আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালির মধ্যপ্রাচ্য (১৪)

আল-আইনের শিক্ষা ব্যবস্থা: বাঙালির দৃষ্টিকোণ থেকে আল-আইন হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচে' বেশি স্থানীয় নাগরিকদের বসতি এলাকা। আমিরাতের কুট্টিরা এই এলাকায় থাকেন। বিশ্বের অন্যতম পরিকল্পিত একটি শহর হচ্ছে আল-আইন। এই শহরকে গ্রীণ সিটি বলা হয়। গালফের মধ্যে সবচে' বড় চিড়িয়াখানার অবস্থান এই শহরে।

আল-আইনের হাদিকাতুল হায়ওয়ানাত বা চিড়িয়াখানাটি বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কী নেই এ শহরে? স্থানীয় নাগরিকদের প্রত্যেকেরই ৪/৫ টি করে ব্যক্তিগত গাড়ী রয়েছে। আল-আইন শহরে ও শহরতলীতে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি রয়েছেন। এখানকার কৃষি খামারগুলোর ৯৫% শ্রমিকই বাংলাদেশি। ৯০% গাড়ীর গেরেজ বাঙালিদের।

বৃহত্তর সিলেটের বেশ কিছু আতর ব্যবসায়ী রয়েছেন এই শহরে। এই শহরে স্ব-পরিবারে বসবাস করছেন অনেক বাঙালি। তাদের কেউ মসজিদের ইমামতি করছেন আবার কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। যারা স্ব-পরিবারে আছেন, তারা মোটামুটি সুখে থাকলেও একটি বড় সমস্যা সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায় তাদেরকে। এটা হচ্ছে এখানে কোনো বাংলাদেশি স্কুল নেই।

বিশ্বের যত দেশের মানুষ এখানে বসবাস করছেন, তাদের প্রত্যেকেরই স্বদেশি স্কুল রয়েছে। নেই শুধু বাংলাদেশি স্কুল। এমন নয় যে, সেদেশের সরকার সুযোগ দিচ্ছে না। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, আমিরাত সরকার বাংলাদেশি স্কুল তৈরি করার জন্য জমি পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু অই যে! কথায় বলে, ‘ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধানই ভানে।

’ বাঙালি কোথাও যাবে আর গ্রুপিং লবিং হবে না, তা কি হয়? কে হবেন প্রধান শিক্ষক, কার আত্মীয় নিয়োগ পাবেন শিক্ষক/শিক্ষিকা হিসেবে, কে হবেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, এ নিয়ে চুলোচুলি করতে করতে এখানে স্কুলটি হয়ে উঠেনি। নিকট ভবিষ্যতে হবে, আপাতত তেমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশিরা এ অব্দি একটি স্কুল করতে না পারলেও ভারতীয়রা এ পর্যন্ত এখানে ১০/১২টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। বেশ ভালভাবে সেগুলো পরিচালনাও করছে। ইন্ডিয়ান স্কুলদের মধ্যে দারুল হুদা ইসলামিক স্কুল, নিউমডেল ইসলামিক স্কুল, আওয়ারাং ইংলিশ স্কুল, ওয়াসিস স্কুল অন্যতম।

এই স্কুলগুলোতেই পড়ালেখা করছে বেশির ভাগ বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েরা। কিছু বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা আরবী স্কুলেও পড়ে। আরবী স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো, নাছছুস সালেহীন বা দারে জায়েদ, মাহাদুল ইসলামী, ইসরা আল খা-ছছা, খাওয়ারীম ইত্যাদি। আল-আইনে বাংলাদেশি স্কুল না থাকায় ওখানকার ছেলে মেয়েরা বাধ্য হয়েই সংশ্লিষ্ট দেশের সিলেবাস অনুযায়ী পড়ালেখা করছে। ফলে অনেক কিছু তারা শিখলেও, অনেক কিছু তারা জানলেও বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারছে না।

আমার চাপা অসন্তুষ আগ্রহী করে তুললো আমাকে। এ কেমন অবস্থা আমাদের! বাইরে এসেও কেনো চিরাচরিত বদ খাসলতগুলো থেকে বেরুতে পারছি না! অন্যদের মন্দ অভ্যাসগুলো গ্রহণ করে নিতে দেরি করি না, তাহলে তাদের ভালোগুলো চোখ এড়িয়ে যায় কেনো? কয়েকটি স্কুল ঘুরে দেখার ইচ্ছা হলো। আমি আমার ইচ্ছাটি জানালাম প্রবাসী কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দকে। তারা আমাকে সুযোগ করে দিলেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম, ইন্ডিয়ান দারুল হুদা ইসলামিক স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ছিদ্দিকুর রহমান ছাদেকের সাথে।

সে আবেগের সুরে বলে, “এখানে বাংলাদেশি স্কুল থাকলে আমরা প্রবাসে থেকেও দেশের স্কুলে লেখাপড়া করতে পারতাম। পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে পারতাম। যা এখন পারছি না। ” কথা হলো ওয়াসিস স্কুলের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র আলী আহমদের সাথে। সে সিলেট ঢাকাদক্ষিণের জনাব জালাল উদ্দিনের ছেলে।

মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে সে আল আইনে থাকে। সে জানালো, “বাংলাদেশি স্কুল না থাকায় আমরা ভালভাবে বাংলা শিখতে পারছি না। বাঙালি হয়ে বাংলা না শিখলে কেমন করে হবে?” ছেলেটির মাঝে আমি বাংলার প্রতি গভীর মমতা আবিস্কার করলাম। আওয়ারাং ইংলিশ স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী তাওহিদা বিনতে আব্দুর রউফ। মায়াবী চেহারার এই পিচ্চি মেয়েটি জানায়, “আমাদের লেখাপড়া খুব ভাল হচ্ছে।

টিচাররাও আমাদেরকে খুব ভালবাসেন। তবে অন্যদেশি সকল বন্ধুদের নিজ নিজ দেশের স্কুল আছে, শুধু আমার নেই। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে আমার মন খুব খারাপ হয়। ” আমাদের দেশি স্কুল নাই কেনো? ব্যাপারটি নিয়ে বেশ কিছু অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা গেল, তারা প্রত্যেকেই বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর কষ্টে আছেন। মৌ্লভীবাজার বড়লেখার লোক, শেখ তাহনুন মসজিদের ইমাম মাওঃ আব্দুর রহমান এর তিন ছেলে ও এক মেয়ে পড়ালেখা করছে দারুল হুদা ইসলামিক স্কুলে।

তিনি বলেন, “স্কুলটি ইন্ডিয়ান হওয়ায় আমার ছেলের মেয়েরা ইন্ডিয়ান ইতিহাস জানছে ঠিকই, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ” আল আইন নাইল কোম্পানীতে কর্মরত সিলেট মিরাপাড়ার জনাব কামাল উদ্দিন ক্ষোভের সাথে বলেন, “আমাদের সন্তানরা আজ ইন্ডিয়ান স্কুলে পড়ছে। অথচ আমরা একটু ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে আমাদের ছেলে মেয়েরা বাংলাদেশি স্কুলেই পড়তে পারতো। ” কথা হয় উমর বিন খাত্তাব মসজিদের ইমাম এবং আল আইনস্থ আওক্বাফের পরীক্ষক বোর্ডের অন্যতম সদস্য হাফিজ মাওঃ আব্দুল মুছাব্বির সাহেবের সাথে। তিনি বলেন, “আমার ৬ সন্তানও পড়ালেখা করছে নাছছুস সালেহীন ও নিউ মডেল ইন্ডিয়ান স্কুলে।

ভর্তির সময় অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। কী করবো, নিজেদের কোনো স্কুল না থাকলে এমন সমস্যা তো হবেই। ” সিলেট বিভাগ প্রবাসী কল্যাণ সমবায় সমিতি আল আইনের সভাপতি জনাব আব্দুশ শহীদ বলেন, “অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এত বেশি বাংলাদেশি থাকা সত্ত্বেও শুধু অনৈক্যের কারণে আমরা স্কুল করতে পারছি না। আল আইন সিটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশি স্কুলের জন্য বরাদ্ধ দেয়া জায়গাটি খালি পড়ে আছে। ” তাদের সকলের দাবি, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।

আমিরাত সরকারের সাথে সমন্বয় সাধন করে স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে বাংলাদেশি স্কুল প্রতিষ্ঠায় জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। সারাদিন অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যায়। রাত ৯ টায় জমে উঠলো ঘরোয়া আড্ডা। ৮/১০ জন বাংলাদেশি বন্ধু বান্ধব এসে জড়ো হলেন।

আড্ডায় আড্ডায় ফজরের আযান হয়ে গেল। ফজরের নামাজের পর বিছানায় গেলাম। ২/৩ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। সকাল ৯টায় আবুদারির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। ১৭০ কিলোমিটার জার্নি।

আবুদাবিতে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর ৫টি মসজিদের একটি তৈরি করা হয়েছে। মসজিদটি দেখা দরকার। ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা। সকালে উঠে রওয়ানা দেব আবুদাবির উদ্দেশ্যে। ক্রমশ---------------- ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.