আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রদ্ধেয় জাফর স্যারের লেখা নিয়ে

মুহাম্মদ জাফর ইকবাল একজন লেখক। তার গবেষক,শিক্ষক,বুদ্ধিজীবী পরিচয়ের বাইরে যে পরিচয়টা সবার কাছে মুখ্য,সেটি হচ্ছে তিনি একজন লেখক। এদেশের তরুণদের একটি বড় অংশ তার লেখনীতে প্রভাবিত। স্বাভাবিকভাবেই তার কাছ থেকে এদেশের আপামর জনসাধারণ দায়িত্বশীল লেখা-দিকনির্দেশনা প্রত্যাশা করে। শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যারের লেখনী এদেশের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করে-সন্দেহ নেই।

তার নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম নিয়ে আমি কোন প্রশ্ন তুলছিনা। পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে লেখা তার কলামগুলোতে দেশের জন্য প্রচ্ছন্ন যে ভালবাসার প্রকাশ ঘটে তা এককথায় অতুলনীয়। কিন্তু তারপরও একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষ কখনো শতভাগ একমত হতে পারেনা। হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে মুহাম্মদ(সঃ) এর সাথে দ্বিমত পোষণ করার মত সাহাবীও পাওয়া গিয়েছিল। শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবালের সাথেও সববিষয়ে আমি শতভাগ একমত নই।

কিছু মতদ্বৈততা আছে বৈ কি! শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল তার সাম্প্রতিক একটা লিখায় বলেছেন- "বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছেলেমেয়েরা ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেছিল। আমি আর আমার স্ত্রী সেটা দেখতে গিয়েছিলাম। বড় বড় ছবি দেখতে দেখতে আমার স্ত্রী আমাকে বলল, ‘একটা জিনিস লক্ষ করেছ?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী জিনিস? আমার স্ত্রী বলল, ‘ভাষা আন্দোলনে কত মেয়ে! কিন্তু একটি মেয়েও বোরকা পরে নেই, একটি মেয়েও হিজাব পরে নেই। ’ আমি তাকিয়ে দেখি, তার কথা সত্যি। ষাট বছর আগে এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের বোরকা পরতে হতো না, এখন মেয়েদের বোরকা পরতে হয়।

ষাট বছর আগে এ দেশের মেয়েরা ধর্মহীন ছিল, এখন মেয়েরা ধর্মভীরু হয়ে গেছে—আমি সেটা বিশ্বাস করি না। যাঁরা জ্ঞানীগুণী গবেষক, তাঁরা প্রকৃত কারণটি খুঁজে বের করবেন। আমি সোজাভাবে বিষয়টি এভাবে দেখি, যে সমাজে পুরুষ আর নারী সমান সমানভাবে পাশাপাশি থেকে কাজ করে, সেই সমাজকে মৌলবাদীদের, ধর্ম ব্যবসায়ীদের খুব ভয়। তাই মেয়েদের ঘরের ভেতর আটকে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভালো। একান্তই যদি ঘরের ভেতর আটকে রাখা না যায় অন্তত বোরকার ভেতর আটকে রাখা যাক।

" দেখুন আমি মৌলবাদের ঘোর বিরোধী। মেয়েদের ঘরের ভিতর আটকে রাখার ব্যাপারেও আমার প্রবল আপত্তি রয়েছে। মেয়েরা ছেলেদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে,এমন কল্পনার রঙ আমার মনকেও রঙ্গিন করে তোলে। একটি মধ্যরক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠার কারণে গান বাজনার প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকার পরও তা শিখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিতর্ক করার সৌভাগ্যও আমার হয়নি।

নিজে বঞ্চিত হয়েছি বলেই সুযোগ পেলেই অন্যদের উৎসাহিত করি। আমার বোনের ছোট্ট ফুটফুটে যে মেয়েটি আছে,তাকে শিল্পকলা একাডেমীতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। স্বপ্নদেখি একদিন সে ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে বিতর্ক করবে। বয়ে আনবে পুরস্কার আর সুনাম। লক্ষ্য করুন মেয়েটি বড় হয়ে বখে যাবে এমন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।

ছেলেদের থেকে পিছিয়ে নয়,বরং সে এগিয়ে থাকবে-এটাই আমার প্রত্যাশা। তাই বলে বোনের মেয়ে বড় হয়ে জিন্স-ফতুয়া পড়বে,এটাও কি আমার প্রত্যাশার মধ্যে পড়ে?কখনোই নয়। কিন্তু কেন নয়?ব্যাপারটা খোলাসা করে বলা যাক। প্রথমেই আমার পরিচয় আমি একজন মানুষ। মুনির চৌধুরীর রচিত সেই "মানুষ"।

তারপরের পরিচয় আমি ধর্মে বিশ্বাসী-ধার্মিক। আমি মুসলমান। আর মুসলিম হিসাবে ইসলামের নীতি নিয়মগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা রাখা আমার নৈতিক দায়িত্ব। ইসলাম মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে কী বলেছে?এক কথায় বললে লজ্জাস্থানগুলোকে সংযত করতে বলা হয়েছে। কোনটি মেয়েদের লজ্জাস্থানগুলোকে অধিক আবৃত করে রাখে?জিন্স-ফতুয়া নাকি হিজাব?সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের ঘাড়ে।

আচ্ছা হিজাব পড়ে কি আধুনিক হওয়া যায়না?পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা যায়না?আমরা সবাই কমবেশী জানি যে ইরানে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করা হয়। চলুন দেখি বোরকা পরিহিত ইরানের মেয়েরা কেমন আছে। ১। উইকিপিডিয়া ঘেঁটে জানা যায়,২০০৭ সালের হিসাব মতে ইরানের বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীদের শতকরা ৭০ভাগই নারী। ২।

ইউনেসকোর হিসাব মতে ইরানের প্রাইমারী স্কুলগুলোতে ছেলে মেয়ের অনুপাত ১:১,২২!! ৩। ইরানের মোট শ্রম শক্তির ৩০ ভাগই নারী। ৪। মন্ত্রীদের শতকরা ২৭ভাগের বেশী নারী(শতকরা হিসাবে ১২৫টি দেশে ২৩ তম) ৫। দেশের লিগ্যাল এফেয়ার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্টের অন্যতম উপদেষ্টা হিসাবে ২০০৯ সালে নির্বাচিত হন একজন নারী-নাম ফাতেমা বোডাঘাই।

৬। প্রেসিডেন্টের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা হলেন মারিয়াম মোজতাহিদজাদেহ। তিনি একি সাথে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। ৭। ইরানের পুলিশ বাহিণীর একটা অংশ নারী(ছবি সংযুক্ত) ৮।

পর্দার ভিতরে থেকেই ইরানের নারীরা আন্তর্জাতিক ক্রিড়াংগনে সাফল্য লাভ করছে। অতএব বুঝতেই পারছেন সমস্যা আসলে পোশাকে নয়। সমস্যা আসলে শাসনযন্ত্রে,আমাদের মনে। ইরান তার নারীদের ব্যবহার করতে পারছে,যেখানটায় আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। হিজাব যে নারীর অগ্রযাত্রায় অন্তরায় নয়,আরেকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিস্কার হবে।

ইরানের বোরকা পরিহিত নারীদের সাথে তথাকথিত অপেক্ষাকৃত আধুনিক পাকিস্তানের নারীদের মানসিকতার পার্থক্য বলতে গিয়ে রবার্ট কাপলান বলেছেন- "In Iran you could point a camera at a woman and she would smile.If you did that in Pakistan the woman would run away and a man might through a rock at you" (সূত্রঃউইকিপিডিয়া) তাহলে আপনারাই বলুন কারা মানসিকভাবে এগিয়ে?পাকিস্তানের আধুনিক পোশাকের নারী নাকি ইরানের বোরকা পরিহিত রমণী? বোরকার একচেটিয়া সাফাই গাওয়া আমার উদ্দেশ নয়। আমার লেখার উদ্দেশ এটাই বুঝানো যে সমস্যা আসলে পোশাকে নয়,সমস্যা দৃষ্টিভংগীতে। অতএব আমাদের নারী সমাজকে আক্ষরিক অর্থে আধুনিক দেখতে চাইলে তাদের পোশাক নয়,দৃষ্টিভংগীতে পরিবর্তন আনার উদ্যেগটা আগে নিতে হবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.