আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ অন্তর্দহন

কল্পনার তুলির আঁচড়ে মনের ক্যানভাসে আঁকা ছবিগুলো দিয়ে জীবন রাঙ্গানোর অপচেষ্টা মাত্র পড়ন্ত বিকেল। হোটেলে দু’একজন কাস্টমারের আসা যাওয়া শুরু হয়েছে। একটি মেয়ে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল। বয়স ১৮-২০ এর মাঝেই হবে। সস্তা লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট দুটি রাঙ্গানো।

চোখে কাজল। পাউডারের ব্যবহারটা মাত্রাতিরিক্ত। চুলে তেল দেয়া। অবাধ্য চুলগুলো লাল ফিতা দিয়ে কষে পিছনে বাঁধা। পোশাক অসংলগ্ন।

সে হোটেলে ঢুকতেই পারফিউমের তীব্র গন্ধটা সকলের নাকে এসে লাগল। দেখে মনে হল এখানে তার যাতায়াত নিয়মিত। কোন কথা না বলে এক কোণে একটি ফাঁকা বেঞ্চে বসে পড়ল। কাস্টমাররা আড়চোখে তাকাতে লাগল। এখানে যারা আসে তারা বেশিরভাগই খেটে খাওয়া মানুষ।

তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হল। আলোচনার মধ্যমণি হয়ে উঠল মেয়েটি। কণ্ঠস্বর খাদে নেমে এল তাদের। একটি শুকনো কাপড় নিয়ে টেবিলটা মুছে দিল মিজান। যদিও টেবিলটা পরিষ্কারই ছিল।

যে কোন কাস্টমার এলেই এই কাজটা করে সে। তবে এখানে অভ্যাসের পাশাপাশি মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। মেয়েটি পাত্তা দিল না। মিজানের কাঁধ পেরিয়ে তার দৃষ্টি রাস্তার দিকে। অথচ তাদের অনেক দিনের পরিচয়।

ইতিমধ্যে পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও সৃষ্টি হয়েছে। যে যাই বলুক বেশি কিছু বুঝতে চায় না মিজান। তার চোখে মেয়েটি সুন্দরী। পোশাক, ঢালু কাঁধের মসৃণতা, চিবুক সব কিছুই ভাল লাগে তার। দেখলেই বুক ধুকধুক করতে থাকে।

ধুকধুকানির শব্দে মাঝে মাঝে কন্ঠ থেকে কোন কথা বের হয় না। তবে এটা ভাল চোখে দেখে না মালিক। একদিন তাকে ডাকল। - দেখ মিজান, আমি তো তোর বাবার মতই তাই না? আমি তোকে মহব্বত করি বলেই কথাটা বলছি। এই মেয়েটিকে তুই ভুলে যা।

চরিত্র ভাল না। বাজারে মেয়েছেলে। এর চেয়ে কত ভাল ঘরের মেয়ে পাবি তুই। প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে মালিকের দিকে তাকালো মিজান। চোখে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খেলা করতে লাগল।

ভয় পেয়ে গেল মালিক, আজগর। -এই বিষয় ছাড়া অন্য কিছু থাকলে বলেন। না পোষালে বলেন কাজ ছেড়ে দিব। আর কিছু বলল না আজগর। কাজে মন দিতে বলল।

এই বাজারে মিজানের মত কর্মী পাওয়া দুষ্কর। মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো মিজান। -তোকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। -ফাজলামো রাখ। এসব বলে কোন লাভ হবে না।

রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটি। মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। সেই বিষণ্ণতার মাঝে কেমন যেন একটা অমার্জিত ক্লান্তির ছোঁয়া। অন্য এক কাস্টমারের ডাকে সাড়া দিতে ফ্রিজের দিকে গেল মিজান। মেয়েটি দু’তিন মিনিট অনিমেষ চোখে মিজানকে খুঁটিয়ে দেখল।

তারপর দেয়ালে টাঙ্গানো পুরনো আমলের ঘড়িটার দিকে তাকালো। জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশটাও একবার চোখ বুলিয়ে নিল। পাখির ডানায় ভর করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দিনের আলো পরিপূর্ণ নিভে এলেই সে বের হবে। দিনের আলোর সাথে কোন সম্পর্ক নেই তার।

রক্তচোষাদের(ভ্যাম্পায়ার) মতই নিশুতি রাতের সাথেই তার আলিঙ্গন, সব বোঝাপড়া । মেয়েটির সাথে কথা বলার পাশাপাশি সে অন্য কাস্টমারদের খাবারও পরিবেশন করতে লাগল। কখনো গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছিল। সেই সাথে বোতল, জগ ভর্তি করতেও দেরি করছিল না। কাউন্টারের সামনের রুটি, কলাগুলো এদিক ওদিক করে সাজিয়ে রাখছিল।

দেখাতে চাইছিল সে কত কাজে ব্যস্ত। কিন্তু মেয়েটির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। - আমি যে তোকে ভীষণ ভালবাসি সেকথা কি তুই জানিস? স্থির দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটি। -তা-ই-না? কি চমৎকার! কথার ঢং দেখে আর বাঁচি না! আমি মালিক হলে তোকে কবেই বের করে দিতাম। মিজানের আশার প্রদীপ মৃদু জ্বলে উঠে আবার দপ করে নিভে গেল, মাটির প্রদীপে হাওয়া লাগলে যেমন করে নিভে যায় ঠিক তেমনি করে।

মুখটা বিবর্ণ, পান্ডুর দেখাতে লাগল। চোখের দৃষ্টি নিচে নামিয়ে কথা খুঁজতে লাগল। কিন্তু এর উপযুক্ত জবাব তার সঙ্কুচিত ভান্ডার হাতড়ে পাচ্ছিল না। তাই নীরব থাকল। -তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না মিজান।

পেটে দানাপানি পড়ে কন্ঠের ক্লান্তি আর বিরক্তিভাব অনেকটাই কমে এসেছে বলে মনে হল। -তুই আমার জন্য কি করতে পারবি? পারবি সমাজের বেড়াজাল ছিন্ন করে আমার হাত ধরে পালিয়ে যেতে? -পারব -কচু পারবি। যখন আমি দিনের পর দিন না খেয়ে ছিলাম তখন তুই কোথায় ছিলি? কোথায় ছিল তোর ভালবাসা? কেন আজ আমি এ পথে? তুই নিশ্চয়ই আমার জন্য তখন না খেয়ে ছিলি না। তখন ছিলি না ভবিষ্যতেও থাকবি না। অনৈতিক সম্পর্কের দায়ে সালিশ হলে সমাজের মাথামোটারা তোর পাশেই দাঁড়াবে।

আমি খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু হারাব। মিজান অপমানিত বোধ করতে লাগল। -আজ কি হয়েছে তোর? -আমার আবার কি হবে? -কিছু বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠছিস! আর কিছু খাবি? -খিদে নেই। রাস্তার দিকে লোকজনের চলাচল দেখতে লাগল। অন্ধকার ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছিল।

হঠাত কেমন যেন অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এল। গ্লাস, বাটি, প্লেট নাড়াচাড়ার শব্দ; প্লেট পরিস্কাররত মহিলার চুড়ির টুংটাং আওয়াজ ছাড়া নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল। হঠাত রাস্তা থেকে চোখ ফিরিয়ে মৃদু অথচ অসংলগ্ন কন্ঠে বলল- -আচ্ছা তুই কি সত্যিই আমাকে ভালবাসিস? -বাসি -এই যে এত কিছু বললাম তার পরও। তাছাড়া তুই তো আমার সব কিছুই জানিস। -হ্যাঁ।

নিঃস্পৃহ কণ্ঠস্বর। গলায় আর সেই জোর নেই। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, -আমি তোকে এতটাই ভালবাসি যে ওইসবে আমার কিছু যায় আসে না। মেয়েটি শুনে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল। মিজানের দিকে তাকালো।

দৃষ্টিতে যুগপৎ সহানুভূতি আর উপহাস খেলা করছিল। মিজান লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল। ঘামতে লাগল। -অসৎ জীবন তোকে অনেক পালটে দিয়েছে। মেয়েটির চেহারা হঠাত বদলে গেল।

কিছুটা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। চড়া গলায় কথা বলতে লাগল। -মানে কি? -মানে খুব সোজা, আমি তোকে ভালবাসি কিন্তু তোর অসৎ জীবন পছন্দ করি না। মেয়েটি প্রচন্ড হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। হাসিতে বিদ্রুপের সুর।

-যে আমার বিল সবসময় কম বলে, অন্য কাস্টামার না ডাকা পর্যন্ত নাকি আমার সাথে কথা বলতে পছন্দ করে, তার মুখে এসব ভারিক্কি কথা মানায় না। মেয়েটি হঠাত হাসি বন্ধ করে দিল। সিরিয়াস হয়ে গেল। চোখে মুখে গভীর চিন্তার আভাস। -আমি চলে যাচ্ছি।

আর ফিরে আসব না। তোকে আর জ্বালাব না। কথা দিচ্ছি কোনদিন কারও সাথে রাত কাটাবো না। -কি ব্যাপার তোর রুপ হঠাত এত বদলে গেল কেন? -অনেকদিন ধরেই মনের ভিতর কথাটা দোলা দিচ্ছিল, কাজটি ভাল না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।

-এত দিনে বুঝলি? কিন্তু কোথায় যাবি তা তো বললি না -যেখানে আর কোনদিন নোংরা পুরুষদের সংস্পর্শে আসব না। তুই খুশি তো? বোকার মত তাকিয়ে রইল মিজান। কিছু না বুঝলেও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বেরিয়ে পড়ল মেয়েটি। রেলষ্টেশন ছেড়ে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে আসল।

এখানটা বেশ নির্জন। আশেপাশে তেমন বাড়িঘর নেই। বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দু’চার খানা বাড়ি। ল্যাম্পপোস্টের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। মৃদু আলো অন্ধকার দূর করতে পারছে না।

আলো আধারিতে সবকিছু কেমন যেন ভুতুড়ে বলে মনে হচ্ছে। পথচারীর আনাগোনা তেমন একটা নেই বললেই চলে। থাকলেই বা নিশি কন্যাদের কি? তারা তো আর মানুষ না। তাদের কেউ নেই, না ভালবাসার, না মমতায় মাখা হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরার। অভিমানে দু চোখ ভেঙ্গে কান্না আসতে লাগল তার।

ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে রেললাইনে নেমে আসল মেয়েটি। রেললাইনের মাঝ দিয়ে হাঁটতে লাগল। পিছনে খুব পরিচিত একটি শব্দ শুনতে পাচ্ছিল, ট্রেন আসছে হুইসেল বাজিয়ে। কিন্তু সে লাইনচ্যুত হল না। কিছুক্ষনের মধ্যেই সমস্ত শরীর একটি ঝাঁকুনি খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে গেল।

যে ঠোঁট দুটি ভালবাসা নিয়ে মিজানকে স্পর্শ করতে পারে নি কোনদিন, আজ তা রক্তাক্ত হাসি হেসে উঠল। হৃদয়ে তোমার ছবিটা নিয়ে চলেছি দূরে আমি বহুদূরে আমি বিদায়ী রক্তে যে কবিতা লিখেছি কখনো তুমি যদি জানতে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।