গবেষণা প্রবন্ধ দুটি আমেরিকান জার্নাল অফ এপিডেমিওলজি -এ প্রকাশিত হয়েছে এবং এই তথ্য আমেরিকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনে সংকলিত রয়েছে। এখন আসি শিশু, কিশোর ও তরুণ ছেলেমেয়েদের কথায়। কারণ এদের স্বাস্থ্যই তড়িৎ দূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

তাদের দেহ এখনো বর্ধনশীল এবং অধিক তরলে পূর্ণ। ফলে তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ খুব দ্রুত কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং কোষের মারাত্মক ক্ষতি করে। নিচের পরিসংখ্যান থেকে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ১৯৭৯ সালে আমেরিকান জার্নাল অফ এপিডেমিওলজি তে প্রকাশিত ড. ন্যানসি ভারথিমার-এর গবেষণা থেকে দেখা যায়, আমেরিকার ডেনভার ও কলোরাডো এলাকায় উচ্চ তড়িৎ প্রবাহ লাইনের কাছে অবস্থিত বাড়িসমূহে অবস্থানকারী শিশুদের মধ্যে লিউকেমিয়া ও ব্রেইন ক্যানসারের মাত্রা নিম্ন তড়িৎ প্রবাহ লাইনের পাশের বাড়িতে অবস্থানরত শিশুদের চেয়ে দুই গুণের বেশি। অন্যদিকে ৩৪৪ জন ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুর সঙ্গে প্রায় সমবয়সী কিন্তু তড়িৎ লাইনের কাছে বসবাস করছে না, এ রকম ৩৪৪ জন শিশুর তুলনা করে দেখেন যে পরবর্তী শিশুদের কোনো রকম ক্যানসার সৃষ্টি হয়নি।

আশির দশকের গোড়ার দিকে সুইডেনের স্টকহোমে এক গবেষণায় দেখা যায়, ৭১৬ জন সুইডিশ শিশু যারা ক্যানসারে মারা যায়, এদের মধ্যে ব্রেইন ক্যানসারের সংখ্যা ছিল সাধারণ শিশুর তুলনায় ৩.৮ গুণেরও বেশি। এই গবেষণা ড. লিনার্ট টমিনাস পরিচালনা করেন। স্টকহোমের কারোলিন্সকা ইন্সটিটিউট-এর ড. মারিয়া ফেচিটিং এবং তার সহকর্মীরা ১৯৯০ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করে দেখতে পান যে ২ মিলিগাউস চৌম্বক ক্ষেত্রের বেশি তীব্রতায় অবস্থিত শিশুদের মধ্যে লিউকেমিয়ায় আক্রান্তদের সংখ্যা অন্য শিশুদের তুলনায় তিন গুণের চেয়ে বেশি। যে সকল বাড়িতে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিমাণ তিন মিলিগাউসের বেশি, তাদের লিউকেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি চার গুণেরও বেশি। এ ছাড়া বৃটিশ জার্নাল অফ মেডিসিন, স্ক্যানডিনেভিয়ার জার্নাল অফ মেডিসিন এবং বায়োইলেকট্রোম্যাগনেটিকস জার্নালেও এ রকম আরও অনেক গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, যার ফল পজিটিভ।

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল ফোন ব্যবহারের আগে যেমন ১৯৭০ সালে ১০,০০০ শিশুর মধ্যে অটিজম-এ আক্রান্তের সংখ্যা পাওয়া যেত একজন। ২০০৩ সালে এর হার হয়েছে ১৬৬ জন শিশুর মধ্যে একজন। বর্তমানে, বিভিন্ন গবেষণায় অনেক বিজ্ঞানী ও ডাক্তার এই ইঙ্গিত পাচ্ছেন, তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণের আঘাতে শিশুদের দেহকোষ ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে এবং ফলে জেনেটিক উধসধমব সংঘটিত হচ্ছে, যা অটিজম থেকেও বেশি মারাত্মক। ওপরে বর্ণিত এতগুলো গবেষণালব্ধ ফলাফল জানার পর তড়িৎদূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। নন-আয়নাইজিং বিকিরণ কীভাবে মানবদেহের ক্ষতি সাধন করে, আশা করি নিচের কয়েকটি লাইন তা স্পষ্ট করে তুলবে।

মানবদেহের শত ট্রিলিয়ন কোষ নিম্ন শক্তির তড়িৎ-চৌম্বকীয় সংকেত ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। নিরবচ্ছিন্নভাবে বহিস্থ তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণে অবস্থান করলে, এই বিকিরণ ক্ষেত্র আন্তকোষীয় যোগাযোগ পথকে সাংঘাতিকভাবে বিকৃত করে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ফলে ভুল ও বিকৃত সংকেতের কারণে কোষের ভেতরে অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড শুরু হয় এবং কোষ পর্দা শক্ত হয়ে যায়। কোনো পুষ্টি কোষের ভেতরে ঢুকতে পারে না এবং বিষাক্ত দ্রব্য বের হতে পারে না। সময়ের ব্যবধানে কোষটি বিষাক্ত হয়ে যায়।

ফলে মুক্ত র্যাডিকেলের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, যা উঘঅ মেরামতকে বাধাগ্রস্ত করে এবং কোষীয় অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। ক্রমেই কোষ নিজের কর্মদক্ষতা হারায় ও অ্যাপোপ্টসিস পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। এই পর্যায়ে বাধাগ্রস্ত উঘঅ থেকে সৃষ্ট মাইক্রোনিউক্লি পুষ্টিসমৃদ্ধ আন্তকোষীয় তরলে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুক্তভাবে ক্লোনের সৃষ্টি করে ও দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এভাবে লিউকেমিয়া ও ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেয়। এ ছাড়া জেনেটিক পরিবর্তন, অল্প বয়সে বৃদ্ধ হওয়া, স্মরণশক্তি লোপ, অবসন্নতা ইত্যাদিতেও আক্রান্ত হয়।

তড়িৎ দূষণে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে নির্মিত স্বল্প উচ্চ বেইজ স্টেশন বা টাওয়ার অ্যান্টেনা থেকে নির্গত তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ। প্রথমে আসি মোবাইল ফোনসেটের কথায়। আমরা যখন মোবাইল ফোনে আলাপ করি, মোবাইল সেট তখন দুটি কাজ করে। অ্যান্টেনা থেকে প্রাপ্ত তথ্যসংবলিত বিকিরণ শোষণ করে এবং ব্যবহারকারীর কথা উচ্চক্ষমতার বিকিরণের মাধ্যমে প্রেরণ করে। এই প্রক্রিয়ার সময় ব্যবহারকারীর দেহের টিস্যুসমূহ তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

ফলে কোষ থেকে কোষে স্বাভাবিক যোগাযোগ পথ বিঘিœত হয়। বিশেষভাবে, কান ও ব্রেইনের কোমল টিস্যু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ব্রেইন টিউমার, ব্রেইন ক্যানসার, অটিজম ইত্যাদি মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টি হয়। ২০০৩ সালে অধ্যাপক কেইল মিলড (অরেব্রো ইউনিভার্সিটি, সুইডেন) এক গবেষণায় দেখান যে, দিনে গড়ে এক ঘণ্টা বা ততোধিক সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে ব্রেইন ক্যানসার বা টিউমার হওয়ার ঝুঁকি ৩০% বেড়ে যায়। অন্যদিকে কোনো শিশু মাত্র ২ মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বললে স্বাভাবিক ব্রেইন তরঙ্গ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়, যা পরবর্তী ১ ঘণ্টায়ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না।

তড়িৎদূষণের আরও মারাত্মক দিক হলো স্বল্প উচ্চ বেইজ স্টেশন বা টাওয়ার অ্যান্টেনা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্গত বিকিরণ। মোবাইল ফোন আমরা সারাক্ষণ ব্যবহার করি না। কম ব্যবহারে কম বিকিরণ আঘাত করবে। কিন্তু কোনো বেইজ স্টেশন বা টাওয়ার অ্যান্টেনা দিনে ২৪ ঘণ্টা তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ চারদিকে ছড়াতে থাকে। কাজেই যারা এই টাওয়ারের নিচে বা আশপাশে বসবাস করেন, এদের সবাই অর্থাৎ আবালবৃদ্ধবনিতা নিজের অজান্তে দিনের অধিকাংশ সময় উচ্চক্ষমতার বিকিরণে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন।

দীর্ঘ সময় এই বিকিরণে অবস্থান করায় আন্তকোষীয় যোগাযোগ সংকেত বিকৃত হবে। এতে মেটাবলিক কর্মকাণ্ডে গোলযোগ সৃষ্টি হয় এবং ক্যানসার, ব্রেইন টিউমার, অটিজম ও লিওকেমিয়া ইত্যাদি জীবননাশী মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষ প্রান্তে এক্স রশ্মি আবি®কৃত হয় এবং এ নিয়ে তখন অনেক গবেষণা চলে। এক্স রশ্মি কীভাবে দেহকোষ ভেঙে ক্যানসার সৃষ্টি করে তা তখন জানা ছিল না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কোষের সঙ্গে এক্স রশ্মি¥র মিথস্ক্রিয়া ধর্ম অজানা ছিল বলে কিন্তু তখন এক্স -রশ্মির মারাত্মক আঘাত থেকে কেউ রক্ষা পায়নি।

যারা প্রথম দিকে এক্স -রশ্মি নিয়ে কাজ করেন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তাদের সবাই একসময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অনেকেই লিউকেমিয়া ও ক্যানসারে মারা যান। এদের মধ্যে নোবেল বিজয়ী মাদাম কুরি একজন। তড়িৎ দূষণের ক্ষেত্রেও একই কথা আজ আরও বেশি প্রযোজ্য। কারণ এক্স -রশ্মির সঙ্গে জড়িত ছিল গুটি কতক লোক, আর তড়িৎ দূষণের শিকার হবে কোটি কোটি মানুষ। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের প্রত্যেকের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত।

কারণ, অদূর ভবিষ্যতে তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ ও দেহকোষের প্রকৃত মিথস্ক্রিয়ার প্রকৃতি অবশ্যই জানা যাবে। কিন্তু সতর্ক না হলে ইতোমধ্যে হয়তো অনেক শিশু, যুবক ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিউকেমিয়া ও ব্রেইন ক্যানসারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। এদের জন্য তখন কিছুই করার থাকবে না। এ ছাড়া বর্তমানে এমন কিছু অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, বেইজ অ্যান্টেনা থেকে নির্গত বিকিরণ মানবদেহের ক্ষতি সাধন ছাড়াও ফলফলাদি নষ্ট করে অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের ক্ষতি করছে। যেমন, যে বিল্ডিংয়ের ওপর অ্যান্টেনা স্থাপন করা হয়েছে, এর আশপাশের আম ও নারকেলগাছে ফল ধরার পরিমাণ কমে গেছে অথবা একেবারেই ধরছে না।

ফুল অবস্থায়ই ঝরে পড়ছে। কিন্তু অ্যান্টেনা স্থাপনের পূর্বে নিয়মিতভাবে আমগাছে আম ও নারকেলগাছে নারকেল ধরত। এ বিষয়টি অ্যান্টেনার কাছে বসবাসকারী লোকজন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন অথবা উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্রদের এটা নিয়ে গবেষণা করার অনেক সুযোগ রয়েছে। এখন আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। ষোলো কোটি মানুষের এই দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেশের অর্থনীতি অনুযায়ী যা হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি।

ফলে অপরিকল্পিতভাবে টাওয়ার অ্যান্টেনা বসানোর সংখ্যাও অধিক। দুঃখের বিষয়, অশিক্ষিত, শিক্ষিত এমনকি সরকারের উঁচু মহল পর্যন্ত তড়িৎ দূষণের ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা সম্পর্কে একেবারই উদাসীন। এ ব্যাপারে নেই কোনো চিন্তাভাবনা, নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি। আর এই সুযোগে মোবাইল ফোন কোম্পানিসমূহ বাড়ি, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে এবং যেখানে-সেখানে নির্বিচারে বেইজ স্টেশন বা টাওয়ার অ্যান্টেনা স্থাপন করে চলছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমার বাসার কাছে অবস্থিত উদয়ন স্কুলের কথা।

এর ছাদের দিকে তাকালে সহজেই চোখে পড়ে যে ছাদটি বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির অ্যান্টেনা দিয়ে পূর্ণ। প্রতিটি অ্যান্টেনা থেকে উচ্চক্ষমতার বিকিরণ প্রতিনিয়ত চারদিকে ছড়াচ্ছে। আর সম্মিলিত তড়িৎ ক্ষেত্রের মধ্যে কয়েক হাজার শিশু প্রতিদিন ৬-৭ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করছে। হয়তো ঢাকা শহরের অন্যান্য অনেক স্কুলের ছাদেও একই অবস্থা। ফলে এই শিশুরা শারীরিকভাবে কী রকম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কে জানে? যদি এই শিশুরা আজ থেকে ২০ বছর পর বিকিরণের আঘাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, কেউ লিউকেমিয়া, কেউ ব্রেইন ক্যানসার, কেউ স্মৃতিশক্তি হারিয়ে বা অন্যান্য মারাত্মক রোগে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়, তখন ভবিষ্যৎ নাগরিকদের এই পরিণতির জন্য কে দায়ী হবে? দায়ী যদি কাউকে করাও যায়, তবু কি আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে? সামান্য কিছু অর্থের লোভে আমরা আমাদের সন্তানদের কী সর্বনাশ করছি, একবার ভেবে দেখেছি কি? একই কথা প্রযোজ্য ওই সকল লোকের ক্ষেত্রে, যারা নিজেদের বাসার ছাদে সামান্য টাকার জন্য মোবাইলের বেইজ স্টেশন বসানোর অনুমতি দিয়েছেন।

যতটুকু জেনেছি ও দেখেছি, উন্নত দেশসমূহে লোকালয়ের মধ্যে বিশেষ করে বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনেক দূরে এবং অনেক উঁচুতে উচ্চ ক্ষমতার বেইজ স্টেশন স্থাপন করা হয়। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার ব্যাপারে আমি আরেকটি ঘটনা বলি। প্রায় চার বছর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় নতুন পদার্থবিজ্ঞান ভবনের ছাদে কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে একটি মোবাইল কোম্পানির বেইজ স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এর নিচে ও আশপাশে বিকিরণ ক্ষেত্রে শত শত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রতিনিয়ত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেওয়ার পূর্বে ওই এলাকার শিক্ষকদের (যারা প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা করে এখানে অবস্থান করেন) মতামত জানতেও চায়নি।

আমার জানামতে, তখন একজন শিক্ষক সম্ভাব্য দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা উল্লেখ করে টাওয়ারটি বন্ধের জন্য আবেদন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযোগটি খুব একটা পাত্তা দেননি। কী দুর্ভাগা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র ও শিক্ষকগণ। তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র কোন মাত্রা পর্যন্ত নিরাপদ, এটা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সরকার তার জনগণের নিরাপত্তার জন্য ডোজ লেভেল ঠিক করে দিয়েছে। অনেক সরকার ৬০ হার্টজ তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণের চৌম্বক ক্ষেত্রের কাট অফ সীমা থ্রি এমজি মিলি গাস নির্ধারণ করেছে। আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি প্রস্তাব করে ওয়ান এমজি ।

সুইডেন ০.২৫ এমজি । রাশিয়ার গবেষকদের মতে নিরাপদ সীমা ওয়ান এমজি। গাস মেটার-এর সাহায্যে চুম্বক ক্ষেত্র পরিমাপ করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন ১৯৯৬ সালে মোবাইল সেট থেকে নির্গত বিকিরণ মাত্রা নির্ধারণ করেন, যেকোনো ৩০ মিনিটে ৫৮০ মাইক্রো- ডাবলিউ/সে.মি২ , (কম্পাংক ৮৬৯ মেগাহার্টজ)। ১৯৯৮ সালে ইনটারন্যাশনাল কমিশন অন নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রটেকশন নির্ধারণ করে ৪৫০ মাইক্রো ওয়াট/ বর্গসেন্টিমিটার।

মানবদেহ কী হারে রেডিও কম্পাংক শক্তি শোষণ করে তার নিরাপদ মাত্রাকে স্পেসিফিক অ্যাজরপশন রেট বলা হয়। আমেরিকায় এটার পরিমাণ ১.৬ ওয়াট/ কেজি (এক গ্রাম টিস্যুর ওপর নেওয়া) এবং ইউরোপে ২ ওয়াট/কেজি (১০ গ্রাম টিস্যুর ওপর নেওয়া)। এই তড়িৎ-চৌম্বকীয় দূষণ থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য কোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে কি না আমার জানা নেই। না নিয়ে থাকলে এখনই এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশে বিকিরণের মাত্রা কী হওয়া উচিত, তা ঠিক করতে হবে।

বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্থাপিত টাওয়ার অ্যান্টেনাসমূহ যথাশিগগির অপসারণ করতে হবে। মোবাইল ফোনের টাওয়ার অ্যান্টেনা থেকে আশপাশে কী পরিমাণ তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য যুক্তরাজ্যের মতো মনিটরিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফ্রান্স হাইকোর্টের একটি রায় পড়ছি: French High Court ruling against Bouygues Telecom Company The Court Stated that Considering that, while the reality of the risk remains hypothetical, it becomes clear from reading the contributions and scientific publications produced in debate and the divergent legislative positions taken in various countries, that uncertainty over the harmless exposure to the wave emitted by relay antennas persistent and can be considered serious and reasonable. এরপর টেলিকম কোম্পানিকে লোকালয় থেকে টাওয়ার অ্যান্টেনা সরানোর নির্দেশ দেয়। ফ্রান্সের এক্সপার্টদের মতে, কোনো লোকালয় সীমানা থেকে ১০০ মিটারের কম দূরত্বে কোনো মোবাইল অ্যান্টেনা স্থাপন করা যাবে না। এখন আসি কী করে তড়িৎ দূষণ লাঘব করা যায় সেই প্রসঙ্গে।

মোবাইল ফোন কম ব্যবহার করুন, শুধু প্রয়োজনীয় কথা বলে ফোন রেখে দিন। অন অবস্থায় মোবাইল সেট দেহ থেকে দূরে রাখুন, ঘুমের সময় সেটটি মাথার সন্নিকটে না রেখে ৫-৬ ফুট দূরে রাখুন। সেটের সঙ্গে এয়ারফোন ব্যবহার ঝুঁকির মাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে বিরত রাখুন। মোবাইল ফোন অ্যান্টেনা লোকালয়, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি থেকে দূরে স্থাপন করুন।

নিজের এলাকায় তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের তীব্রতার মাত্রা নিরাপদ সীমার ভেতর রয়েছে কি না মনিটর করুন। বাংলাদেশ সরকারকে আমদানিকৃত সকল মোবাইল সেটের বিকিরণ মাত্রা যাচাই করে বাজারজাতের অনুমতি প্রদান করতে হবে। উল্লেখ্য, উন্নত দেশে বাজারজাতের পূর্বে প্রত্যেকটি সেটের বিকিরণ মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। বিকিরণ সীমার অতিরিক্ত বিকিরণকারী সেটসমূহ বাজারজাতের অনুমতি পায় না। পরিতাপের বিষয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে এই নজরদারি না থাকায় বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানি তাদের ক্ষতিকর সেটগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বাজারজাত করে থাকে।

এটা বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। পরিশেষে বলব, যোগাযোগের আধুনিক প্রযুক্তি আমরা অবশ্যই ব্যবহার করব কিন্তু তা কোটি জীবনের বিনিময়ে নয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের ও প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। তবে এ ব্যাপারে সাধারণ জনগণকে আরও অনেক সচেতন করে তুলতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে এখনই এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা অধ্যাপক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র: বিপরীত স্রুত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.