আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধাপরাধী'দের বিচার প্রলম্বিত / বিঘ্ন করার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চক্রান্ত :-

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্তত একজন গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তি অবস্থান করছেন । তিনি যে আসবেন, এ সংবাদ তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি । অবশ্য তাতে কোনও অসুবিধা হয়নি তাঁর, যাঁদের কাছে তিনি এসেছিলেন এবং যাঁদের জন্যে এসেছিলেন, তাঁরা ঠিকই জানতেন তাঁর আসার খবর । ঢাকায় তিনি এসেছিলেন গত ১২ অগ্রহায়ণ (২৬ নভেম্বর) শনিবার। ১৩ অগ্রহায়ণ (২৭ নভেম্বর) রবিবার ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করার পর তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ।

পাশাপাশি মন্তব্যও করেছেন, বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দফাওয়ারি যেসব প্রস্তাব তাঁদের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল, তার অনেক কিছু গ্রহণ করা হয়নি । তবে যাওয়ার আগে তিনি যা বলে গেছেন তার সোজা মানে হলো, আমরা না কি আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞা কী তা ঠিকমতো বুঝি না এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে এর সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। তা ছাড়া বিদেশি আইনজীবীদের কেন আসতে দেয়া হচ্ছে না, তারও ব্যাখ্যা চেয়েছেন তিনি । এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন র‌্যাপ। কোনো কোনো আইনজীবী মনে করেন, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারকে যদি আন্তর্জাতিক মানসম্মত হতে হয়, তা হলে অবশ্যই স্টিফেন র‌্যাপের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

র‌্যাপকে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন কে? মনে করছেন লন্ডনের আইনজীবী টোবি ক্যাডম্যান । মনে করছেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক । জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল, টোবি ক্যাডম্যানকে অভিযুক্ত পাঁচ যুদ্ধাপরাধীর আইনজীবী হিসাবে নিয়ে আসার । শুধু টোবিই নন, জামায়াতে ইসলামীর এই তালিকায় ছিলেন আরও দুজন বিদেশি আইনজীবী স্টিভেন কে কিউসি ও জন ক্যামেহ । কিন্তু বাংলাদেশে আইনজীবীদের পেশাগত অনুমতি নিয়ন্ত্রণ আইনের কারণে তাঁরা কেউই আসতে পারেননি ।

এ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির আইনজীবীরা হইচই করছেন, মিডিয়ায় অনেক কথাই বলে বেড়াচ্ছেন; কিন্তু এঁদের কেউই বলছেন না, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই আইনজীবীদের পেশাগত অনুমতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে বার কাউন্সিল জাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে । এমনকি টোবি ক্যাডম্যানদের দেশেও একই ধরণের বিধিনিষেধ রয়েছে । চাইলেই কোনো আইনজীবী বাংলাদেশ বা অন্য কোনও দেশ থেকে গিয়ে ইংল্যান্ডের আদালতে আইনজীবী হিসেবে দাঁড়াতে পারেন না । টোবি ক্যাডম্যানরা কি বাংলাদেশের আইন ও আইনগত সংস্কৃতি জানেন ? জানেন না, জানলে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের কাছে সরাসরি চিঠি পাঠিয়ে, একইসঙ্গে সেই চিঠি প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করে আদালত অবমাননা করতে পারতেন না । বাংলাদেশের সব আইনজীবীই এটি বোঝেন, জানেন; এমনকি অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকও বিচারককে সরাসরি এমন চিঠি পাঠানোর বিষয়টির সঙ্গে আদালতে দ্বিমত পোষণ করতে বাধ্য হয়েছেন ।

তা ছাড়া ভিজিটিং ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আইনচর্চা করতে আসার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন টোবি — এটাও জানেন র‌্যাপ-রাজ্জাকরা । জানার পরও তাঁরা ভেজা বেড়ালের মতোপ্রশ্ন করে বেড়াচ্ছেন, টোবিকে কেন বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হয়নি ! এমন অনেক কিছু জানার পরও শুধু র‌্যাপ-রাজ্জাকই নন, আরও বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা আইনজীবীও বাংলাদেশের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন নীতিনির্ধারণমূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালাচ্ছেন । সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিলে তাঁদের জাতকুলমান সব কিছুই যায় — অতএব তাঁরা কথাগুলো বলছেন অন্য ভাষায় । বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে যেমন এ বিচার শুরুর প্রথম দিকে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভালোমানুষী দেখিয়ে বলা হচ্ছিল, আমরাও চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হোক, ঠিক তেমনি তাঁরাও বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হোক, তবে… এই ‘তবে’র মানে আসলে তবে রে···। তাঁরা ইনিয়েবিনিয়ে অভিযুক্তদের অধিকার সংরক্ষণের বিভিন্ন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আইনের এমন সব ভাঙা বেড়া বানাতে চাইছেন, বিচারপ্রক্রিয়ায় এমন সব দুর্বলতার ফাঁক তৈরি করতে চাইছেন, যাতে সেইসব ভাঙা বেড়া ও ফাঁকফোকর দিয়ে বীরদর্পে বেরিয়ে আসতে পারেন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীরা ।

এদের কেউ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, কেউ যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন — অতএব তাঁদের বিভিন্ন যুক্তিতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই । ফলে, বিচারকাজ পিছিয়ে পড়ছে । বিভ্রান্তির জাল সরিয়ে বিচারকাজ এগিয়ে নিতে দেরি হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের। সেই সুযোগে নতুন বিভ্রান্তির জাল বিছানোর সুযোগ পাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের চক্র । গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে ।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এই প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে । আর এই বিচারকাজকে বাধাগ্রস্ত করতে হঠাৎ করেই গত ২৭ অক্টোবর অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিমের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করা হয় । আদালত থেকে ওয়াক আউটের মত নাটকীয় ঘটনারও জন্ম দেন সাঈদীর আইনজীবীরা । এই অপতৎপরতার অংশ হিসাবেই এখন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ডিফেন্স টিমের প্রধান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আবদুর রাজ্জাককে বলতে শোনা যাচ্ছে, পাঁচটি মহাদেশ থেকে তিনজন করে মোট ১৫ জন বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনালটি গঠন করা হোক । শুনতে যত ভালোই লাগুক, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিয়ে যে ভয়ানক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে, এ প্রস্তাব তারই অংশবিশেষ ।

তা ছাড়া, মওদুদ আহমদ, আবদুর রাজ্জাকরা কথায় কথায় রোম সংবিধির কথা বলেন; তারা কি জানেন না যে, রোম সংবিধির মুখবন্ধেই বলা হয়েছে, এ ধরণের অপরাধের বিচার করার প্রথম দায় অপরাধ যে দেশে সংঘটিত হয়েছে সেই দেশের ? রাষ্ট্র যখন বিচার করতে ব্যর্থ, অসম্মত কিংবা অপারগ হবে, কেবল সে ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে ? এবং এ ধরণের হস্তক্ষেপও আন্তর্জাতিক আইন আদালতের পক্ষে কেবল রোম সংবিধি অনুমোদনের পরবর্তী সময়ের অপরাধ বা অপরাধসমূহের জন্যে প্রযোজ্য হবে, অতীতের কোনও অপরাধের জন্যে নয় । রোম সংবিধির এই মুখবন্ধ থেকে সুস্পষ্ট, বাংলাদেশে আবদুর রাজ্জাকদের প্রস্তাবিত ট্রাইব্যুনাল গঠনের কোনও সুযোগ নেই । কিন্তু চক্রান্ত থেমে নেই । জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের কাছে বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার আলোচনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের উদ্যোগের চলমান উদ্যোগের বিরোধিতা, বিএনপির রোড মার্চের জনসভা ও পথসভাগুলোতে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার লক্ষ্যে জনমত গঠনের অপচেষ্টা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত দুটি ইংরেজি পত্রিকায় সম্প্রতি লেখা জন ক্যামেহের একটি নিবন্ধ প্রকাশ, পাকিস্তানের ডেইলি ডন পত্রিকার উদ্যোগে সম্প্রতি উর্দুভাষী বেসামরিক ব্যক্তিদের ওপর অত্যাচারের বিচার দাবি করে সম্পাদকীয় লেখা, প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক ইকনোমিস্ট-এর চলতি সপ্তাহের নিবন্ধ এবং স্টিফেন র‌্যাপের এই অনালোচিত ভ্রমণও তাই তাৎপর্যপূর্ণ । র‌্যাপ বাংলাদেশে প্রথম এসেছিলেন বাংলাদেশ সরকারেরই আমন্ত্রণে এ বছরের ১০ জানুয়ারিতে ।

তারপর ২১ মার্চ তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এবং আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছে এক চিঠি লিখে আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহের ট্রাইব্যুনাল আইসিটি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্পর্কে বিভিন্ন সুপারিশ করেছিলেন । বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে র‌্যাপের ওই উদ্যোগ ও সুপারিশ ছিল একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত । কেননা র‌্যাপ ২১ মার্চের ওই চিঠিতে নিজেই স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) একটি ‘ডমেস্টিক কোর্ট’ । তার মানে এটির কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ ও নিজস্ব বিষয়। র‌্যাপের নিজস্ব ওই স্বীকৃতির পরও এ ধরণের সুপারিশ করার মানে দাঁড়ায়, দ্য ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপেস্নাম্যাটিক রিলেশনসের ৪১(১) অনুচ্ছেদের সরাসরি লংঘন।

কিন্তু কথায় বলে, ‘গরীবের বউ, সকলের ভাবী’ ! যুদ্ধাপরাধী চক্র এখানে রাজনৈতিকভাবে এত সংঘবদ্ধ যে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের উদ্যোগকে তারা নসাৎ করে দেয়ার রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে । স্টিফেন র‌্যাপদের পক্ষেও তাই সম্ভব হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে নানা উপদেশ দেয়া । ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকরা বার বার বলার চেষ্টা করছেন, সিয়েরা লিওন, রুয়ান্ডা, প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়া কিংবা হেগে যেভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গড়ে উঠেছিল, বাংলাদেশেও ঠিক একই প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করে বিচার কাজ চালাতে হবে ! কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের কাছে তাঁরা এটা আর বলছেন না যে, আইসিটিওয়াই, আইসিটিআর, আইসিসির মত বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালগুলো গড়ে উঠেছিল একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে । অন্যদিকে, বাংলাদেশে আইসিটি গঠনের প্রেক্ষাপট একেবারেই আলাদা — এটি সম্পূর্ণই বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের ও বাংলাদেশের ভুক্তভোগীদের জন্যে একটি বিচারপ্রক্রিয়া । স্টিফেন র‌্যাপ ও আবদুর রাজ্জাকরা কি তা হলে বলতে চান, এখনও বাংলাদেশের মধ্যে পাকিস্তান টিকে আছে ? তাঁরা তাই চান, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মধ্যে অস্তিত্বমান পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের সমঝোতার ভিত্তিতে একটি আদালত গঠন করে রুয়ান্ডা ও সিয়েরা লিওনের কায়দায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে ? আরও একটি ব্যাপার, স্টিফেন র‌্যাপ বলছেন (এবং আবদুর রাজ্জাকরাও বটে ! ), আইসিটি একটি ‘ডোমেস্টিক কোর্ট’ হলেও একে অন্যান্য দেশের জন্যে একটি মডেল হয়ে উঠতে হবে — কিন্তু যুক্তি দিয়ে বলতে পারছেন না, আইসিটির ম্যানডেট এবং প্রায়োরিটিই যেখানে সীমিত এবং ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের (১৯৭১-এর অপরাধসমূহের বিচার ও ভুক্তভোগীদের ন্যায় বিচারপ্রদান), সেখানে কোন উদ্দেশ্যে অন্য দেশের জন্য একটি মডেল হয়ে ওঠার দায়ভার পূরণ করতে হবে! আমাদের দেশে কি শান্তি বজায় রাখার জন্য জাতিসংঘের শান্তি মিশনকে ডেকে আনতে হয়েছে এবং তাই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অপরাধের বিচার করতে হবে ? এ রকম দাবি করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা প্রকারান্তরে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেরই বিরোধিতা করছেন ।

এবং তাঁরা এখন যেরকম অপতৎপরতা শুরু করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জাতিসংঘের শান্তি মিশন নিয়ে আসাই তাদের উদ্দেশ্য, যাতে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত পথে এ বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া যায় । স্টিফেন র‌্যাপ, স্টিভেন কে কিউসি, টোবি ক্যাডম্যান, জন ক্যামেহ ও আবদুর রাজ্জাকরা বার বার রোম সংবিধির কথা বলে থাকেন । কিন্তু তাঁরা কি রোম সংবিধিতে এমন কোনও একটি ধারাও দেখাতে পারবেন, যেখানে রাষ্ট্রপক্ষ হিসাবে বাংলাদেশের ওপর দেশটির একেবারেই অভ্যন্তরীণ বিচারকার্যের ক্ষেত্রে আইসিসির প্রোভিশন ও প্রোসিডিউরসমূহ হুবহু নকল করে জুড়ে দেয়ার শর্ত চাপানো হয়েছে ? রোম সংবিধির ৬, ৭(১) অনুচ্ছেদকে ব্যাখ্যা করে আইনবিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রোম সংবিধিভুক্ত অপরাধসমূহের সংজ্ঞাসমূহ কেবলমাত্র রোম সংবিধির উদ্দেশ্যাবলী ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে না । একইভাবে রোম সংবিধির অনুচ্ছেদ ১২ এবং অনুচ্ছেদ ১০ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, এটি ন্যুরেমবার্গ কোর্ট অথবা আইসিটিওয়াই এবং আইসিটিআর-এর মত বিভিন্ন ট্রাইবুনালের গভর্নিং সংবিধিসমূহের লিগাল প্রিন্সিপালসমূহকে অকার্যকর করে না, উল্টে ফেলে না । তার মানে, রোম সংবিধি আইসিটিকেও (যে আইন দিয়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে) অস্বীকার করে না, ছুড়ে ফেলে না ।

র‌্যাপ-রাজ্জাকরা আইসিটিওয়াই এবং আইসিটিআর-এর দোহাই দিচ্ছেন । তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন, খুব বেশি দিন আগে নয়, এই ২০০৯ সালের ডিসেম্বরেই আইসিসির চেয়ারম্যান জাস্টিস স্যাং-হাইয়ুন সং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের আওতায় চিহ্নিত অপরাধসমূহ বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থার সামর্থ্যের ওপর তার পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেছিলেন । র‌্যাপ-রাজ্জাকরা বলছেন না, জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা ও আইনের ওপর এসব ট্রাইব্যুনালের সংবিধিসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট রুলস অব প্রসিডিউর অ্যান্ড এভিডেন্সের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার দায়বদ্ধতা ছাড়া অন্য কোনো প্রভাব নেই । সত্যি কথা বলতে গেলে, র‌্যাপ-রাজ্জাকরা সারাদেশে বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের নাম উচ্চারণ করে শুধুমাত্র ধ্রুম্রজালই সৃষ্টি করছেন, বিচারের পথে নানা বাধা তৈরি করছেন । র‌্যাপ-রাজ্জাকরা বুঝে গেছেন, সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা গেলেও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের মানকে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না; আইসিটি আন্তর্জাতিক অপরাধের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা মেনে নিয়েই অপরাধসমূহ সনাক্ত করেছে ।

কিন্তু এটি যেহেতু ডোমেস্টিক কোর্ট সেহেতু দেশের সংবিধান অনুমোদিত আইন অনুযায়ীই সে বিচারকাজ পরিচালনা করবে । আর এ কারণেই আবদুর রাজ্জাকদের মুখ থেকে এখন নতুন দাবি — বিদেশি আইনজীবীদের নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করার দাবি শোনা যাচ্ছে । ২১ মার্চে স্টিফেন র‌্যাপ তার চিঠিতে যেসব সুপারিশ করেছিলেন, সেসব অযৌক্তিক দাবিদাওয়ার একটি যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম ‘স্টিফেন র‌্যাপ : অফ মিসকনসেপশানস, আনরিয়ালিস্টিক এপেকটেশান্স অ্যান্ড ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ শিরোনামে । আন্তর্জাতিক আইনজীবী মহলে র‌্যাপ-রাজ্জাকদের মুখ এরপর বলা যায় বন্ধ হয়ে গেছে । এবং তারপর থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকচক্র আরও মরিয়া হয়ে বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন, অনাবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে গুজব ছড়াচ্ছেন এবং অদৃশ্য রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে আইসিটির প্রকৃত কাজকে ব্যাহত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সবসময়েই চায় বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে মৌলবাদী রাজনীতির ধারা টিকিয়ে রাখতে, যাতে প্রয়োজনে এরকম দেশগুলোকে আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তান বানানো যায় । বাংলাদেশে মৌলবাদী রাজনীতির ধারা গড়ে তুলেছে যুদ্ধাপরাধীরা । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই মুখে যা-ই বলুক না কেন, এই মৌলবাদী রাজনীতির ধারাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার পক্ষপাতী । নিজেদের বাঁচাতে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদীরাও যে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান অথবা পাকিস্তান বানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পায়ের নিচে নৈবেদ্য হিসাবে তুলে দিতে রাজি আছে, তা এর মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । র‌্যাপের ঘন ঘন আসা-যাওয়ার মধ্যে দিয়ে বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটছে।

তা হলে ন্যায় বিচার পাওয়ার যে আবেগ নিয়ে জনগণ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে উদ্দীপ্ত হয়েছিল, তা কি মিথ্যা হয়ে যাবে ? যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ জনমনে যে আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিল, তা কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে ? সরকারের কি উচিত হবে র‌্যাপ মিশনে সাড়া দিয়ে প্রকারান্তরে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার ? রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটলে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের আর কোন সম্ভাবনাই থাকবে না । বিএনপি মুখে যাই বলুক না কেন, খালেদা জিয়া ও বিএনপির বিভিন্ন নেতারা তাঁদের বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তা আমাদের সকাল-বিকেল নানাভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন । আমরা চাই, আইসিটি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের কোনো কথায় কান না দিয়ে স্বাধীনভাবে দ্রুত এগিয়ে যাক । র‌্যাপ-রাজ্জাকদের সুপারিশ নিয়ে দেনদরবার না করে বিচার প্রক্রিয়ায় আইসিটিকে সর্বতোভাবে সাহায্য করাই হবে সরকারের এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি এবং প্রধান কাজ । .........এই বিশ্লেষনটি করেছেন জনাব শামীম ইমতিয়ার ।

সম্মিলিত শপথে রুখে দিব অশুভ সব চক্রান্ত......  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.