আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবিত শামীম হুড এবং খুন হওয়া লোকমান হুড

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা বাংলা ছবির সরলরৈখিক উপস্থাপন কিংবা কাহিনীর কথিত দুর্বলতা কিংবা অসাঞ্জস্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনুচিত, বাংলা ছবি আমাদের জাতীয় মানসিকতার সবচেয়ে সঠিক চিত্রায়ন। গত দুই দশকে বাংলা ছবিতে উপস্থাপিত সন্ত্রাসবিষয়ক ঘটনাবলী কিংবা সন্ত্রাসীদের সমাজকর্মী এবং আদর্শবাদী হিসেবে চিত্রায়নের বাস্তবতা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করা যায় না। একজন অপরাধী ও একজন ভালো মানুষ এমন একজন নায়ক গরীবের প্রয়োজনে সন্ত্রাস করে, বস্তিতে রবিন হুড সে সন্ত্রাসী তার লুণ্ঠিত সম্পদ বস্তির ছেলেবুড়োকে বিলিয়ে দিয়ে মহামানবে পরিণত এবং পুলিশ আসলে সবাই শ্রদ্ধা ও অনুগ্রহভাজন নিরবতার সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রাখে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিতে লুণ্ঠন এবং অপরাধকে মানবীয় প্রমাণের যে উদ্যোগ থাকে চিত্রনাট্যকারের সেটা পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে অধিকাংশের ভাষ্য হয়ে উঠে, ধনী মাত্রই দুর্নীতিবাজ, অপরাধী এবং অপরাধের উদ্যোক্তা নির্মাণের সময় অন্য কোনো ব্যতিক্রম থাকে না। অবধারিত ভাবেই একজন ধনী অপরাধীকে গরীব অপরাধী ঘায়েল করলে দর্শক সমাজ হাত তালি দিয়ে বলে বেশ হয়েছে, অপরাধীর উপযুক্ত বিচার হয়েছে।

শ্রেণীঘৃণা কিংবা অন্তর্গত হীনমন্যতা এবং প্রতিহিংসাপরায়নতা মিলে মিশে বাঙালী সমাজ মানসের দর্শণে অপরাধ সম্পর্কিত চেতনাগুলো একেবারে দুর্বল, যদিও অপরাধকে বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতায় সামাজিক স্থিরতা নির্মাণের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করা অধিকতর যুক্তিসংগত এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটে এভাবেই অপরাধগুলো চিহ্নিত হয়েছে। সেসব নৈতিকতাবোধের ভিত্তিভুমি স্থানীয় সংস্কৃতি কিংবা ধর্মীয় অনুশাসন, সেসব অনুশাসনের প্রেক্ষিতে যেসব আচরণ অনাচরনীয় বিবেচিত হয়েছে, সে সামাজিক কাঠামোতে সেসব অপরাধই চিহ্নিত হতে হবে- এ যুক্তিটুকু মেনে নিতে অস্বীকার করছে অনেকেই। অপরাধীকে রবিনহুড বানিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াটুকুর বর্তমাণ প্রকট উদাহরণ নরসিংদীর পৌর মেয়র, তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সন্ত্রাসী বাহিনী লালন-পালন এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনার বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই, বরং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সন্ত্রাসীবাহিনী প্রতিপালন না করাটাই যেখানে ব্যতিক্রম বিবেচিত হয় সেখানে লোকমানের ব্যক্তিগত খুনের মামলাগুলো বিরোধী দলের সাজানো নাটক হিসেবে প্রতিহিংসামূলক বলে ফেলাটা সহজ। লোকমান মৃত্যুবরণ করার সাথে সাথেই এইসব মামলার অভিযোগগুলো থেকে তার সম্মানসূচক অব্যাহতি মিলেছে, মৃত ব্যক্তি অপরাধী হলেও তার মৃত্যুকালীন স্মরণসভায় সেসব অপরাধের বৃত্তান্ত তুলে না ধরার অসভ্য লুকোচুরি মানসিকতা আমাদের মজ্জাগত। তিনি নরসিংদীর উন্নয়নে ব্রতী ছিলেন, ব্যপক মাত্রায় দৃশ্যমাণ উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, রাস্তায় প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গোলচত্ত্বর বানিয়েছেন, শহরের বিভিন্ন মোড়ে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন, ড্রেন আর কালভার্ট সংস্কার করেছেন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছেন।

আমাদের সাধারণ নাগরিকের প্রত্যাশার সীমাটা এতটাই নীচে যে পৌর মেয়র হিসেবে তার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন এবং প্রয়োজনীয় স্থাপনা সংস্কার তিনি অব্যহত রেখেছেন বলেই তিনি মেয়র হিসেবে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। সাধারণ মানুষ তাকে রবিনহুড হিসেবেই দেখেছে, তার অপরাধসংশ্লিষ্ঠতা তার জনপ্রিয়তার বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। তারপর পরই মুখ খুলেছেন জনপ্রিয় গডফাদার শামীম ওসমান, তিনি তার স্বভাবজাত ভাষায় সন্ত্রাসের হুমকি দিয়েছেন, এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকালে তার সাথে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় তার সন্ত্রাসী মানসিকতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী সহৃদয় অবগতির কথাও অকপটে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী অবগত ছিলেন যে শামীম ওসমান চাইলেই যেকোনো সময় ভোট বুথ দখল করে নিতে পারতেন কিন্তু তিনি ভোট বুথ দখল না করার উদারতা দেখানোর প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি পাঞ্জাবী খুলে জিন্সের প্যান্ট পরে সবার ঘরে ঘরে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসবেন এমন স্পষ্ট উচ্চারণের পরও তাকে প্রধানমন্ত্রী বিন্দুমাত্র তিরস্কার করেন নি, তিনি বরং শামীম ওসমানের আনুগত্য প্রকাশের ধরণ দেখে মুগ্ধ, সুশীল সমাজ বিরোধিতা করলেও শামীম ওসমান চান জয় এসে রাজনীতির হাল ধরুক, শেখ মুজিব পরিবারের কেউ এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেই শুধুমাত্র তিনি আওয়ামী লীগের অনুগত থাকবেন মানসিকতা আপত্তিকর হলেও প্রধানমন্ত্রীর সনদপ্রাপ্ত প্রিয়পাত্র হিসেবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে শামীম ওসমানদের উত্থান দীর্ঘস্থায়ী হবে।

অপরাধীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতার মহোৎসব চলছে, রাজনৈতিক অপরাধীদের কোনো খুনের শাস্তি পেতে হচ্ছে না বরং তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি করা হচ্ছে, ধুরন্ধর সন্ত্রাসী হাইকোর্টে গিয়ে আপীল করে মামলা বিচারাধীন, এখনও চুড়ান্ত রায় হয় নি সনদ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহন করছেন, নির্বাচন কমিশন জেনে বুঝেও তাদেরই ছাড়পত্র দিতে বাধ্য, আইনের কোমল শেকল সকল অপরাধীদের নির্বিচার অপরাধের ছাড়পত্র দিয়েছে। আমাদের আনুগত্য শুধুমাত্র রাজসিংহাসনের প্রতি, সেখানে যে ব্যক্তিই উপনিবেশ করুক না কেনো আমরা তার আজ্ঞাবহ অনুগত সেবক, কথাটি বলেছিলেন মুঘল সম্রাজ্যের স্থপতি বাবুর, তিনি ৫০০ বছর আগে যা উপলব্ধি করেছিলেন তা এখনও সমান ভাবে সত্য। আমরা ক্ষমতার অনুগত সেবক, সুতরাং শেষ দৃশ্যে কাউকে হত্যার পরপর আমাদের নৈতিকতার শিক্ষকেরা " খবরদার আইন নিজের হাত তুলে নিবেন না" বাক্যটা বলার আগে পর্যন্ত আমাদের অন্য কিছু করণীয় নেই। আমাদের নির্লজ্জতা এই পর্যায়েই পৌঁছেছে, ন্যাংটো ঘুরাঘুরি করলেও বিব্রত হই না, বরং যখন অন্য কেউ এসে বলে "ব্যাটা তুই ন্যাংটা", আমরা লজ্জায় মরে যাই, ক্ষুব্ধ হই। বিদেশী দুতাবাস থেকে এইসব নৈতিকতার সনদ প্রধানমন্ত্রীর সদর দফতর পর্যন্ত পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার নিজের ইমেজ রক্ষার্থে কিছু বলবেন, তার আগে তার প্রতিক্রিয়া আশা করা বৃথা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।