আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাবেকবিলছড়ি মহামুনি বৌদ্ধবিহার: পাহাড়ের বুকে যেন শান্তির নীড়

'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। ১০ নভেম্বর, ২০১১। দুপুর ৩ টা। বান্দরবান জেলার মাতামুহুরী নদীর কোল ঘেঁষা লামা উপজেলার পৌরসভা বাসস্ট্যাণ্ড থেকে একটা টমটমে উঠে পড়লাম আমি এবং ব্লগার হুদাই পেচাল ।

গন্তব্য সাবেকবিলছড়ি, যেখানে একটি উঁচু পাহাড়ের উপরে মহামুনি বৌদ্ধবিহার রয়েছে। আজ সকালেই পৌঁছেছি লামাতে। ভেবেছিলাম, দূরের কোন পাহাড় থেকে ঘুরে আসবো দিনে দিনে। কিন্তু ঢাকা থেকে লামা পর্যন্ত প্রায় ১২ ঘন্টার জার্নি করে হুদাই পেচাল পুরাই কাহিল হয়ে পড়েছে দেখে ওই প্ল্যানটা বাদ দিয়ে মহামুনি বৌদ্ধবিহার ঘুরতে বের হলাম। আবহাওয়া খুবই চমৎকার।

পাহাড়ী এলাকাগুলোতে এখন অল্প শীত পড়েছে। লামা বাজারে দুপুরের খাওয়া শেষে দু'’জন রওনা হলাম। যাওয়ার পথে ছোট্ট লাল রঙের টমটমে তুলে নিলাম উচাইয়া এবং কেওহ্লা মার্মাকে। ওদিকটা একটু নির্জন। তাই স্থানীয় মার্মা অধিবাসী সাথে থাকলে এবং দল ভারী হলে চিন্তার কিছু নেই।

ত্রিশ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম বৌদ্ধবিহারের পাহাড়ের পাদদেশে। এবার পাহাড়ে ওঠার পালা। চার অভিযাত্রী নিজেদের পায়ের স্যাণ্ডেল এবং জুতা খুলে টমটমে রেখে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে উঠে যাওয়া সিঁড়ি ধরে উঠতে লাগলাম। কথিত আছে, এই সিঁড়ির প্রকৃত সংখ্যা সহজে কেউ গুণতে পারেনা। যদি কেউ সত্যিই গুণতে পারে, তবে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়।

মহামুনি বৌদ্ধবিহারের সিঁড়ি বেয়ে উঠছি আমরা প্রথম বৌদ্ধমন্দিরটি আঁকা-বাঁকা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পরেই চোখে পড়লো প্রথম বড় বৌদ্ধ মন্দিরটি। এখানে মোট তিনটি বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। মিয়ানমার থেকে আনা মাঝের মূর্তিটি আংশিক স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। এটির বর্তমান বয়স ১০০ বছরেরও বেশি। স্বর্ণের তৈরি গৌতমবুদ্ধের মূর্তি বৌদ্ধমন্দিরকে পাশে রেখে পাহাড়ের আরেকটু উপরে উঠতেই চোখে পড়লো সারিবদ্ধভাবে থাকা ’'জাদি'’।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিখ্যাত কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার স্মরণে '’জাদি’' তৈরি করা হয়। এই ’জাদির ভিতরে উক্ত মৃত ব্যক্তির শরীরের হাড়গুলো ভরে রাখা হয়। জাদি জাদির আরও ছবি পরের যে বৌদ্ধ মন্দিরটির দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম, সেখানে মহামুনি বৌদ্ধের আরেকটি বিশালাকৃতির মূর্তি শায়িত অবস্থায় চোখে পড়লো। মূর্তিটির পাশেই তার অনুসারীদেরও বেশ কিছু মূর্তি রাখা রয়েছে। উচাইয়া জানালো, এই মন্দিরের দরজা দিয়ে ঢোকার সময় হাতের বাম পাশে যে নারী মূর্তিটি রয়েছে, সেটি সাক্ষী হিসেবে কাজ করে।

অর্থাৎ, এই মূর্তির সামনে প্রণাম করলে ওই নারী মূর্তিটি পরবর্তীতে সাক্ষ্য দেবে। গৌতম বুদ্ধের শায়িত মূর্তি গৌতমবুদ্ধ সাক্ষী নারী মূর্তি মহামুনি বৌদ্ধবিহার পাহাড়ের উপর থেকে দেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বড় মন্দিরটির দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা সর্বশেষ যে বড় বৌদ্ধ মূর্তিটি আমরা দেখতে গেলাম, সেটি অত্র এলাকার সবচাইতে বৃহদাকৃতির বৌদ্ধ মূর্তি। কিন্তু মন্দিরের দরজার চাবি না থাকায় গৌতম বুদ্ধের বড় মূর্তিটির কোন ছবি সরাসরি সামনে থেকে তোলা সম্ভব হলোনা। পাশ থেকে লোহার গ্রীলের ভেতর দিয়ে যতটুকু সম্ভব তোলার চেষ্টা করেছি। উচাইয়া জানালো, এখানে বেশ বড় বড় সাপের আনাগোণা।

বড় মন্দিরের বাইরে থেকে তোলা ছবি বড় মন্দিরের ভেতরের মূর্তি বড় মন্দিরের ভেতরে বুদ্ধের সবচাইতে বড় মূর্তি বড় মন্দিরের ভেতরে আরও কিছু মূর্তি মন্দির দেখা শেষ। এবার একটু অ্যাডভেঞ্চার-এর শখ জাগলো। ঠিক করলাম, পাহাড়ের ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর দিয়ে নিচে নামবো। কিন্তু হুদাই পেচাল এর তীব্র বিরোধিতা করলো। তার বক্তব্য, খালি পায়ে ঝোপের ভেতর দিয়ে গেলে সাপে কামড়াতে পারে।

উচাইয়া আর কেওহ্লা তাকে আশ্বস্ত করলো যে, এরকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। অতএব, পাহাড় বেয়ে ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর দিয়ে আমরা চার অভিযাত্রী নামতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য, পাহাড়ের নিচের কৃত্রিম লেকটা দেখা। ব্লগার হুদাই পেচাল অবশ্য নামতে বেশ ভয় পাচ্ছিল, কেননা তার মনে উঁকি দিচ্ছিল, যদি কোনভাবে সাপের কবলে পড়ে যায়, তাহলে জীবনটা পুরাই শেষ। পাহাড়ের নিচের লেক লেক মুর্গির ফার্ম পাহাড় বেয়ে নেমে আমরা একটি সমতল জায়গায় এলাম।

লেকের ধারে মুরগির ফার্ম চোখে পড়লো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হলো আমাদের পাহাড়ে ওঠা। এবারের গন্তব্য, পাহাড়ের অপর পাশ দিয়ে নিচে নেমে মূল মন্দির পরিদর্শন করা। ভান্তে মূল মন্দিরের একাংশ মূল মন্দিরের বাইরে ছোট আরেকটি মন্দির মূল মন্দিরে ঢোকার আগে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ’'ভান্তে’' এর সাথে আমরা কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। ভান্তেও হাসিমুখে তাঁর সাথে কিছু ছবি তোলার অনুমতি দিলেন আমাদের।

মূল মন্দিরের ভেতরে দেখলাম বৌদ্ধদের ঐতিহাসিক সব চিত্রকর্ম। মন্দির দেখার পরও হাতে অনেক সময় রয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম, কাছেই যে সাবেকবিলছড়ি মার্মাপাড়া রয়েছে, সেটা ঘুরে যাবো। মাতামুহুরী নদীর পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে এগিয়ে চললাম মার্মাপাড়ার দিকে। মার্মা পাড়ায় ঢোকার আগে ছোট মন্দির।

প্রতিটি মার্মা পাড়ায় এরকম একটি ছোট মন্দির থাকে এবং পাড়ার শান্তি রক্ষার জন্য এখানে নিয়মিত পূজা দেওয়া হয়। শান্ত-স্নিগ্ধ মাতামুহুরী নদী মাতামুহুরী নদী লামার অন্যান্য মার্মা পাড়ার মতোই এ পাড়াটিও পরিষ্কার, শান্ত এবং অসম্ভব সুন্দর। অল্প ক'’টি পরিবার বাস করে এ পাড়াটিতে। শুরুতে অচেনা মানুষ দেখে একটু সতর্ক হলেও পাড়ার মার্মা নারী-পুরুষেরা একটু পরেই আমাদের কাছাকাছি এলো। এর কারণ অবশ্য, এই পাড়াটিতে উচাইয়ার অনেক আত্মীয়-স্বজন বাস করেন।

ছবি তুলতে পারবো কিনা জিজ্ঞেস করতেই, উচাইয়া বললো, ছবি তুলতে কোন সমস্যা নেই। অতএব, ক্যামেরা বের করে তুলতে থাকলাম ছবি। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ - সবাই ঘিরে ধরলো আমাকে, সবাই ছবি তুলতে চায়। গ্রুপ ছবি তুলে নিলাম কিছু। মার্মা পাড়ার একাংশ গাছে ঝুলতে থাকা বিশালাকৃতির চালকুমড়া মার্মা পাড়ার ভেতরে মার্মা পাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম পাড়ার শেষ মাথায়, মাতামুহুরী নদীর ধারে।

পড়ন্ত বিকেল। শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশের অবর্ণনীয় সৌন্দর্যে বার বার উদাস হয়ে যাচ্ছিল মন। এর মাঝে ব্লগার হুদাই পেচাল বললো, তার নাকি ওখান থেকে ফিরতেই মন চাইছেনা। তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পাহাড়ী আদিবাসী ললনাদের তার বেশ মনে ধরেছে। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে সে তাই মার্মা মেয়েকেই সাথে পেতে চায়, ইত্যাদি ইত্যাদি আরও নানা কথা।

কঠিন এক ঝাড়ি মেরে তাকে নদীর পাড় থেকে তুলে নিয়ে আবার ফিরে এলাম মার্মা পাড়ায়। এসে দেখি, কেওহ্লা আমাদের জন্যে গাছ থেকে ডাব পেড়ে রেখেছে। কচি ডাবের পানি দিয়ে আমরা পিপাসা মেটালাম। গাছ থেকে ডাব পাড়ছে কেওহ্লা সন্ধ্যা নেমে এলো চারপাশে। আমরাও গ্রামবাসীদের থেকে বিদায় নিয়ে লামায় ফিরে যাবার পথ ধরলাম।

কিভাবে লামা যাবেন: ঢাকা থেকে কক্সবাজারের এ.সি বাসে চড়ে চকোরিয়া বাস স্ট্যাণ্ড (লামা-আলীকদম বাসস্ট্যাণ্ড) নেমে পড়বেন। সেখান থেকে শর্টবডি-তে (জীপ) ৪৫ টাকায় ১ ঘন্টায় পৌঁছে যাবেন লামা। লামাতে থাকার ব্যবস্থা: মিরিঞ্জা হোটেল: ফোন নম্বর: ০১৫৫৩ ২৪৪৮২৬, ০১৫৫৩ ৭৫৭৪৭৫, ০১৫৫৩ ৬৫৫০৯৪, ০১৫৫৬ ৬২৪৪৮৩ লামাতে খাবার হোটেল: ১. হোটেল জব্বারিয়া ২. হোটেল মেহমান ৩. হোটেল জামান না বলা কথা: ১. যদি বেশ কিছুদিনের জন্যে লামাতে কাজে যান, তাহলে দিনে দিনে কক্সবাজারে ফিরে গিয়ে ভালো হোটেলে থাকতে পারবেন। কারণ লামাতে লোডশেডিংটা খুব বেশি। আর হোটেল মিরিঞ্জা 'চলে' টাইপ থাকার হোটেল।

২. দুর্গম পাহাড়ে ঘুরতে গেলে সাথে স্থানীয় গাইড থাকাটা আবশ্যক। মারমা বা মুরং গাইড হলে ভালো হয়। ৩. এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়া এবং জোঁকের প্রোকোপ বেশি। তাই সাথে 'ওডোমোস' ক্রিম এবং লবণ নিতে ভুলবেন না। ৪. পাহাড়ী রাস্তায় চলাচলের জন্য বাজার থেকে রাবারের স্যান্ডেল কিনে নেবেন।

৫. অনুমতি ব্যতীত আদিবাসীদের (বিশেষত: মেয়েদের) ছবি না তোলাটাই শ্রেয়। ৬. রাত ৮.৩০ এর পর লামা থেকে চকোরিয়ার অথবা চকোরিয়া থেকে লামার রাস্তায় কোন যানবাহন চলবেনা। ৭. বর্ষার সময় গেলে সাথে ছাতা এবং রেইনকোট নিতে ভুলবেন না। ৮. পাহাড়ে ট্রেকিং-এ গেলে সাথে চুইংগাম অবশ্যই নিবেন। লামা নিয়ে আমার আরও কিছু লেখা: লামা'র ডায়েরী টংগা ঝিরি পাড়ার ত্রিপুরা আদিবাসীদের সাথে কাটানো দুর্লভ কিছু মুহূর্ত মিশন: চিয়ং মুরং পাড়া আমার ভ্রমণ-কাহিনী ও ছবি ব্লগ গুলোর কালেকশন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।