আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজানের সুর ভেড়ালো তরী হেদায়েতের বন্দরে

নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক সত্তর দশকের গোড়ার দিক। পুরো পশ্চিমা বিশ্ব জুড়ে হইচই পড়ে গেলো। সুরের মূর্ছনায় বিমুগ্ধ হয়ে উঠলো পশ্চিমা দুনিয়া। কন্ঠের জাদুতে সবাই অভিভূত। সবচেয়ে বড়কথা যাকে নিয়ে এতো হইচই তার বয়স মাত্র ২২ বছর।

এই বয়সেই এতো পরিপক্কতা! এতো খ্যাতি! তিনি যখন পিয়ানো বাজাতেন,স্থান-কাল-পাত্র ভুলে শ্রোতারা তন্ময় হয়ে থাকতেন সুরের সে সুষমায়। ছোটবেলা থেকেই ছিলো তাঁর সুর,সংগীত ও আঁকাআঁকির দুর্নিবার আকর্ষণ। গ্রীক অর্থডক্স পিতা ও সুইডিস লুথারিয়ান মাতার এই বিশ্ববিখ্যাত সন্তান ক্যাট স্টিভেন্স। পিতৃদত্ত নাম স্টিভেন্স দিমিত্রি জর্জ,২১ জুলাই লন্ডনের মেলবোর্নে জন্মগ্রহণ করেন। এই অসাধারণ সংগীতপ্রতিভা।

শিল্প ও সংগীতের দুর্বার আকর্ষণ জড়িয়ে রাখতো ক্যাট স্টিভেন্সকে। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের মাঝে লুকিয়ে আছে স্বপ্রাণ প্রতিভা। স্তিভেন্সের বয়স পনের হলে পিতা ৮ পাউন্ড খরচ করে গিটার কিনে দেন তাকে। এটি ছিলো তার জীবনের প্রথম সংগীতযন্ত্র। প্রিয় গিটারটি কখনোই তিনি হাতছাড়া কর‍তেন না।

এমনকি ঘুমাতে গেলেও বালিশের পাশে সযত্নে রক্ষিত থাকতো প্রিয় গিটার। স্টিভেন্স যখন গিটার বাজাতেন মোহনীয় সুরমূর্ছনা ছড়িয়ে পড়তো দিকবিদিকে। ক্যাথলিক স্কুলের পাঠ চুকিয়ে স্টিভেন্স হিউমারস্মিথ স্কুল অব আর্ট থেকে ১ বছরের শর্টকোর্স করেন ফাইন আর্টসে। ইচ্ছে ছিলো কার্টুনিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার। কিন্তু গানের আকর্ষণ তাকে তাড়িত করে সংগীত সাধনায়।

গাইতে শুরু করেন পুনর্বার। কফি হাউজ ও পাব্লিক প্লেস ছিল তার মঞ্চ। শ্রোতার তুমুল হর্ষধ্বনি ও উপচে পড়া ভিড় জানান দিতো এই গায়কের অনাগত সাফল্যের। ১৮ বছর বয়সে পরিচয় ঘটে ব্রিটিশ সংগীত প্রডিউসার মাইক হ্যারিসের সাথে। এই সংগীতপ্রযোজক গান শুনে মুগ্ধ হন এবং এলবাম বের করতে অনুপ্রাণিত করেন স্টিভেন্সকে।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ১৯৭০ সালে রিলিজ হওয়া ট্রিপল প্লাটিনামখ্যাত এলবাম টি ফর দ্য টেইলারম্যান এবং ট্রেজার এন্ড দ্য ফায়ারক্যাট যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭২ সালে ক্যাচ বল এট ফোর এলবামটি রিলিজ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে এর ৫ লাখ কপি শেষ হয়ে যায়। সংগীতের দুনিয়ায় একের পর এক যখন বিপ্লব ঘটিয়ে চলছেন স্টিভেন্স, সে সময় তিনি মরক্কো যান ট্যুরে। দিনটি ছিলো শুক্রবার।

মারাকেশের শহরতলীতে ঘুরতে বেরিয়েছেন স্টিভেন্স। এই সময় তার কানে ভেসে এল আজানের সুমধুর সুরলহরী। সে অপার্থিব সুর এতো শক্তিশালী,এতো হৃদয়গ্রাহী ছিলো সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাড়াঁন স্টিভেন্স। অবাক হয়ে গাইডকে জিজ্ঞেস করেন,এটি কিসের আওয়াজ। মৃদু হেসে গাইড উত্তর দেয়,এটি আজানের ধ্বনি এটি।

-আজান কী?প্রশ্ন করেন তিনি। -আজান প্রার্থনার জন্য মুসলমান্দের মসজিদে আহ্বান জানানোর পদ্ধতি। -এটি প্রার্থনার সুর,মানে স্রষ্টার গান? -হ্যাঁ। উত্তর দিল গাইড। হতবাক স্টিভেন্স স্বগোক্তি করলেন, আমি অনেক রকম গানই তো শুনেছি।

কেউ টাকার জন্য গায়,কেউ নাম-যশ ও খ্যাতির জন্য গায়,কেউ গায় শখের বশে, কিন্তু স্রষ্টার জন্য গান!! মরক্কো থেকে আমেরিকা ফিরে গেলেন স্টিভেন্স। আজানের সুমধুর সুর সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত ছায়ার মতো অনুসরণ করে তাঁকে। তাঁর সমগ্র অস্তিত্বে জড়িয়ে থাকে সে অনুপম সুরধ্বনি। কানে বাজতে থাকে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার,আল্লাহ্‌ বড়,আল্লাহ মহানের আহ্বান। এ যে স্রষ্টার ডাক, অবিনশ্বরের আহ্বান! কোন কাজে স্থির হতে পারেন না স্টিভেন্স।

হয়ে পড়েন অনেকটা উন্মাতাল। নাওয়া-খাওয়া সবকিছু বিস্বাদ লাগে। ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে স্টিভেন্স ক্যালোফোর্নিয়ার সমুদ্রতীরে বেড়াতে যান। কিন্তু তাকে বহঙ্কারো বোটটি প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে পড়ে। দুর্যোগের ঘনঘটায় জীবনমৃত্যুর দোলাচালে স্টিভেন্স মারাকাশে শহরে শ্রুত স্রষ্টাকে ডাকতে থাকেন, হে প্রভু! তুমি যদি আমাকে বাঁচিয়ে দাও,তবে আগামী জীবনে আমি তোমার জন্যই কাজ করে যাব।

এ সময় প্রচন্ড এক ঢেউ তাকে উপকূলে আছড়ে ফেলে। প্রাণে রক্ষা পান স্টিভেন্স। ক্যালোফোর্নিয়া থেকে ফিরে এসে স্টিভেন্স আরো উতলা হয়ে পড়েন। তিনি বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা শুরুন করেন। বৌদ্ধ,জৈন,চায়না প্রভৃতি ধর্ম ছিল তার অধ্যয়নের বিষয়বস্তু।

কিন্তু এসব ধর্ম তার মানসিক প্রাশান্তি ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। বিনিদ্র রজনী প্রলম্বিত হতে থাকে কেবল। দিশেহারা স্টিভেন্স যখন এমনতরো পরিস্থিতির ঘূর্ণিপাকে বিধ্বস্ত প্রায়,সে সময় তার ভাই ডেভিড গর্ডন জেরুজালেম থেকে তার জন্য একখানা কোরআন নিয়ে আসেন। কোরআন অধ্যয়ন করে এক অপার্থিব প্রশান্তিতে ভরে উঠে তার মন। এতে করে ইসলাম নিয়ে জানার আগ্রহও বেড়ে যায়।

কিন্তু কোথায় পাবেন ইসলামী পুস্তক? হন্যে হয়ে ঘোরেন স্টিভেন্স। এটা সে সময়ের কথা যখন পুরো আমেরিকাতে কোন মসজিদই ছিল না। রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্টিভেন্স বলেছিলেন সে সময়ের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা,'আমি দিশেহারা ,কোরআন আমার কৌতূহল বারিয়ে দিল। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে জানার কোনো পথ তখন আমার সামনে উন্মুক্ত ছিল না। আমি অনুভব করি এক অদৃশ্যশক্তি আমার পুরো অস্তিত্বকে যেন ঘিরে রেখেছে।

ঠিক এ সময় আমি ব্রিটেনে ফিরে আসি। ' ব্রিটেনে গুটিকয়েক মসজিদে তাবলিগের কিছুটা আনাগোনা ছিল। রিজেন্সপার্ক মসজিদে এমনি একটি জামাতের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। জামাতে আগত মুসল্লিদের কাছে গেলেন স্টিভেন্স। আমির সাহেব তখন আল্লাহ তা'লার একত্ববাদের বয়ান করছিলেন।

এ বয়ান তার মধ্যে এতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে পৈত্রিকধর্ম বিসর্জন দিতে সময় লাগে না তার। ১৯৭৭ এর ২৩ ডিসেম্বর ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্র্য় নেন মিউজিক ওয়ার্ল্ড এওয়ার্ড জেতা এই সংগীত তারকা। আজানের মোহনীয় সুর শেষ পর্যন্ত তাকে পৌঁছিয়ে দেয় হেদায়েতের বন্দরে। ক্যাট স্টিভেন্স হয়ে যান ইউসুফ ইসলাম।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।