আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিবাদন বার্সেলোনাকে!!!!!!

সাধারণ মানুষ ২০১১ এর ইংরেজি বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উপভোগ করার পর ইতালি থেকে সুইডেন ফিরছিলাম। জানুয়ারির কনকনে শীতের মধ্যরাতে স্কাভস্তা বিমানবন্দরে এক স্প্যানিশ যুবকের সাথে পরিচয়। যেহেতু কয়েক মাস আগে ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে, তাই আলাপচারিতার বিরাট একটা অংশ জুড়ে থাকল স্প্যানিশ ফুটবলের উত্থান কাহিনি। আর যখন জানলাম সে বার্সেলোনার বাসিন্দা, আর যেহেতু আমি নিজেও বার্সার ফুটবল ভক্ত, তাই বার্সেলোনা দল নিয়েই চলল কথোপকথন। বার্সেলোনা ক্লাব সম্পর্কে আগেও পত্রিকার বিভিন্ন লেখায় পড়েছি, আর সেই দিন বার্সার স্থানীয় বাসিন্দার কাছ থেকে যে জিনসটা নতুন জানলাম তা শুনে আমি বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে গেলাম।

এত বড় একটা পৃথিবী বিখ্যাত ক্লাব এটা, অথচ এখানে নাকি কোন তারকা খেলোয়াড় নেই। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাইনা? মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা এরা নাকি তারকা না। তাহলে এরা কি? সারা পৃথিবী মেসি-মেসি রব তুলছে, আর সে বলছে মেসি খুব বেশী কিছু না। তার পরের কথাতেই সে খোলাসা করল ব্যাপারটা। তাদের কাছে একমাত্র তারকা হচ্ছে ক্লাব নিজেই।

'বার্সেলোনা' নিজেই সেই জ্বলজ্বলে তারকা। কোন ব্যক্তি ক্লাবের চেয়ে বড় হতে পারে না, এটাই বার্সেলোনার লোকদের ফুটবল দর্শন। শিশু থেকে শুরু করে অনূর্ধ্ব ২৩ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে পর্যায়ে ক্লাবটি সন্নিবেশিত। প্রতিটি খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সকল কর্মচারীর দেখভাল এর দায়িত্ব এই ক্লাবের। কোন খেলোয়াড় অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে আমাদের মত রাজনীতি না করে (যেমনটা মাশরাফির বেলায় হয়েছে) তাকে যত্ন এবং সুচিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলা হয়।

আজকের পৃথিবী বিখ্যাত মেসি ছোটবেলায় পায়ের দুরারোগ্য রোগে ভুগছিলেন, বার্সেলোনা ক্লাবের নিজস্ব খরচে তাকে চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তুলে তাকে আজকের মেসি হতে সাহায্য করেছে- একথা তো সর্বজনবিদিত। এরিক আবিদালের কথাই ধরুন। ১৯ মার্চ ২০১১, একদিকে যখন তার ক্যান্সারের সার্জারি চলছিল, অন্যদিকে চলছিল বার্সেলোনা গেটাফে ম্যাচ। তার প্রতি শুভ কামনা জানিয়ে বার্সার সমর্থকেরা সেই ম্যাচের শুরুতে টানা ২২ মিনিট করতালি দিয়েছিল (বার্সাতে আবিদালের জার্সি নং ২২)। এখানে ক্লাবের জন্য সবাই নিবেদিতপ্রাণ।

মেসি নিয়ে সারা পৃথিবী যতই মাতামাতি করুক না কেন, বার্সেলোনাতে কিন্তু ক্লাবই সবার উপরে, মেসি সেই ক্লাবের একটি অংশ মাত্র। তাদের কথা, মেসিকে আমরা অনেক ভালবাসি, কিন্তু সবার উপরে ক্লাব। আর যারা এই ক্লাবে খেলতে আসে তাদেরকেও সবার প্রথমে এটাই শেখানো হয়, তুমি নিজে যত ভাল খেলোয়াড়ই হউনা কেন খেলার মাঠে এবং বাইরে দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, দলের কল্যাণের জন্য তোমাকে তারকাখ্যাতি ছাড় দেয়া শিখতে হবে। সময়ের অন্যতম সাড়া জাগানো ফুটবলার, সুইডেনের সবচেয়ে বড় ফুটবল তারকা জাতান ইব্রাহিমোভিচ কে বার্সেলোনা ছাড়তে হয় নিজের তারকা ইমেজের অপব্যবহার করে কোচের সাথে বিতণ্ডায় যাওয়ায়। কি, বার্সা কোচকে স্বৈরাচারী বলে মনে হচ্ছে? ভুলেও একথা ভাববেননা।

তিন বছরের মধ্যে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা, এমন সাফল্যবিধৌত একটা সময় পার করার পরও বার্সা কোচ পেপ গার্দিওলা নিজে কৃতিত্ব না নিয়ে এই অর্জনের পুরো কৃতিত্বই দিয়েছেন শিষ্য এবং ক্লাবের সাথে সম্পর্কিত সবাইকে। সদ্যই চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর বললেন- ‘নিজেকে আমি এই খেলোয়াড়দের বস হিসেবে মনেই করি না। কত মানুষ আজকের এই অর্জনের পেছনে শ্রম দিয়েছে। আমি তাদের প্রত্যেককেই অভিনন্দন জানাই। ’ সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞাসা করল- এই দলটা সর্বকালের সেরাদের কাতারে যেতে পারে কি না—তখনও বিনীত গার্দিওলা, ‘আমি জানি না।

আমি তো আর ক্রুইফের আয়াক্সের খেলা দেখিনি। দেখিনি ডি স্টেফানোদের রিয়াল কিংবা পেলের সান্তোসের খেলাও। তবে হ্যাঁ, দশ কিংবা ১৫ বছর মানুষ যদি আমাদের খেলাটা মনে রাখে, সেটাই হবে অনেক বড় তৃপ্তির। ’ চ্যাম্পিয়ন্স-লিগের ফাইনালে (২৮ মে ২০১১) পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানেও দেখা গেল বার্সার মহত্তের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ফাইনালের পুরস্কার নিতে সাধারনত সবার শেষে অধিনায়ক প্রবেশ করেন, গলায় মেডেল পরে হাতে তুলে নেন ট্রফি।

কিন্তু নিয়মিত অধিনায়ক কার্লোস পুয়োল না এসে সবার শেষে এলেন এরিক আবিদাল। আরও বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কৃত হলো তাঁর বাহুতে অধিনায়কের বন্ধনী! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সারা বছর দলটির অধিনায়কত্ব করার পর পুয়োল নিজে অধিনায়ক হিসেবে ট্রফি হাতে না নিয়ে সেই গর্বিত মুহূর্তটা উপহার দিলেন আবিদালকে। কিন্তু কেন? যে আবিদাল ক্যানসারকে হারিয়ে আবারও ফিরেছেন ফুটবল মাঠে, তাকে সম্মান জানাতে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতাকে টেমস নদীতে ভাসিয়ে দিলেন পুয়োল। ফরাসি ডিফেন্ডার শুধু ট্রফি উঁচিয়ে শুধু বার্সার শ্রেষ্ঠত্বই ঘোষণা করলেন না; একই সঙ্গে গাইলেন সেই জয়গানও—‘বার্সেলোনা, মোর দ্যান আ ক্লাব। ’ গত ২ দশকের বিখ্যাত ফুটবলারগন, যারা ধারাভাষ্যে ছিলেন তারাও এই সৌহার্দ্যে মন্ত্রমুগ্ধ।

চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ম্যানইউকে ৩-১ গোলেই শুধু হারায়নি; বার্সেলোনা জিতে নিয়েছে এই পেশাদারি খেলার যুগে মানবিকতার শিরোপাও। খেলার ৯০ মিনিটে মাঠে তারা পুরো বিশ্বকে দেখিয়েছে, ফুটবলটা কিভাবে খেলতে হয়। এরপর যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মাঠের বাইরেও কতটা মানবিক হতে হয়। জয় হোক সুন্দর ফুটবলের। ফুটবলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা বার্সেলোনার এই মানসিকতাকে অভিবাদন জানাই!!!!! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।