আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পৌর মেয়র লোকমান হত্যা

মন্ত্রীর আশ্রয়ে-প্রশয়ে লালিতদের ভাড়াটে কিলাররাই নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যা মামলার তদন্ত শুরুর পরপর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অন্তত পাঁচ পেশাদার কিলারকে শনাক্ত করতে পেরেছেন। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে বলেও দাবি করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা জেলা ডিবি ইন্সপেক্টর মামুনুর রশিদ। ঘটনার সময় লোকমান হত্যা মিশনে সরাসরি গুলি ছোড়ার কাজে অংশ নেয় ওই পাঁচ পেশাদার কিলার। তারা মাত্র ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে গুলি চালিয়ে নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

এ হত্যা ঘটনায় এই পাঁচ কিলার ছাড়াও বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী অংশ নেয়। তারা ঘটনাস্থলে না এলেও কিলারদের দূর থেকে ব্যাকআপ দেয়। পাঁচ কিলারকে ব্যাকআপ দিতে বাকি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা দুই ভাগ হয়ে সদর রোডের মহিলা কলেজমুখী গলির মোড়ে এবং উল্টো দিকের ডন ফার্মেসি-ঘেঁষা গলির মুখে অবস্থান নেয়। এখানেই শেষ নয়। এই কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া একটি গ্রুপ হত্যা ঘটনার ঠিক আগমুহূর্তে মেয়র লোকমানের সঙ্গে ছিল।

এরা মূলত খুনের মদদদাতাদের একটি অংশ। এরা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মেয়র লোকমানকে ঘিরে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন এমনভাবে, যেন কেউ তাদের কোনো রকম সন্দেহ না করে। তাদের নিয়ে মেয়র লোকমান যখন আলাপ-আলোচনায় মগ্ন, ঠিক এমন মুহূর্তে কার্যালয়ের দরজায় হাজির হয় পাঁচ পেশাদার কিলার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা অতর্কিত গুলি চালাতে থাকে। মাত্র ৪০ সেকেন্ড অবস্থান করে অপারেশন শেষে কিলাররা নির্বিঘ্নে সটকে পড়ে।

সরেজমিন অনুসন্ধান, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও তদন্তকারী গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে ঘটনাস্থল থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া মোটরসাইকেলের সূত্র ধরে এরই মধ্যে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কিলারদের নাম-ঠিকানা শনাক্ত করতে পেরেছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে তা তারা প্রকাশ করতে রাজি হননি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মূল কিলারদের অবস্থান শনাক্ত করতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে সব আসামিকে শিগগিরই গ্রেপ্তার তারা সক্ষম হবে বলে জানিয়েছে।

জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একাধিক গোয়েন্দা দল খুনিদের গ্রেপ্তারে ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছে। খুনি যে বা যারা হোক, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে তদন্ত কার্যক্রমের সবকিছুই চলছে সীমাহীন গোপনীয়তায়। বাদী কামরুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও প্রত্যক্ষদর্শী কারও সঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা : মেয়র লোকমান মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে সাটিপাড়া এলাকায় জনৈক বারেক মিয়ার মৃতদেহ দেখে শহরে ফিরে সরাসরি সদর রোডের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে যান।

তখন তার সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া, জেলা নেতা আমিনুল ইসলাম, শহর সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, কর্মী লিয়াকত, জেলা যুবলীগ সভাপতি একরামুল ইসলামসহ ১০-১২ জন। এস এম কাইয়ুমসহ আরও ১৫-১৬ জন মেয়রের সঙ্গে থাকলেও তাদের বারেক মিয়ার মৃতদেহ সৎকারে সহযোগিতা করতে জন্য সাটিপাড়ায় পাঠিয়ে দেন মেয়র। রাত সাড়ে ৮টার দিকে হঠাৎ পিস্তল উঁচিয়ে কয়েকজন কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা মেয়রকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন মেয়র লোকমান।

প্রত্যক্ষদর্শী নরসিংদী রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারী এস এম মিজান বলেন, তিনি জমি-সংক্রান্ত কাজে মেয়রের সঙ্গে কথা বলতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরই মধ্যে একজন এবং তার ঠিক পেছনে আরও দুজন এসে কার্যালয়ের দরজা ঘিরে দাঁড়ায়। তাদের সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সবচেয়ে সামনে থাকা আততায়ী সরাসরি মেয়রকে লক্ষ্য করে পর পর দুটি গুলি করে। চার-পাঁচ সেকেন্ড ব্যবধানে পেছনের দুজনও অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে।

প্রত্যক্ষদর্শী মিজান বলেন, 'আত্মরক্ষার্থে আমি পাশেই সদর রোডে নেমে পড়ি। এ সময় চার-পাঁচজন যুবককে দৌড়ে পালাতে দেখি। ' যা আছে এজাহারে : লোকমান হত্যার ঘটনায় টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাউদ্দিনসহ ১৪ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পর শুক্রবার রাত ১১টার দিকে সদর থানায় মামলা করেন লোকমানের ছোট ভাই কামরুজ্জামান। বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন, মেয়র লোকমানের রাজনৈতিক উত্থান ও অসম্ভব জনপ্রিয়তা দেখে কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন।

প্রায়ই তারা লোকমানকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করতেন এবং টেলিফোনেও বিভিন্ন সময় হুমকি দিতেন। আওয়ামী লীগের জেলা সম্মেলন সামনে রেখে লোকমান সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছিলেন। অন্যদিকে টেলিমন্ত্রী রাজুর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু একই পদে প্রার্থী হিসেবে প্রচারে নামেন। কিন্তু কর্মী-সমর্থকদের কাক্সিক্ষত সমর্থন না পেয়ে লোকমানকে হত্যা করে তিনি পথের কাঁটা দূর করার পরিকল্পনা আঁটেন। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের অপর দুই নেতা আবদুল মতিন সরকার ও তারেক আহমেদ বিগত পৌরসভা নির্বাচনে লোকমান হোসেনের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন।

একপর্যায়ে তারাও মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চুর সঙ্গে জোট বাঁধেন। এ দুই নেতাও নিয়মিতভাবেই লোকমানকে হুমকি দিতেন এবং তাকে কঠিন শিক্ষা দেবেন বলে ঘোষণা দিয়ে বেড়াতেন। বিভিন্ন সময় হুমকি দেওয়াসহ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই মেয়র লোকমানকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বাদী। কে কে আসামি : লোকমান হত্যা মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হচ্ছেন যথাক্রমে টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব মাসুদুর রহমান মুরাদ, জেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকার, শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, সদর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মিয়া মো. মঞ্জুর, শহর যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন সরকার, মোবারক হোসেন, মনোয়ার হোসেন খান, হিরণ মিয়া, তারেক আহমেদ, কবীর সরকার, আজিজ মিয়া ও মামুন। বাদীপক্ষ যদিও বলছে এজাহারভুক্ত আসামিরা আশপাশের এলাকাতেই অবস্থান করছেন, তবে পুলিশ বলছে, আসামিদের কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না।

মৃত্যুকালীন ঘোষণা : গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সংকটাপন্ন অবস্থায় যারা অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নিয়ে যান, তাদের কাছে মৃত্যুকালীন ঘোষণায় খুনিদের ব্যাপারে বলে গেছেন লোকমান। কিন্তু গোয়েন্দা তদন্তে এখনো সেসব বিষয় পাত্তা পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে অবস্থানকারী ছোট ভাই মাহফুজুল হক সোহেল বলেন, 'গুলিবিদ্ধ লোকমানকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে অন্যদের সঙ্গে আমিও রওনা হই। পথে লোকমানের অবস্থার অবনতি হয়। এ সময় লোকমান ইশারায় ছোট ভাই কামরুজ্জামানকে ডেকে কাছে নিয়ে সবকিছু বলে যান।

সব জানা থাকা সত্ত্বেও মুখ খুলতে পারছি না। ' কান্নাজড়িত কণ্ঠে সোহেল বলেন, 'কারা লোকমান হত্যায় জড়িত তা এর মধ্যেই প্রশাসন জানতে পেরেছে। এখন তাদের উচিত দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করা। ' বাদী কামরুজ্জামান বলেন, 'মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে মেয়র লোকমান তার হত্যায় কে কে জড়িত তা বলে গেছেন। এর কিছু বিষয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি, মামলার তদন্তে তাদের এগুলো বেশ কাজে দেবে। ' লোকমানের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর এস এম কাইয়ুম বলেন, 'বরাবরই মেয়র লোকমান ও আমি টেলিমন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর হুমকির মুখে ছিলাম। মন্ত্রীর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে যারা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে নরসিংদীতে যাচ্ছেতাই করে বেড়াত, তারাই খুন করেছে লোকমানকে। ' তিনি জানান, মেয়রের ওপর গুলি চালানোর সময় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও এর বাইরে ৩০-৩৫ জন নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তারা কেউ প্রতিরোধের চেষ্টা করেননি।

বরং একাধিক নেতা লোকমানের মুখোমুখি চেয়ার ছেড়ে দিয়ে কার্যালয়ের ভেতর আড়ালে-আবডালে অবস্থান করছিলেন, যাতে লোকমানকে গুলি করতে কিলারদের অসুবিধা না হয়। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কাইয়ুম বলেন, একজন জনপ্রিয় মেয়রকে গুলি করে হত্যা করা হলো, অথচ ঘটনাস্থলে উপস্থিত কাউকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন বোধ করল না! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।