আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"উইলিয়াম এএস ঔডারল্যান্ড" ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহকারী বিদেশী এক মহানায়ক !!

আমি আগা গোড়ায় মোড়ানো পুরোপুরি একজন মুক্তমনা মানুষ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সব ভিনদেশী মহা মানব-মানবীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন তাদের মাজে অন্যতম একজনের নাম হলো উইলিয়াম এএস ঔডারল্যান্ড। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা এই মহান মানুষটি তার এই সাহসীকতা আর বাংলাদেশকে ভালোবাসার অবধা্নের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীর প্রতীক প্রদান করেছেন। তিনি এই খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশী। দেশের মুক্তিযুদ্ধাদের পাশাপাশি এই মহান মানুষটিকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া আমাদের দায়িত্ব।

আমাদের দায়িত্ব হলো অনেক কিছুই করা যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যায়। অদ্ভুত হলেও সত্যি আমি নিজেই এই মহা নায়কের নাম জেনেছি মাত্র কয়েক বছর আগে। কিন্তু এই সব ভিন দেশী মহানায়কদের পরিচিতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দরকার ছিলো আরো অনেক অনেক আগেই। কিন্তু তা হয়নি। আমি আজো নিশ্চিত আমি যেমন এক সময় এইসব বিদেশী মানব- মানবীদের নাম জানতাম না প্রচারের অভাবে সেইরকম এখনো আমাদের অনেক নতুন প্রজন্মও তাদের নাম বা অবধান এর কথা জানে না।

অবধানকে যোগ্য সন্মান করার মানসিকতা মহান জাতিতে পরিনত করে। এতে লজ্জার কিংবা সংকীর্ণতার কিছু নেই। আজ আমরা এমনি এক মহা নায়ক উইলিয়াম এএস ঔডারল্যান্ড এর কথা বলবো। উইলিয়াম এএস ঔডারল্যান্ড উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারলান্ড (ওলন্দাজ ভাষায়: Wiliam Ouderland) (৬ই ডিসেম্বর, ১৯১৭—১৮ই মে, ২০০১) ছিলেন একজন ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসার। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতক্ষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীর প্রতীক প্রদান করে। তিনি এই খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশী। ঔডারল্যাণ্ডের জন্ম হল্যাণ্ড এর আমস্টারডামে ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর। ১৭ বছর বয়সে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে জীবিকার জন্য সু-শাইনারের কাজ নিতে হয়[২] এবং পরে তিনি বাটা সু কোম্পানিতে যোগ দেন। ১৯৩৬ সালে ঔডারল্যাণ্ড জার্মান কর্তৃক নেদারল্যাণ্ডস দখলের আগে ডাচ ন্যাশনাল সার্ভিসে নাম লেখান।

পরবর্তীতে তিনি রয়্যাল সিগনাল কর্পসের সার্জেণ্ট নিযুক্ত হন এবং তার দলে ৩৬ জন সদস্য ছিলেন। জার্মানীর নেদারল্যাণ্ডস, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম দখল করার ফলশ্রুতিতে ঔডারল্যাণ্ডকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন এবং জার্মানী থেকে ফেরত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেবার কাজে নিযু্ক্ত হন। ঔডারল্যাণ্ড জার্মান ও ডাচ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ডাচ আণ্ডারগ্রাউণ্ড রেজিসট্যান্স মুভমেণ্টের হয়ে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ এর প্রথম দিকে ঔডারল্যান্ড ঢাকার অদূরে টঙ্গীস্থ বাটা সু কোম্পানী(পাকিস্তান)লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপে যোগ দেন।

২৫ মার্চ এর অপারেশন সার্চলাইট এবং এর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে মর্মাহত হন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের ছবি তুলতে থাকেন এবং সেগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতে থাকেন। বাটা সু কোম্পানীর মত বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা (CEO) হওয়াতে তার পূর্ব পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। এই সুবিধার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করার এবং বাংলাদেশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার। তিনি প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে,কর্নেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে তোলেন।

সেই সুবাদে শুরু হয় তার ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে। এর এক পর্যায়ে লে,জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে,জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী,এডভাইজার সিভিল এফেয়ার্স মে,জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তার হৃদ্যতা গরে ওঠে। নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাকে 'সম্মানিত অতিথি' হিসাবে সম্মানিত করে। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের 'নিরাপত্তা ছাড়পত্র' সংগ্রহ ক্রে নেন।

এতে করে সেনানিবাসে যখন তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোন অসুবিধা থাকল না। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানীদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এসকল সংগৃহিত সংবাদ তিনি গোপনে প্রেরন করতেন ২নং সেক্টর এর ক্যপ্টেন এ,টি,এম হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার লে,জেনারেল জিয়াউর রহমান এর কাছে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি টঙ্গীস্থ বাটা সু ফ্যাক্টরীর ভেতরেই তিনি গণযোদ্ধাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষন দিতে শুরু করেন। কমান্ডো হিসাবে ঔডারল্যান্ড ছিলেন অস্ত্র,গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ।

এক পর্যায়ে তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি বাঙ্গালী যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেল লাইন ব্রীজ,কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায় যে, ঔডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন,পরামর্শ,নগদ অর্থ,চিকিৎসা সামগ্রী,গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ন কর্মকান্ড ও সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে।

স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তার নাল ২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর তালিকায় ৩১৭। ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরন অনুষ্ঠানে ঔডারল্যান্ডকে আমন্ত্রন জানানো হয়। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। তিনি বীর প্রতীক পদকের সম্মানী ১০০০০ টাকা মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্টে দান করে দেন। ঔডারল্যাণ্ড বাংলাদেশের বাটা স্যু কোম্পানি থেকে ১৯৭৮ সালে অবসর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ফেরত যান।

২০০১ সালের ১৮ মে তিনি নর্দার্ন অস্ট্রেলিয়ার পার্থের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা সভ্য এবং নিঃস্বার্থপর জাতি হিসেবে নিজেদেরকে বিশ্বের কাছে অনেক উপরে তুলে ধরতে পারি। আর এজন্য প্রয়োজন হবে দেশের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি সেই সব মমতাময়ী মহান বিদেশী মহানায়কদের যথাযথ সন্মান জানাতে পারি। এই স্বাধীন বাংলাদেশের পেছনে যাদের অবধান ছিলো অপরিশীম। আসুন আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এই সব বিদেশী মহানায়কদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

আর এজন্য সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। পাঠ্য পুস্তকে এদের অবধানের কথা অন্তুর্ভুক্তির মাধ্যমে। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.