আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালির মধ্যপ্রাচ্য (১৫)

শেখ জায়েদ মসজিদ (?) ২ আগষ্ট রোববার। ঘুম থেকে উঠলাম সকাল ৯টায়। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করলাম। হেভি ধকল যাচ্ছে শরীরের উপর দিয়ে। ২৪ ঘন্টায় ২/৩ ঘন্টার ঘুম খুব একটা যথেষ্ট নয়।

শরীরও মেনে নিচ্ছে না। কিন্তু মনের চাঞ্চল্যের কাছে শরীর তো অসহায়। তাছাড়া গ্রাম্য একটি প্রবাদ বাক্যই তো আছে, “শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়”। আল আইন বাসষ্ট্যান্ড থেকে চেপে বসলাম আবুদাবিগামী বাসে। আগেই বলেছি বাসগুলো চমৎকার।

চমৎকার রাস্তাগুলোও। জার্নিতে কোনো কষ্টই হয় না। ১ ঘন্টা ২৫ মিনিটে আমরা, মানে আমি ও মুছা গিয়ে পৌছলাম আবুদাবি শহরে। আভিজাত্য ও সৌন্দর্যের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে লাগলো আমাদের। যে ব্যাপারটি আমার কাছে ব্যাপকভাবে ধরা পড়লো, তা হচ্ছে, শেখ জায়েদ নামক কোনো এক ব্যক্তির নামে প্রায় সবকিছু।

শেখ জায়েদ রোড, শেখ জায়েদ স্কুল, শেখ জায়েদ ইউনিভার্সিটি, শেখ জায়েদ স্টেডিয়াম, শেখ জায়েদ মসজিদ,শেখ জায়েদ মিউজিয়াম ইত্যাদি। শেখ জায়েদ ছিলেন আমিরাতের ৩৫ বছরের প্রেসিডেন্ট। ২০০৪ সালে বেচারা মারা গেছেন। উনার পুরো নাম ছিল শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে আমরা চলে গেলাম কাঙ্খিত শেখ জায়েদ মসজিদে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সৌন্দর্য দর্শনার্থী মানুষ এসে ভীড় জমায় এখানে, মসজিদটি দেখার জন্য। মসজিদের সিকিউরিটি ইনচার্জ’র সাথে আলাপ করে মসজিদটি সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা দাড় করালাম এভাবে, মসজিদটি নাম শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান মসজিদ। এরিয়া ২২০০০ মিটার। সুচ্চ মিনার রয়েছে চারটি। সর্বোচ্চ মিনারের উচ্চতা ১০৭ মিটার।

নিচেরটা ৩৩ মিটার। মসজিদটির ভেতরে ৭ হাজার এবং বাইরে ৪০ হাজার মুসল্লির একসাথে নামায আদায় করার ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৯৮ ইংরেজি থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ১০ বছরে শেষ হয়েছে মসজিদের ভেতরের কাজ। এতে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২২০০ কোটি ১৬৭ লক্ষ মিলিয়ন দেরহাম! ছোট বড় মিলিয়ে মসজিদটিতে রয়েছে ৭টি ঝাড়। মূল মসজিদের ভেতরে মেহরাবের সামনে উপরের ছাদ থেকে ঝুলে আছে মূল ঝাড়টি।

এটা তৈরিতে খরছ পড়েছে ৩০ মিলিয়ন ২ লক্ষ দেরহাম। বাংলাদেশি টাকায়-------!!! মসজিদের ভেতরের জন্য যে কার্পেট তৈরি হয়েছে সেটা করা হয়েছে ইরানে বিশেষ অর্ডার দিয়ে। ২০ জন ইঞ্জিনিয়ার ২০০ কারিগর নিয়ে তৈরি করেছেন কোনো রকম জোড়া ছাড়া একপিছ কার্পেট। এর’চে উন্নতমানের কোনো কার্পেট পৃথিবীতে নেই। সর্বশ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে এই কার্পেটের পেছনে।

৪৭ টন ওজনের এই কার্পেটটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৩০০ মিলিয়ন দেরহাম। কার্পেটটি আনার সময় ২পিছ করে দুটি বিশেষ বিমানে করে নিয়ে আসা হয়েছে। মসজিদটির সৌন্দর্য বর্ণনা করার দিকে আমি অগ্রসর হব না। কারণ কিছু সৌন্দর্য্য আছে যেগুলো শব্দ দিয়ে বা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। এক কথায় অসাধারণ।

মদীনার মসজিদে নববীকে ফলো করে তৈরি এই মসজিদটি সেন্ট্রালী এয়ারকন্ডিশন্ড তো আছেই, মূল ওজুখানা ও বাথরুম রাখা হয়েছে আন্ডার গ্রাউন্ডে। সে জায়গাও শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেখানে উঠা নামার জন্য রয়েছে এস্কেলেটর। মোটামুটি এলাহি কান্ড বলা যায়। তারপরও আমি অত্যন্ত দুঃখ ও অনুতাপের সাথে বলছি, বিশ্বের অন্যতম সুন্দর এই মসজিদটিকে মসজিদ না বলে কেউ যদি প্রথম শ্রেণীর একটি মিউজিয়াম বলে, তাহলেও আমি অবাক হবো না।

আমি তাকে মিথ্যেবাদী বলবো না, এর কারণ, মসজিদের যে কিছু রেসট্রিকশন থাকা দরকার, মসজিদের বাহ্যিক এবং অন্তর্নিহিত যে পবিত্রতা রক্ষা করা দরকার, সেটা এই মসজিদের ক্ষেত্রে হচ্ছে না বলে আমি নিজ চোখে দেখে এলাম। সে প্রসংগে পরে আসছি। মসজিদটির প্রবেশ পথে লাগানো আছে একটি বিশাল সাইনবোর্ড। বিভিন্ন ইন্সট্রাকশন দেয়া। সেখানে লেখা দেখলাম, প্রতি সপ্তাহের রবি থেকে মঙ্গলবার মসজিদটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।

আর কাকতালীয়ভাবে আমাদের যাওয়াটাও ছিল রোববারে। মেইন মসজিদের উত্তর পাশে (অবশ্য মসজিদের বাইরে) থেকে কোরআন তেলাওয়াতের সুর ভেসে আসলো কানে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। দেখলাম অনুমান ১০০ স্কয়ার ফিটের সুসজ্জিত একটি ঘর। প্রথমে ভেবেছিলাম ইমাম সাহেবের হুজরা-টুজরা হতে পারে।

কিন্তু প্রশ্ন করে জানতে পারলাম এটা আমিরাতের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফার পিতা শেখ জায়েদের কবর। মসজিদটির নামও তার নামে রাখা হয়েছে শেখ জায়েদ মসজিদ। আরো খোঁজ নিয়ে জানলাম সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার আবুদাবির মসজিদগুলোর ইমামরা অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে এখানে এসে জড়ো হন। দোয়া-দুরুদ করেন। এজন্য তাদের জন্য বিশেষ হাদিয়ার ব্যবস্থা থাকে কিনা, সেটা আর সাহস করে জিজ্ঞেস করা হয় নি।

মসজিদটির কন্ট্রোলার শেখদেরকে বেশ নাক উঁচু স্বভাবের মনে হল। ইতিমধ্যেই একটা ধমক হজম করতে হয়েছে আমাকে। কারণ হল, মসজিদটিতে ধোয়ামুছা ও পরিচ্ছন্নভাবে কাজে নিয়োজিত এক কর্মীর সাথে কথা বলে জানলাম মসজিদটির বারান্দা ও উঠোন পরিষ্কার রাখা ও ধোয়ামুছার জন্য তারা ৪৬ জন লোক কাজ করছে। আর এরা সকলেই বাংলাদেশি। মসজিদটিতে খাদিম বা কর্মরত মোট কর্মচারীর সংখ্যা ৩০০ জন।

একজনের সাথে কথা হল। তার বাড়ি বাংলাদেশের ফেনীতে। নাম জামালউদ্দিন। সে জানালো, ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকায় সে সেখানে গেছে। আর তাকে বেতন দেয়া হচ্ছে মাসে ৫০০ দেরহাম।

খাওয়ার জন্য আরো ১২০ দেরহাম। থাকা ফ্রি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশি টাকায় প্রতিমাসে তার রুজগার মাত্র ১২ হাজার টাকার মত। তাই প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকাও তারপক্ষে বাড়িতে পাঠানো সম্ভব হয় না। অন্য আরেকজনের সাথে আলাপ শুরু করতেই কোথা থেকে জানি হন হন্ করে ছুটে আসলেন এক শেখ।

আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, “কী চাই তোমার? ওদেরকে কাজে ডিষ্টার্ব করছো কেন? তোমার সমস্যাটা কী?” আমি ভ্যাবোচেকা খেয়ে উঠলাম। শেখ বেচারাদের মেজাজ-মর্জি কিছুটা উগ্র বলে আগেই আমাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তাই ‘স্যরি’ বলে সামনে থেকে সরে আসলাম। আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম মসজিদের দিকে। জুতা খুলে রেখে এগিয়ে চলেছি আমরা কিন্তু বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম মসজিদের বারান্দায় সবাই জুতা নিয়েই হাটাচলা করছে।

এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে আরেকটি ধমক খাওয়ার ঝুঁকিটি আর নিলাম না। যথেষ্ট কৌতূহল ও অদম্য আকাংখা নিয়ে প্রবেশ করলাম মূল মসজিদের ভেতরে। নরম তুলতুলে কার্পেট, পা জমে যেতে লাগলো? যেদিকেই তাকাচ্ছি, চোখ আটকে যাচ্ছে। আগেই বলে রেখেছি এর সৌন্দর্য্য বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। মসজিদের ভেতরের বড় পিলারে মুভি ক্যামেরা ফিট করে রাখা হয়েছে।

বয়ান বা খুতবা সরাসরি সম্প্রচার করবার জন্য। মেহরাবের পেছনের দেয়াল ধবধবে শ্বেত পাথরে তৈরি। এক একটি পাথরে খোদাই করে আল্লাহর ৯৯টি নামের এক একটি লিখে রাখা হয়েছে। মধ্যখানে বড় করে লেখা আল্লাহ। মেহরাবের অভ্যন্তরে তিনটি মাইক্রোফোন।

চোখ পড়লো মিম্বরের দিকে। আমি আমাদের দেশে তিন সিঁড়ি বিশিষ্ট মিম্বর দেখে অভ্যস্ত। লক্ষ্য করলাম এই মিম্বরটি ১০ সিঁড়ি বিশিষ্ট। অর্থাৎ খতিব সাহেব ১০টি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে খুৎবা দেন। সেখানে রয়েছে আরেকটি মাইক।

বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলে ঝুলিয়ে রাখা বিশাল ঝাড়গুলো বৈদ্যুতিক সংস্পর্শ ছাড়াই ঝলমল করছে। আর করবে না-ই বা কেন? পয়সা তো আর কম ঢালা হয়নি এদের পেছনে। তবে যে কারণে আমি এটাকে মিউজিয়াম বলার পক্ষে রায় দিয়েছি, সেই কারণটি হল, দেশ-জাতি, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ মসজিদটি দেখতে আসছে। অবশ্য শুধু দেখতে আসলে এবং মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করে দেখে গেলে আমাদের আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। আপত্তি আমি জানাতেই পারি।

একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বের যে কোনো মসজিদকেই আমি আমার নিজের মসজিদ বলে গর্ব করতে পারি। সকল মসজিদেই আমি আমার অধিকার নিয়ে দাঁড়াতে পারি। নীতিগতভাবে এবং ইসলামী বিধি অনুযায়ী আমাকে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই। সেই অনুযায়ী আমি আমার আপত্তি উত্থাপন করতেই পারি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইয়াহুদী, তারা যদি আমাদের এই মসজিদটি শখ করে দেখতে চায়, তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।

কিন্তু খুব কষ্টের সাথে আমি লক্ষ্য করলাম ওসব অমুসলিম নারী-পুরুষরা দলে দলে প্রবেশ করছে মসজিদের ভেতরে। মুভি ক্যামেরা নিয়ে ছুটাছুটি করছে। ছবি তুলছে। অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করার নিয়ম নেই। তারা শারীরিকভাবেও তো অপবিত্র।

ভুল করেও ওরা প্রশ্রাব করে পানি ব্যবহার করে না। আমরা যেটাকে ফরজ গোছল বলি, তেমন গোছল এই জীবনে একদিনও তাদের করার কোনো কারণ নেই। অথচ আবুধাবির মুসলিম সরকার এদেরকে অবাধে ঢুকতে দিচ্ছেন মসজিদে। মুসলিম-অমুসলিম নারীরাও ঢুকছে অবাধে। কিছু মহিলা বুরকা পরিহিতা হলেও অধিকাংশই খোলামেলা।

আমি এবং মুছা দু’রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করলাম মসজিদটিতে। মুছাকে বললাম, চলো, দু রাকাত নামাজ পড়ি। এই সুন্দর মসজিদটি অনেক পাপ কাজের সাক্ষী হচ্ছে। আমাদের নামাজেরও সাক্ষী হোক। মামাজ পড়ে দাড়িয়েছি মাত্র।

তখন সামনে এসে দাড়ালো এক লোক। আচ্ছা, সে গল্প আগামী কালের৪ জন্যই থাকুক। ক্রমশ------ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.