আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খোকা ফিরবে,ঘরে ফিরবে, কবে ফিরবে, নাকি ফিরবে না।

সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পারে দাড়িয়ে এক মধ্য বয়সী নারী এখনও রয়েছে হাত বাড়িয়ে খোকা ফিরবে,ঘরে ফিরবে, কবে ফিরবে, নাকি ফিরবে না। জনপ্রিয় এই বিখ্যাত গানটি আজও আমাদের চোখে জল এনে দেয়। স্বাধীনতার চারদশক পরও এই গানটি এখনো সমকালীন গান হিসাবে বিবেচিত হোক এটা কোন দেশ প্রেমিকের কাম্য নয়। তারপরেও কোন কোন জননীর বুক চিরে আজও এই গানের কথা গুলো বাস্তবতা নিয়ে কেঁদে উঠছে বারবার। কিন্তু কেন? এখনও পথ চেয়ে থাকেন স্বজনরা, কিন্তু তাদের খোঁজ নেই।

স্থান ও সময় পৃথক হলেও প্রত্যেকের ঘটনার বিবরণ একই। সাদা পোশাকধারীদের হাতে আটক, এরপর নিখোঁজ-গুম। ধরে নেয়ার সময় নিজেদের কখনও র‌্যাব, কখনও গোয়েন্দা পুলিশ আবার কখনও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সিভিল টিমের সদস্য পরিচয় দিলেও আটকের পর আর তাদের খোঁজ মেলে না। কোনো সংস্থা এর দায়দায়িত্ব স্বীকার করে না। কী অপরাধে আটক করা হলো এবং কেনই বা তাদের গুম করা হলো এর কোনো জবাব পাওয়া যায় না।

বর্তমানে দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর গুম-খুনের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগে যে বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটতো ইদানীং তা কমে গেলেও এটা তারই একটি পরিবর্তিত রূপ বলে ধারনা করা হচ্ছে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। সরকারি হিসাবেই ক্ষমতাসীন এ সরকারের ২ বছর ১১ মাসে খুন হয়েছে ১২ হাজার। থানা-পুলিশে রেকর্ডভুক্ত হয়নি এমন সামাজিক খুনের ঘটনা আরও কয়েক হাজার।

এমন পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন বললেন, সংবাদপত্র পড়ে জানতে পেরেছি গুপ্তহত্যা হচ্ছে। তবে সেটা গুপ্তহত্যা হোক আর অপহরণ হোক এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে কোন পরিসংখ্যান আছে কিনা জানতে চাইলে সাহারা খাতুন বলেন, আমরা পত্র-পত্রিকা থেকেই গুপ্তহত্যার কথা জানতে পেরেছি, এর বাইরে আরও কোন তথ্য থাকলে আপনারা জানাবেন। গুপ্তহত্যার বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কি উদ্যোগ নিয়েছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, লাশ পুলিশই উদ্ধার করছে, লাশ দেখামাত্র তারা উদ্ধার করছে। লাশ কি অন্য কেউ উদ্ধার করছে? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে অন্য প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ধলেশ্বরী নদী থেকে পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করেছে, হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তারাই তদন্ত চালাচ্ছে।

গুপ্তহত্যা নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন। বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে এই আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভাল বলেই বিদেশী পত্রপত্রিকায় উল্লেখ করা হচ্ছে। এদিকে বিজ্ঞজনেরা বলছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিরাজমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করায় খুনি-অপরাধীরা আস্কারা পেয়ে নতুন নতুন নৃশংস হত্যাকাণ্ড উৎসাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই দেশে গুমের ঘটনা আকস্মিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠন। শুক্রবার মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট দি এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজএপিয়ারেন্স’র বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনযাপনের স¤পূর্ণ অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারেরই।

জোটের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, মাত্র এক সপ্তাহে মুন্সীগঞ্জ থেকেই উদ্ধার হয়েছে ৮ জনের লাশ। বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারকে অবশ্যই নিখোঁজ নাগরিকদের উদ্ধারে কাজ করতে হবে। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত এবং গুম প্রতিরোধে যেসব মানবাধিকার সংগঠন কাজ করছে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, অনেক পরিবারই দাবি করছে, তাদের স্বজনদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছে এবং এরপর তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। গুমের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরের ৪০ বছর অনেক লোক গুম হচ্ছে।

সব সরকারের আমলেই চলছে গুম। ফিলিপাইনের কুয়েজন সিটির সদর দফতর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে জোটটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে, গুমের ঘটনার সামপ্রতিক সময়ে বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক। বাংলাদেশে বিদ্যমান মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা, দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির চর্চা ও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার চিত্র আবারো সামনে নিয়ে এসেছে এই পরিস্থিতি। এএফএডির সভাপতি মুগিয়াতো ও স¤পাদক আইলিন বাকালসো স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, গুম প্রতিরোধে প্রণীত ১৯৯২ সালের আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে তার আওতাভুক্ত হতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছি। গত কয়েকদিন আগে গুম হতে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ অনুমোদনের প্রচারাভিযান শীর্ষক এক সভা যৌথভাবে আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা অধিকার, সুইজারল্যান্ড দূতাবাস, মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিডম ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ) এবং এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স (এএফএডি)।

দিনব্যাপী এ সভার উদ্বোধন করেন হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইমান আলী। এতে বিচারপতি, পেশাজীবী, রাজনৈতিক, এমপি ও মানবাধিকার কর্মী ও গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এম ইমান আলী বলেন, বিচারবহির্ভূত প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অজ্ঞাত গুমকারীকে চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় আনাও রাষ্ট্রেরই কাজ। এ দায়িত্ব রাষ্ট্রকে অবশ্যই পালন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেন, একটি সভ্য সমাজে গুম কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। এ জন্য অপরাধী যেই হোক তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। উপরের নির্দেশের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত স¤পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, আমি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমার পত্রিকায় আমি সরকারের সমালোচনা করি।

এ কারণে ১৪ দিন আমাকে রিমান্ডে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, গুম-নির্যাতন প্রসঙ্গে আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিরও সমালোচনা করবো। কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় অপারেশন ক্লিন হার্ট চালিয়েছিল। সেখানেও অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপিই এ র‌্যাব তৈরি করেছিল।

প্রথম আলোর যুগ্ম স¤পাদক আবদুল কাইয়ুম বলেন, সকালে বাসা থেকে বের হয়ে বিকালে নিরাপদে ফেরার নিশ্চয়তা চাই। এটা খুবই সাধারণ একটা চাওয়া। তিনি বলেন, আইন প্রয়োগের দুর্বলতার কারণেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে একটা সমর্থন তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে হত্যা গুম কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ড. আরস হেরেন বলেন, এভাবে গুম হয়ে যাওয়ার বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সমাজে।

এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, গুম হওয়া থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ অনুমোদন করতে হবে বাইরের হস্তক্ষেপ রোধ করার জন্য। কারণ, আমেরিকা বা অন্যান্য দেশে যারা নিজেরাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তারাই কোন দেশকে মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অপরাধকারী আখ্যা দিয়ে থাকে- যা ইরাক ও আফগানিস্তানে করা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, এখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমার দলও অভিযুক্ত হয়েছে।

তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি আমাদের সময়ে রাজনৈতিক কারণে কেউ গুম খুনের শিকার হয়নি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে গুম করে ফেলা হয়েছে। সরকারের কোন জবাব নেই। এভাবে গুম কিংবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা কোন গণতান্ত্রিক দেশের চলতে পারে না। বিবিসির সংবাদে বলাহয়েছে ২৮ ঘণ্টায় বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির যশোর জেলার একজন নেতা নাজমুল ইসলামসহ মোট চার ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‌্যাব বলছে, গত নয় দিনে মোট আটটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন এবং মৃতদের পরিবারের অনেকের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে। এসব হত্যার পেছনে তাদের হাত থাকতে পারে বলে তারা বলছেন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান অপহরণের পর গুম ও হত্যার এই ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নতুন কৌশল বলে সন্দেহ করছেন। ঘটনার পর মৃত ব্যক্তির পরিবারের সাথে কথা বলে তারা এধরনের অভিযোগ পেয়েছেন।

গত ২৮শে নভেম্বর ছাত্রদলের আরও দুজন নেতার অপহরণের অভিযোগ ওঠে। এর ক'দিন পর তাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। মানবাধিকার সংগঠন "অধিকার" বলছে, চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত এ ধরনের হত্যা ঘটেছে ২২টি। গত বছর এসংখ্যা ছিল ১৮টি। ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই এধরনের ঘটনা বেড়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি করছে।

পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‌্যাব-এর পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, অপরাধী চক্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ব্যবহার করে এধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। র‌্যাবের কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, মৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর দোষ চাপানোর বিষয়টি সঠিক নয়। তিনি জানান এসব হত্যাকান্ড কারা ঘটাচ্ছেন, তা তদন্ত করতে র‌্যাবের একটি বিশেষ দল ইতিমধ্যেই মাঠে নেমেছে। বর্তমানে দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর গুম-খুনের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ স¤পর্কে একটি নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে।

এর পরিণতি হচ্ছে আফগানিস্তান, ইরাকের ভাগ্যবরণ করা। ফলে সরকারকে এখনই সতর্ক হতে হবে। সরকারকে স্মরণ থাকা উচিৎ যে, অপরাধী যে-ই হোক, ভুক্তভোগীরা সুবিচার পাচ্ছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।