আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কান্নার খেরোখাতা

চামড়ার ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিখানির অনুভূতির অভাব নেই। কখনো ফিনিক জোসনা ফোটায়,আবার কখনো অঝোর বাদল গড়ায়। রং পাল্টায় মুহুর্তের মহিমায় । সচক্ষে তার প্রমান পেয়েছিলাম -স্নাতক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন গ্রাজুয়েট হওয়ার আনন্দে বন্ধুরা সবাই মিলে চা ছোঁড়াছুঁড়ির উৎসব করছি। জাভেদটা ছিল অন্য ধাতে গড়া।

মল চত্ত্বরে সুন্দরী ষোড়শী দেখা মাত্র দু হাত কচলে জাভেদ তাদের বলছে-‘পরম পূজনীয়া,স্নাতক পাস করিলাম। এখন আমি রোজগারের যোগ্য। দয়া করিয়া,আমার পাণি গ্রহন করিবেন কি?’ পাণির বদলে পীড়ন পাইলাম ! সুর্যসেন হলের কোন এক ছাত্রনেতার হৃদয়েশ্বরীকে পাণি সাধায় জাভেদের পিঠে প্রণামী জোটে । ইস ! সেই টলটল চোখের ছলছল মুখখানি এখন খুব মনে পড়ে। বন্ধুরা জাভেদকে টিপ্পনি কেটেছিল-‘শালা ছিঁচকাদুনে।

’ কিন্তু কান্না নানা রকমের। সে ছিঁচকাদুনে হোক, বা মড়াকান্না। রবিঠাকুর তাঁর ‘নাকি সুরের কান্না’-তে কান্নায় যে একটা ‘সুর’ আছে তার আভাস দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই সুর যে কখনও কখনও বাণী আশ্রিত তা রবীন্দ্রনাথের জানার কথা নয়, কারণ যে কান্না বাণী ও সুরের যুগলমূর্তি ধারণ করে, সে কান্না একান্তই বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য। ইট-কাঁঠের ঢাকার মানুষের তথা শিক্ষিত নাগরিকের, সেই বাণীময় অশ্রুবিসর্জন সম্ভব নয়। শিক্ষিতরা বিশ্বাস করে– ‘মানুষ সর্বদা নির্জনে কাঁদতে চায়।

কোন সাক্ষী না রেখে’ (শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়/হিম পড়ে গেল)। কিন্তু সে তো চাপাকান্না অথবা বোবাকান্না। তার না আছে বাণী, না আছে সুর। সুর ও বাণীর মেলবন্ধন যে কান্নার অবধারিত ফল, সে হল মড়াকান্না বা মৃতের উদ্দেশে কান্না। অদ্ভুত টেনে টেনে, গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে এই কান্নার সঙ্গে যুক্ত মৃত ব্যক্তির সঙ্গে বিজড়িত নানা স্মৃতির অনুষঙ্গ।

যেমন 'ওগো-ও তুমি বলেছিলে বোশেখের মেলায় নিয়ে যাবে গো-ও-ও--, মেলা দু’দিন পরে, তুমি কোথায় চলে গেলে গো-ও-ও' ইত্যাদি। অদ্ভুত এই সুরেলা কান্না শোনা যায় বাংলার খেটে-খাওয়া মহিলাদের কণ্ঠে। কখনই পুরুষরা এই ধরনের বাণীবদ্ধ কান্না কাঁদেন না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি এই ধরনের কান্নায় ক্রন্দনরত মহিলার চোখে কোনও অশ্রু দেখিনি (মাফ করবেন)। খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন এক হিন্দৃ বৃদ্ধা।

মহিলা বিধবা এবং বর্ণে ডোম । বাল্যবিধবা এই রমণীর অবলম্বন ছিল একমাত্র সন্তান কানু। সেই কানুও বৃদ্ধার প্রথম যৌবনেই অকাল প্রয়াত। শেষ বয়সে এসে একাকী বৃদ্ধার মাঝে মাঝেই তার কানুর কথা মনে পড়ত এবং তিনি তখন আসর করে কাঁদতে বসতেন। কান্নার এক সুর, এক বাণী।

কথাগুলো ছিল – ‘অন্ধের লড়ি কান্নার ছড়ি কানু তুমিরে-এ-এ-এ বাব্বা!’ 'কানু তুমিরে-এ-এ' অংশটি উঠে যেত উচ্চগ্রামে এবং তারপর ‘বাব্বা’ শব্দটি উচ্চারণ করতেন একদম অতলস্পর্শী খাদে। নিতান্ত বালক আমরা, বৃদ্ধার বেদনা উপলব্ধির বয়স তখনও হয়নি। আমরা করতাম কী, বৃদ্ধা কাঁদতে বসলেই অপেক্ষা করতাম কখন তিনি 'কানু তুমিরে-এ-এ' বলে উচ্চগ্রামে উঠবেন এবং ঠিক নির্দিষ্ট সময়টিতে আমরাও তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে খাদে গাইতাম – ‘বাব্বা’ অংশটি। সঙ্গে সঙ্গে কান্না যেত থেমে এবং আমাদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে গালাগালি শুরু হতো। বাণীময় এই কান্নাও যে কত ছন্দবদ্ধ ও কৌতুকময় হতে পারে তার একটি বিবরণ আছে শরৎ পণ্ডিতের লেখায়।

প্রতিবেশী এক ভদ্রলোককে সকাল সকাল উচ্চৈস্বরে কাঁদতে দেখে শরৎ কান্নার হেতু জানতে চাইলেন-কী হয়েছে? ভদ্রলোক যা বললেন তাতে অপরাজেয় কথাশিল্পি আরও অবাক। ভদ্রলোক যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সেই বাড়ির বাড়িওলার বৃদ্ধা মা মারা গিয়েছেন। দাদাঠাকুর বললেন– বাড়িওলার মা মরেছে, তা তুমি কেঁদে মরো কেন? ভদ্রলোক বাণীমিশ্রিত সুরে কেঁদে কেঁদে বললেন– 'যার বাড়িতে ভাড়া থাকি তার মরেছে মা-আ-আ। তার কাঁদনে না কাঁদলে থাকতে দেবে না-আ-আ'। এই কান্নাটির নামই বোধহয় কুমিরের কান্না।

বাণীবদ্ধ এই কান্না অনেক সময়ই ছিল নির্দিষ্ট একটি রুটিন। সারাদিনে যেমন নানান কাজ থাকে। বাসন মাজা, কাপড় কাচা, রান্না করা, তেমনই কান্না কাঁদা এদের একটি অবশ্যকর্মের মধ্যেই পড়ত। অমিয় চক্রবর্তীর একটি কবিতার কথা মনে পড়ে। বৃদ্ধা দিদিঠাকরুণকে মৃত্যুর বিবরণ দিতে গিয়ে কবি লিখছেন– ‘রান্না রেঁধে, কান্না কেঁদে দিদিঠাকরুণ গেলেন চলে /খিড়কি দুয়ার শূন্যে খুলে /রামনাম সত্য হ্যায়।

’ এখন গ্রামাঞ্চলে নিম্নবর্গীয় শ্রেণিতেও চাপা কান্না বা বোবা কান্নায় নগরায়ণ ঘটছে। আজকাল আর সেই কান্নার সুর শুনতে পাই না। বাণীবদ্ধ সেই কান্নার সুরে ছিল ভিতরের হাহাকারকে সশব্দে বের করে দিয়ে হাল্কা হওয়ার প্রচেষ্টা। দরিদ্র, দিন এনে দিন খাওয়া বাড়িতে শোক বুকে নিয়ে বসে থাকার পরিসর দেয় না কঠিন জীবন। ফলত যত দ্রুত সম্ভব শোক সামলে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপ দেওয়ার অস্ত্র ছিল এই বাণীময় কান্না।

আজকাল জীবনযাপনের পরতে পরতেই এত কান্নার বসবাস যে,আস্ত একটা শোককে দুস্থ এক চিলতে কান্নার স্রোতে ভাসিয়ে দেয়ার সুযোগ মেলে না। ফলত আজকের গাঁয়ের বধূও কাঁদেন নির্জনে, কোনও সাক্ষী না রেখেই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।