আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরাজিত

আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল “শফিক সাহেব, আপনাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হল। “ “স্যার?” “তদন্ত কমিটি ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। তাদের সুপারিশ মতই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি যা করেছেন তাতে এক কথায় আপনার চাকরি চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু আপনি তের বছর এইখানে চাকরি করেছেন। সেই কথা মাথায় রেখেই আপনাকে আমরা ম্যান্ডেটরি রিটায়ারম্যান্টে পাঠাচ্ছি।

আপনি সাথে তিন মাসের বেতন পাবেন। “ “স্যার আমি নির্দোষ। “ “এখনো সেই একই কথা বলছেন?” “স্যার, আপনি জানেন আমি কিছু করিনি। “ “আমি কি জানি না জানি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। সেই অনুযায়ি সিধান্ত হয়েছে।

ব্যাপারটাতো আমার একার হাতে না। “ “স্যার এমন একটা সময়ে চাকরি চলে গেলে আমি ভীষণ বিপদে পড়ব। “ “চাকরি গেলে বিপদে তো পরবেনই। সবার বিপদের কথা চিন্তা করলে তো আমার চলবে না। আমার কাছে অফিসের স্বার্থটাই সবার আগে।

“ “প্লিজ স্যার আমার বিষয়টা আরেকবার বিবেচনা করুন। আপনি বললেই সবাই বুঝবে। “ “দেখুন শফিক সাহেব, আপনি এখন বাচ্চাদের মত আচরন করছেন। সিধান্ত যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর কিছুই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

ঠিক আছে, আপনি এবার আসুন। যাবার আগে রহিম সাহেবকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আপনার চেকটা নিয়ে যাবেন। “ “আপনারা এমন একটা কাজ করতে পারলেন?” “আমরা এমন একটা কাজ করতে পারলাম মানে? দেখুন রহিম সাহেব, কথা বুঝে শুনে বলুন। আপনি একজন চোর। আপনাকে আমরা পুলিশের হাতে না দিয়ে সসম্মানে বিদায় দিচ্ছি, এটা বোধ হয় আপনার ভাল লাগছে না।

“ শফিক মাথা নিচু করে নিজের টেবিলে ফিরে এলেন। অফিসের কেউ তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। তাকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তার মানে তার আগেই অফিসের আর সবাই বিষয়টা জানা হয়ে গেছে। আশে পাশে সবাই ফুসুর ফাসুর করছে।

শফিক সাহেবের লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন। হাতের কাজগুলো দ্রুত শেষ করে অফিস থেকে বের হয়ে যেতে হবে। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না।

মিনিট বিশেক পর এক্যাউন্টসের আবিদ সাহেব এসে বসলেন। তার মুখ ভর্তি পান, পানের রস তার ঠোঁটের কোনায় লেগে আছে। সুরুত করে কিছুটা রস গিলে ফেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি ভাই, বড় সাহেব কি বললেন? ভাই, সবই তো জানেন। আবার কেন জিজ্ঞেস করছেন? কি বলেন ভাই, আমরা কি ভাবে জানবো। আবিদ সাহেব যেন আকাশ থেকে পরলেন।

কালকে থেকে আর আসছি না। তিন মাসের বেতন অগ্রিম দিচ্ছে। আহা, একে বারে চাকরি নট করে দিল। শফিক উত্তর দিলেন না। আবিদ সাহেব বলে চললেন, আসলে বড় সাহেবের বয়স কম তো, তাই মাথা গরম।

আপনি কোন চিন্তা করবেন না। চুপ চাপ বাসায় গিয়ে রেস্ট করুন। আপনার ওয়াইফের না ডেঙ্গু হয়েছিল, এখন কি অবস্থা? এখন ভাল আছে। গুড গুড, ভেরি নাইস লেডি। আর আপনার মেয়েটা ভাল আছে? হু।

গুড গুড। শুনুন আপনি কোন চিন্তা করবেন না। কিছু দিন বাসায় বসে রেস্ট নেন, ভাবির দেখাশোনা করেন। আমরা তো আছি। আল্প দিনের মধ্যেই বড় সাহেবকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার আপনাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে ফেলব।

জি আচ্ছা। আচ্ছা, এখন তাহলে উঠি। আপনি কিন্তু একটুও টেনশন করবেন না। শফিক সাহেব সাবধানে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে গেলেন। অফিসে যে কয়টি মানুষ এক হয়ে তাকে বিপদে ফেলেছে, তাদের মধ্যে এই আবিদ সাহেব অন্যতম।

অথচ কি চমৎকার ভালো মানুষের অভিনয় করে গেলেন। শফিক অফিস থেকে বের হয়ে এলেন। কাউকে কিছু বললেন না, কারও কাছে বিদায় নিলেন না। তেরটি বছর তিনি এই একই অফিসে কাজ করে গেছেন। আজ চুরির অপবাদ মাথায় নিয়ে তাকে বিদায় নিতে হচ্ছে।

বাইরে করা রোঁদ। শফিকে ভীষণ খিদে পেয়ে গেল। তিনি অবাক হলেন। এমনিতে দুপুর বেলাটা তিনি না খেয়েই থাকেন, এক বারে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে খেতে বসেন। অথচ আজ বেলা দুটায় খিদের চোটে তার নারিভুরি হজম হয়ে যাচ্ছে।

খিদের চেয়ে বেশী পানি পিপাসা পাচ্ছে। অল্প পয়সায় খাওয়া যাবে এমন একটি হোটেলের খোজে তিনি রাস্তার পাশে একটি গলিতে ঢুকে পরলেন। খাওয়ার হোটেল খুঁজে পাবার আগেই তিনি দুই জন হাইজ্যাকারের সামনে পরে গেলেন। তার পকেটে তখন তিন মাসের বেতন, সর্বশক্তি দিয়ে তিনি সেটা রক্ষা করতে চাইলেন। হাইজ্যাকার দুজন তাকে মেরে বেহুশ করে ফেলল।

ঘণ্টাখানেক পর রাস্তার লোকজন তাকে অচেতন অবস্থায় হাস্পাতালে রেখে গেল। * শফিক সাহেব, আপনি বাসার কেউ আসেনি? জি, বাসায় খবর দিতে পারিনি। আপনি বরং আপনার বাসার বড় কাউকে নিয়ে কাল একবার আসুন, জরুরি কথা আছে। জি, আপনি আমাকেই বলুন। আপনাকে সরাসরি বলতে চাইছি না।

আপনি আপনার স্ত্রি বা এরকম কাউকে নিয়ে আসুন। আমার স্ত্রি তো অসুস্থ, ঘর থেকে এই সময় বের হতে পারবে না। আপনি যা বলার আমাকেই বলুন। দেখুন, আপনাকে কিভাবে কথাটা বলব বুঝতে পারছি না। ...... আপনার লাংস ক্যান্সার হয়েছে।

আমাদের এক্স-রে তে ধরা পরেছে। ফাইনাল স্টেজ। নিশ্চিত হবার জন্যে আমরা আরও দুবার পরিক্ষা করেছি। তবে এই স্টেজে আসলে ভুল হবার কোন সম্ভবনা নেই। এই অবস্থায় আর খুব বেশী কিছু করারও নেই।

...... ডাক্তার সাহেব আরও কি কি বলে চলেছেন তার বিশেষ কিছুই শফিকের কানে ঢুকছে না। তার হঠাৎ খুব গরম লাগছে। বুকটা হাস ফাস করছে। আচ্ছে, ঘরটা কি একটু একটু করে ছোট হয়ে আসছে? শফিক সাহেব আপনি কি আমার কথা শুনছেন? আমি আর কত দিন বাঁচব? আরও কিছু পরিক্ষা না করে কিছুই নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় একজন রুগি সাধারনত দুই থেকে তিন মাস বেঁচে থাকেন।

তবে সবই আসলে আল্লাহর হাতে। জি, আমি এখন আসি। শফিক সাহেব উঠে পড়লেন। আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনি বরং আগামি কাল আপনার কোন আত্মিয়কে নিয়ে আমার সাথে দেখা করুন।

আমার পরিচিত ভাল ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আছেন, তারা আপনাকে আরও ভাল পরামর্ষ দিতে পারবেন। বাহিরে এখন বিকেল। এখন আর বাস হাকাতে ইচ্ছে করছে না। শফিক সাহেব একটা রিক্সা ডেকে উঠে বসলেন। তখনই তার মনে পরল হাইজ্যাকার তার সব টাকা পয়সা নিয়ে গেছে।

ঢাকা মেডিক্যাল থেকে হেটেহেটে তিনি রামপুরা চলে এলেন। * রামপুরার এক অন্ধকার গলিতে একটি পুরনো পাচতালা দালান, তার চতুর্থ তলায় একটি দুই রুমের বাসায় শফিক সাহেবের সংসার। দোরগোড়ায় দারিয়ে বেল চেপে শফিক কিছুটা চিন্তায় পরে গেলেন। তার মাথায় ও বুকে ব্যান্ডেজ। নাসিমা দেখলে না আবার কি হাঙ্গামা বাঁধাবে! সে অল্পেই অস্থির হয়।

দরোজা খুলে দিল শফিক সাহেবের চৌদ্দ বছরের মেয়ে মিলি। সে বাবাকে দেখেই চোখ বড়বড় করে বলল, বাবা তোমার কপালে ব্যান্ডেজ কেন? এই একটু ব্যাথা পেয়েছি আজকে। আগে ঘরে ঢুকতে দে, তারপর সব বলছি। মিলি এক দৌড়ে পাশের ঘরে চলে গেল, মা মা ,বাবা যেন কত্থেকে কপাল ফাটিয়ে এসেছে। নাসিমা সাথে সাথে ছুটে এলেন, একি, কি হয়েছে তোমার? আর বোলো না, রাস্তা পার হতে গিয়ে রিক্সার সামনে পরে গিয়েছিলাম।

তেমন কিছু হয়নি। কপাল একটু কেটে গেছে এই যা। কই দেখি দেখি... ইসস। আহা, এত অস্থির হয়ার দরকার নেই। তেমন সিরিয়াস কিছু নয়।

বেশী ব্যাথা পেয়েছিলে বাবা? মিলি জিজ্ঞেস করল। নাহ তেমন না। হু, কপাল কেটে গেছে, আর তিনি ব্যাথা পাননি। নাসিমা ফোস করে উঠলেন। সত্যি বলছি।

যখন পরে গিয়েছিলাম তখন কিছুটা ব্যাথা লেগেছিল। কিন্তু এখন আর ব্যাথা ট্যাথা লাগছে না। এত অসাবধান হয়ে পথ চললে হবে!! বেশ, এখন থেকে আরও সাবধান থাকব। তুমি এবার জলদি খেতে দাও দেখি। হাত মুখ ধুয়ে এসো।

শফিক সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক অল্পেই বাচা গেছে। মিলি তখনও চোখ বড় বড় করে বাবার কপালের ব্যান্ডেজ দেখছে। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ সারা দিন কি কি করলে মা? আমি আর কি করব? আমি তো সারা দিন ঘরেই থাকি। এখন কি করছিলে? ছবি আঁকছিলাম।

কিসের ছবি, নিয়ে এসো তো দেখি। আনছি। মেয়ে খুশি মনে ছবি আনতে চলে গেল। শফিকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার মেয়েটা দেখতে পরীর মত হয়েছে।

যত দিন যাচ্ছে মেয়েটা আরও সুন্দর হচ্ছে। কেউ যদি ওর পায়ের দিকে না তাকায় তাহলে বুঝতেই পারবে না ও প্রতিবন্ধী। জন্মের সময় কি এক জটিলতায় ওর বাম পা’টা অকেজো হয়ে গেছে। ওর ব্রেনেও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। মেয়েটার বয়স চৌদ্দ হল, দেখলে আরও বড় মনে হয়, কিন্তু বুদ্ধিমত্তা বিকাশ হয়নি।

ওর আচার আচরন কথাবার্তা সবই শিশুর মত। মেয়েকে তিনি স্কুলে দিতে পারেননি। এই ধরনের বাচ্চাদের জন্যে আলাদা স্কুল আছে, কিন্তু সেরকম কোন জায়গায় মেয়েকে পড়ানোর সামরথ তার নেই। মেয়েটা সারা দিন বাসায়ই থাকে। নিজের কাজকর্ম প্রায় কিছুই সে নিজে করতে পারে না।

খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে গোসল পোশাক পাল্টানো প্রায় প্রতিটি কাজেই মায়ের সাহাজ্য লাগে। মেয়েটার বড় শরীরে একটা বাচ্চা শিশু আকুপাকু করছে। মিলি ছবি নিয়ে এসেছে। সে হাতির ছবি এঁকেছে। মেয়েটা ছবি বড় ভাল আঁকে।

* ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। মোমবাতি জ্বেলে শফিক সাহেবরা খেতে বসেছেন। খাওয়ার আয়োজন সামান্যই। ভাত, বেগুন ভর্তা আর ডাল। মিলিকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে তার মা।

সে বেগুন খেতে চাইছে না। তার মা জোর করে মুখে গুজে দিচ্ছে। মেয়ে একরাশ অভিযোগ চোখে নিয়ে বাবার দিকে তাকাল। বাবা, বেগুন খেলে আমার বমি আসে। আমি কিন্তু এক্ষুনি বমি করে ফেলব।

নাসিমা বললেন, এখন কষ্ট করে খেয়েনে, কাল তোর বাবা ভালো কিছু বাজার করে আনবে। তুমি কালও এই কথাই বলেছ। মিলি মুখ কুচকে ফেলল। শফিক চুপচাপ খেয়ে চলেছেন। সব কিছু তার কাছে আজ আলাদা লাগছে।

কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। এই যে তিনি ডালে ভাত মাখিয়ে মুখে পুরছেন, নাসিমা কোমড়ে শারি পেঁচিয়ে মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে, মিলি বাচ্চাদের মত হাত পা ছুড়ছে, মোমবাতির শিখা কাঁপছে; কত পরিচিত কিছু দৃশ্য, কত পরিচিত কিছু অনুভূতি। এই দৃশ্যগুল আর খুব বেশী দিন তিনি দেখতে পাবেন না! মিলি তার মাকে ঠেলে বলল, মা দেখ বাবা কাঁদছে। এই কি হল আবার তোমার? নাসিমা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন। আরে কিছু না, আজ বোধ তুমি ভর্তায় ঝাল বেশী দিয়ে ফেলেছ।

চোখে পানি এসে গেছে। শফিক তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেললেন। কই, ঝাল তো ঠিকই আছে। আচমকা শফিকের বেদম কাশি পেয়ে গেল। কাশির দমকে মুখের থেকে কিছুটা খাবার ছিটকে বের হয়ে এল।

একি, গলায় খাবার আটকে গেল নাকি। নাসিমা আঁতকে উঠলেন। শফিক কোন মতে উঠে দারিয়ে বাথরুমে ছুটে গেলেন। কাশির চোটে মনে হচ্ছে ফুসফুসটা ছিড়ে যাবে। কাশতে কাশতে তার বমি এসে গেল।

বাথরুমের মেঝে ভাসিয়ে তিনি বমি করে ফেললেন। ভিত চোখে তিনি দেখলেন বমির সাথে অনেকটা রক্ত মিশে আছে। * গভির রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে শফিক সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। গলাটা শুকিয়ে গেছে।

ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ফেললেন। তবুও তার পিপাসা মিটল না। শফিক উঠে গিয়ে বারান্দায় বসলেন। ঘোরের সাথে এক চিলতে বারান্দা। বাসার সামনের ড্রেনে প্রায় প্রতি দিনই বিড়াল মরে পচে থাকে, সেই পচা গন্ধ এমনকি এই চার তলার উপরের বারান্দা অব্দি পৌঁছে যায়।

আজ অবশ্য পচা গন্ধ শফিক সাহেবকে তেমন বিচলিত করল না। তিনি ঠাণ্ডা মেঝেতে পা ছরিয়ে বসলেন। স্বপ্নটা মাথা থেকে সরাতে পারছেন না। তিনি প্রথমে দেখলেন এক দল সাদা পাঞ্জাবি পরা লোক তাকে হাতে উদ্যত ছুরি নিয়ে তাড়া করছে, হাতে পেলে জবাই করে ফেলবে। প্রান হাতে নিয়ে তিনি ছুটছেন।

এরপর দেখলেন ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক মেখে তার মেয়ে আর স্ত্রি গভির রাতে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে আছে। মিলি থাকতে চাইছে না, নাসিমা তাকে জোর করে ধরে রেখেছে। তারা খদ্দেরের অপেক্ষায় আছে। শফিকের বুক কেঁপে উঠল। অসুখের কথা কাউকে জানানো যাবে না।

নাসিমা শুধু শুধু ব্যস্ত হবে। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে টাকা যোগারের চেষ্টা করবে। যদিও ডাক্তার এক রকম বলেই দিয়েছে এখন আর চিকিৎসা করে কোন লাভ নেই, নাসিমা তবুও শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে। সে সহজে হাল ছারার মত মেয়ে নয়। সেদিক থেকে শফিক অনেকখানি বাস্তববাদি।

তিনি মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিতে চাইছেন। ক্যান্সারের চিকিৎসা করার মত টাকা তার নেই। তিনি যেই চাকরি করতেন তাতে আরও একশ বছর কাজ করেও তিনি এত টাকা যোগাড় করতে পারবেন না। গেল মাসে নাসিমার ডেঙ্গু হয়েছিল। তার চিকিৎসা করতে গিয়ে জমানো টাকা সব শেষ হয়ে গেছে, শেষে কিছু দিন পরিচিত মানুষের কাছে হাত পেতে চালাতে হয়েছিল।

তাদের এমন কোন বড় লোক আত্মীয় নেই। সত্যি বলতে কি, বড়লোক তো দুরের কথা তাদের কাছের কোন মধ্যবিত্ত আত্মীয়ও নেই। শফিক ছোট কালেই বাবা মাকে হারিয়েছেন। তার আর কোন ভাইবোন নেই। বড় হয়েছেন দূর সম্পর্কের এক চাচার বাসায়।

চাচি তাকে দেখতে পারতেন না। ঠিক এইচএসসি পরিক্ষার আগের রাতে তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হল। এরপর আর তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখেননি। নাসিমার অবস্থাও খুব একটা আলাদা নয়। নাসিমার বড় ভাই কাজকর্ম কিছুই করে না।

থাকে তার শশুর বাড়িতে। বেচারা একেবারেই মেরুদণ্ডহিন। সারা দিন ঘরের সব কাজ করেন আর কাজের লোক থেকে শুরু করে বাসার সবার গালাগালি শোনেন। মাঝে মধ্যেই তিনি সফিকের কাছে ফোন করে টাকা পয়সা ধার চায়। নাসিমার আরেক ভাই অল্প বয়েসে লন্ডনে চলে গিয়েছে।

তারপর আর পরিবারের কোন খোজ খবর রাখেনি। অনেক সময় নিয়ে চিন্তা করেও শফিক এমন কোন আত্মিয়ের নাম মনে করতে পারলেন না যার কাছে নাসিমা ও মিলি আশ্রয় নিতে পারে। নাসিমার পরাশুনা খুব বেশী দ্যর নয়। তার অনুপস্থিতিতে ভদ্র কোন উপায়ে জিবিকা উপার্জন নাসিমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। সম্পূর্ণ তার উপর নির্ভরশীল এই মানুষ দুটোকে তিনি কার কাছে দিয়ে যাবেন! কি হবে তাদের! মরতে শফিক ভয় পাননা।

কিন্তু নিজের স্ত্রি সন্তানকে অনিশ্চিতের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে তিনি কিভাবে বিদায় নেবেন!! ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সেই অদ্ভুত মায়াময় আলোর প্রথম স্পর্শের সাথে সাথে শফিক সাহেব সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন। সাথে সাথে শফিকের নিজেকে অনেকটা নির্ভার মনে হল। তিনি এখন জানেন তার পরিবারের জন্যে তাকে কি করতে হবে। এবং এটাই সবচে ভালো সমাধান।

* আগের সময়েই রুটিন মাফিক শফিক সাহেব অফিসে যাবার জন্যে তৈরি হলেন। নাসিমাকে চাকরি হারানোর কথা বলেননি। কি দরকার শুধু শুধু তাকে চিন্তায় ফেলার। ঘর থেকে বের হয়ার আগে মিলি এসে তাকে ধরল, বাবা আজ আমি একটু ছাদে যাব। মা কে বলেছিস? মা’কে বললে যেতে দেবে না’তো।

যা মা’কে ডেকে আন। আমি বলে দিচ্ছি। মিলি চলে যেতে শফিক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। মেয়েটা সারা দিন বাসায় ছটফট করে। ওর ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ।

কিন্তু মেয়েকে তিনি তেমন একটা বাসার বাইরে নিয়ে যেতে পারেন না। প্রতিবন্ধী একটা মেয়ে, তাকে বাড়ির বাহির করা বড় ঝামেলা। মেয়ে আগে সারা দিন বারান্দায় বসে থাকতো। ইদানিং সেটাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। মিলির মন শিশুর মত রয়ে গেলেও তার শরীর থেমে থাকেনি।

ওকে দেখে বরং বয়েসের চেয়েও কিছুটা বড় মনে হয়। আর মেয়ের রুপ যেন ফেটে পড়ছে। শফিক এবং নাসিমা দুজনেরই গায়ের রঙ কালো। কিন্তু মেয়েটা যে কিভাবে এত রূপবতী হল! পাড়ার ভদ্র অভদ্র সব ধরনের ছেলেরাই বাসার সামনে সারা দিন ভিড় করে থাকে। এমনকি বয়স্ক দুই চারজনকেও ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়।

মিলি বারান্দায় গেলেই তারা হই হই করে উঠে, কেউ কেউ কুৎসিত মন্তব্য করে। মিলি তার সিমাবদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে কিছুই বুঝতে পারে না। সে নিচের মানুষ দেখে হাত নাড়ে, তাদের সাথে কথা বলে। বখাটেগুলোর কুৎসিত মন্তব্যের উত্তরে সে সরল ভাবে জবাব দেয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবেন ঠিক করতে পারলেন না শফিক।

আনমনে প্রতিদিনের মত অফিস যাবার বাসে উঠে বসলেন। আজ রাস্তায় জ্যাম কম। অল্প সময়েই অফিসে পৌঁছে গেলেন। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে শফিক অফিসের গেটের দিকে তাকিয়ে আছেন। কত মানুষ ঢুকছে বেরুচ্ছে।

কিন্তু আজ আর তার ভেতরে যাবার অধিকার নেই। শফিকের প্রাক্তন বস নাজিম সাহেবের গাড়ি এসে থামল। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে বস গাড়ি থেকে বের হলেন। শফিকের হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল। এই লোকটা সম্পূর্ণ বিনা দোষে তাকে চুরির অপবাদ দিয়ে চরম অপমান করে অফিস থেকে তারিয়েছে।

শফিক সোজা তার বসের সামনে হেটে গিয়ে তার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। তারপর কিছু না বলে বসের বাম গালে সর্বশক্তি দিয়ে একটা চর কষলেন। নাজিম সাহেব গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। গেটের দারোয়ান হাহা করে ছুটে এল। শফিক আর দাঁড়ালেন না।

মাথা নিচু করে দ্রুত সরে পড়লেন। তার বুকের ভেতরটা এখন বেশ শান্তি শান্তি লাগছে। অফিস থেকে এবার শফিক গেলেন মার্কেটে। গত দুই ঈদে মেয়েকে কিছুই দিতে পারেননি, আর নাসিমাকে শেষ কবে একটা নতুন শারি কিনে দিয়েছেন মনেও পরে না। আজ বাসা থেকে ঠিক করে এসেছেন যত কম দামিই হোক, আজ তাদের দুই জনের জন্যে কিছু জামা কাপর কিনে নিয়ে যাবেন।

শফিক সাহেবের আজ ভাগ্য ভালো। অল্প টাকার মধ্যেই তিনি নাসিমার জন্যে ঘিয়া রঙের একটা শারি পেয়ে গেলেন। এই রঙে নাসিমাকে চমৎকার মানায়। মিলির কামিজ কিনতে গিয়ে কিছুটা সমস্যায় পরতে হল। একে তো পোশাকের মাপ জানেন না, তার উপর সব কিছুরই আগুনের মত দাম।

একটা নিল রঙের ড্রেস পছন্দ হল। যে পুতুলটাকে পরিয়ে রেখেছে সেটাকেই অপূর্ব লাগছে। আর তার মেয়ে পরলে তো একেবারে প্রতিমার মত দেখাবে। দাম লেখা আছে ১৮০০। তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন ৫০০।

দোকানি তার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল। তারপর কি মনে করে ৬০০ টাকায় দিয়ে দিল। শপিং শেষে শফিক সাহেব একটা পার্কে গিয়ে বসলেন। দুপুরের রোঁদ চড়েছে। এখন আর পথে পথে হাঁটাহাঁটি না করাই ভালো।

এক প্যকেট ঝাল মুড়ি কিনে নিলেন। সেই ঝাল মুড়ি মুখে দিতেই তার তিব্র কাশি শুরু হল। কাশতে কাশতে শফিক বেঞ্চের উপরই জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান ফিরলে শফিক দেখতে পেলেন তিনি বেঞ্চের উপর শুয়ে আছে। টোকাই কিসিমের একটা বাচ্চা ছেলে তাকে আগ্রহ নিয়ে দেখছে।

সাথে বাসার জন্যে কেনা জামাকাপরগুলো কিছুই নেই। শফিক সাহেবের বিশেষ দুঃখ বোধ হল না। শুধু এক অসম্ভব শুন্যতা তাকে চেপে ধরল। সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কের বেঞ্চে ঝিম ধরে বসে রইলেন। সূর্য ডুবে গেছে।

আধার বাড়ার সাথে সাথে পতিতা ও মাদকাসক্তের দল একটু একটু করে ভিড় জমাচ্ছে। শফিক সাহেব উঠে পড়লেন। পার্ক থেকে হেটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন এই সময় কানে আসল, চাচা স্লামালেকুম। শফিক ফিরে দেখলেন দেয়ালে হেলান দিয়ে মিরাজ তার দিকে তাকিয়ে আছে।

তার ঠোঁটে জলন্ত সিগারেট। মিরাজ সিগারেটটা মাটিতে ফেলে বলল, চাচা ভালো আছেন? জি ভালো। সালামের উত্তর দিলেন না? জি ওয়ালাইকুম সালাম। চাচার বাসার সবাই ভালো? জি ভালো। আপনার মেয়েটাকে আর বারান্দায় দেখি না।

ঘরের মধ্যে আটকে রাখেন নাকি? না, আটকে রাখব কেন। হুম, ঘরের বাইরে টাইরে যেতে দেবেন। বাচ্চা মানুষ, ঘরের মধ্যে আটকে রাখলে আরও বেশী করে পাগলামি করবে। শফিক সাহেব দাঁতে দাঁত ঘষলেন। মিরাজ এই এলাকার উঠতি মাস্তান।

সে এক বার নিচ থেকে ঢিল মেরে মিলির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। আরেক বার মিলির মায়ের হাতে একটা খাম দিয়ে বলেছিল মেয়েকে দিতে। নাসিমা সেটা অবশ্যি মেয়েকে দেননি। তবে নিজে খুলে দেখেছেন ভেতরে একটা ব্যবহার করা কনডম। শফিক রাস্তা থেকে একটা ইট তুলে নিলেন।

চাচা কি করেন? মিরাজ ঘাবড়ে গেল। শফিক কোন কথা বললেন না। তিনি ভারি ইট দিয়ে মিরাজের মাথায় সর্ব শক্তি দিয়ে আঘাত করলেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। বাবা গো... মিরাজ মাথা চেপে মাটিতে বসে পরল।

ইট ফেলে শফিক বাড়ির পথ ধরলেন। * শফিক সাহেব সবার সাথে অনেক আনন্দ নিয়ে রাতের খাবার খেলেন। খেতে বসে মজার কিছু গল্প বললেন। নাসিমা হাসতে গিয়ে পানির গ্লাস উলটে ফেলল। মিলি গল্পগুলো বুঝতে পারল না।

কিন্তু মাকে দেখে সেও খুব হাসল। আজ সবাই একটু দেরি করেই ঘুমাতে গেল। নাসিমা মেয়েকে নিয়ে এক ঘরে ঘুমান, শফিক আরেক ঘরে ঘুমান। আজ অনেক দিন পরে তার স্ত্রীকে পাশে নিয়ে বিছেনায় যেতে মন চাইল। মিলি ঘুমিয়ে গেলে তিনি স্ত্রীকে ডেকে তুললেন।

নাসিমা অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। বহু দিন তারা আর এসব করেন না। অনেক দিন পর আজ মনে হল আবার সেই সোনালি সময়ের একটা রাত ফিরে এসেছে। ** গভির রাতে শফিক সাহেব বিছেনায় উঠে বসলেন। সবাই গভির ঘুমে মগ্ন।

নিঃশব্দে তিনি বিছানা ছেরে উঠে দাঁড়ালেন। কেউ যেন টের না পায় এভাবে তিনি অত্যন্ত সাবধানে ঘরের দরোজা জানালা শক্ত করে বন্ধ করলেন। রান্না ঘরে কেরসিন ভর্তি বড় একটা গ্যালন ছিল। সেটা তুলে নিলেন। এটাই এক মাত্র উপায়।

এই ভয়ঙ্কর পৃথিবীতে তিনি কিছুতেই তার পরিবারকে একা ফেলে রেখে যেতে পারেন না। পৃথিবীতে তার পরিবারের তিনিই একমাত্র অবলম্বন। তাদের রক্ষা করার আর কেউ নেই। তার মৃত্যুর পর এই পৃথিবী তার প্রতিবন্ধী মেয়ে ও রুগ্ন অসহায় স্ত্রীকে খুবলে খাবে। তিনি সেটা হতে দিতে পারেন না।

শফিক সাহেব সারা ঘরে কেরোসিন ছরিয়ে দিলেন। তারপর শান্ত ভাবে একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বাললেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।