আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিবাদন বাংলাদেশ

চল্লিশ বছরের একটা মাহাত্ম্য আছে। পশ্চিমে বলা হয়, লাইফ বিগিন্স আফটার ফোরটি। হযরত মুহাম্মদ নবুয়ত পেয়েছিলেন চল্লিশেই। একটা রাষ্ট্রের জন্য চল্লিশ বছর কম সময় নয়। কী পেয়েছি আর কী পেতে পারতাম আমরা, এটা বিবেচনা করা উচিত।

কেননা এতে করে ভবিষ্যতের পথ চলা সহজতর হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এখনও আমরা আমাদের রাষ্ট্রের একটা সর্বজনস্বীকৃত চরিত্র কল্পনা করে উঠতে পারিনি। বর্তমানে আমরা যে রাষ্ট্রে বসবাস করছি, সেই রাষ্ট্রের সংবিধান আমাদের একই সাথে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে বলছে আবার নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দাবী করছে! যে রক্তাক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের জন্ম, সেই যুদ্ধের ইতিহাস মোটামুটি পাঁচ বছর পর পর পরিবর্তিত হচ্ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা আমাদের মধ্যে নেই, তাই আমরা মৃতদের নিয়ে টানাটানিতে ব্যাস্ত। কবরেও আমরা তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছি না।

ভিন্নমতাবলম্বীদের আমরা স্বাধীনতা বিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে মনে করি। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো বাদ দিলে আমরা অধিকাংশই বাঙালি, বাংলায় কথা বলি। আমাদের কারো কারো পূর্বপুরুষ বাঘের পিঠে করে ইরাক থেকে এসে থাকতে পারেন, কিন্তু আমরা অধিকাংশই এই মাটিরই সন্তান। আমাদের অধিকাংশই নিম্নবর্ণের হিন্দু ছিলাম।

অর্থনৈতিক কারনে আমরা একদা ধর্ম পরিবর্তন করে বৌদ্ধ এবং পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি। আমরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখায়। পরবর্তীকালে আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হলে আমরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে নিজেদের সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করি। এই রাষ্ট্র ভিতর থেকে কোন চ্যালেন্জের মুখে নেই।

অনেকদিন আগেই আমাদের 'রোয়ারিঙ টাইগার' হবার কথা ছিল। কিন্তু এখনও আমরা 'এমারজিং টাইগার' হয়ে আছি। এদিকে আমাদের নেতৃত্বে আশু কোন সুখবর নেই। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিবিমুখ, মেধাবীরা সুযোগ পেলেই বিদেশ পাড়ি জমাতে চায়। পুরনোদের জবরদস্তির মাধ্যমে রাজনীতি থেকে হটানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটা সফল হয়ে ওঠেনি।

আর এটাই আমাদের একমাত্র ভরসার জায়গা। আমাদের সাধারণ জনগণ রাজনীতি সচেতন এবং তারা গনতন্ত্রকামী। এই সাধারণ জনতাই একটা ভাষাভিত্তিক জাতি গঠন করেছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ধারনা আমরাই পৃথিবীতে প্রথম দেখিয়েছি। দক্ষিণ এশিয়াতে শুধুমাত্র আমরাই একটা রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের ভূখন্ড পেয়েছি।

আমাদের স্বাধীনতা কোন মধ্যরাতের চুক্তির বিনিময়ে আসেনি। নিজের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব ও সম্মান নিয়ে টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা। আর এই টিকে থাকার পথে আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা সম্ভবত আমাদের জনসংখ্যা। সীমিত ভূমিতে আমাদের জনসংখ্যা অসীম হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কল-কারখানার সংখ্যা কম, কিন্তু মানুষ বানানোর কল অনেক।

সীমিত সম্পদ নিয়ে আমাদের পক্ষে এই সংখ্যক জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব নয়। আমাদের সম্পদ তাই ব্যয় করতে হবে আমাদের সংখ্যা সীমিত রাখার পেছনে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ঝুঁকির তালিকায় উপরের দিকে থাকা একটি দেশ বাংলাদেশ। একদিকে আমরা ক্রমেই সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার শঙ্কায় আছি আবার অন্যদিকে আমাদের মিঠা পানির উৎস নদীগুলোর প্রবেশ পথে ইন্ডিয়ার দেওয়া ব্যারেজ-ড্যাম আমাদের একই সাথে মরুকরণের ঝুঁকিতে ফেলছে। ইন্ডিয়ার সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন থাকবে, আমরা কী দেব আর কী নেব- এর সাথে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন সরাসরি জড়িত।

আমাদের আফসোস এই যে, ইন্দো-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখনো একটা প্রহেলিকা হয়ে আছে। যাদের উপর পথনির্দেশের দায়িত্ব, সেই বুদ্ধিজীবিরা দ্বিধাবিভক্ত। বাংলাদেশের অভ্যূদয়কে তারা দ্বি-জাতি তত্ত্বের পতন হিশেবে দেখে ইন্ডিয়ার প্রতি একটা সম্ভ্রমের দৃষ্টি দেন, আর এর সাথে যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা পাওয়ার কারনে সৃষ্ট কৃতজ্ঞতা। ফলে ইন্দো-বাংলাদেশ সংলাপে ইন্ডিয়া সবসময়ই এগিয়ে থেকে শুরু করে। একপক্ষ আছেন যারা সব জায়গাতেই ইন্ডিয়ান জুজু দেখেন।

আর একপক্ষ নিজেদের ন্যায্য অধিকারটুকু স্পষ্ট করতে পারেন না, পাছে সেটা ভারত তথা 'স্বাধীনতা বিরোধী' হয়। এজন্যই আহমদ ছফার মতো কেউ কেউ আমাদের আলোকস্তম্ভ হয়ে থাকেন। ছফার মত ছিল, বাংলাদেশের অভ্যূদয় দ্বি-জাতি তত্ত্বকে নাকচ করে না বরং ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট যে আসলে বহুজাতির বসবাসের স্থল, তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বাংলাদেশের অগ্রগতি ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের জাতিগুলোর মাঝে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তুলবে। ইন্ডিয়ার শাসককূল তাই এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখতে চাইবেই।

ভরসা এই যে, তরুণ প্রজন্মের কাছে ছফা ক্রমেই আদরণীয় হচ্ছেন। এই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে বর্তমানের হতাশা থাকবে না। তবে সেটা কাউকে জবরদস্তি করে রাজনীতি থেকে বহিষ্কার করে নয়, সময়ের প্রয়োজনে। আগামী চল্লিশ বছর পর আমরা অশীতিপর বৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখবো না, দেখবো স্বাস্থ্যবান আলোকজ্জ্বল এক স্বদেশভূমি। চল্লিশ বছর পূর্তিতে তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ।

সিরাজগঞ্জ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।