আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালির মধ্যপ্রাচ্য (১০)

কালচারাল অধ:পতন বেশ খানিক্ষণ ঘুরাঘুরি করে বিকেলবেলা ফিরে আসলাম হোটেলে। বিকেল ছয়টা বাজে। রিসিপশনে গেলাম। উদ্দেশ্য ম্যানেজারের সাথে খানিক্ষণ কথাটথা বলে দুবাই সম্বন্ধে আরো ডীপ কিছু জানার চেষ্টা করা। ম্যানেজারের নাম মিষ্টার কিরণ।

বাড়ী ইন্ডিয়ার মুম্বাই শহরে। বসতে না বসতেই পেয়ে গেলাম খোদ্ হোটেল মালিককে। প্রতি শুক্রবারে তিনি একবার আসেন। ভদ্রলোকের নাম মিষ্টার সাদিক। বাড়ী ভারতের চেন্নাই।

অত্যন্ত সুদর্শন সদালাপি ও মাইডিয়ার টাইপ লোক। প্রায় ৪০ মিনিট বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললাম উনার সাথে। উনার কাছ থেকে দুবাই সম্বন্ধে অনেক তথ্য আবিস্কার করলাম আমি। জানাগেল, দুবাই এর ৮০% ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ইন্ডিয়ানরা। বিশ্বের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য নগরী দুবাই।

সারা বিশ্বের পয়সাঅলা লোক দুবাইয়ে কেনাকাটা করতে স্বাচ্ছন্দ অনুভব করে। আর দুবাই’র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি ইন্ডিয়ানদের হাতে। শুধু ব্যবসা না, দুবাই’র বিভিন্ন সরকারী অফিস-আদালতেও কর্মরত রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইন্ডিয়ান। আর এ জন্য পুরো দুবাই শহরে ইন্ডিয়ানরা দাপটের সাথেই চলাফেরা করে। আমি যদি দুবাই শহরকে ভারতীয়দের হাতে জিম্মি বলে দাবি করি, তাহলেও সেটা অত্যোক্তি হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে মুরি-মুড়কীর দোকানের মত যে মদের দোকানগুলো গজিয়ে উঠেছে, বলাই বাহুল্য সেগুলোর প্রায় সবকটিই ভারতীয়। আজ যদি কোনো কারণে দুবাই সরকার ভারতীয়দেরকে দুবাই থেকে চলে যেতে বলে, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যদি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্যও হয়, তাহলে পুরো দুবাই শহর অনেকটা ছাড়াবাড়ীর মতন হয়ে যাবে। ব্যাপারটি বেশ ভালকরেই জানে ইন্ডিয়ানরা। আর এ জন্যই দুবাই শহরে ঠিক ততটাই তারা ধাপিয়ে বেড়ায়, দিল্লী কিংবা মুম্বাই শহরে যতটা ধাপিয়ে বেড়াতে পারতো। মিস্টার সাদিকের কাছ থেকে অনেক তথ্য জানার পর উঠে আসার মুহুর্তে আমার সাথী মুছা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাই, আসর কা ওয়াক্ত কব্ তক্ হ্যায়?’ প্রশ্ন শুনে ভুরু কুচকে তাকালেন ভদ্রলোক? যেমন এমন আজগুবি প্রশ্ন এর আগে কখনো শুনেন নি তিনি।

বললেন, “ হোয়াট ইজ আসর? এক্সপ্লেইন মি প্লিজ। ” মিস্টার সাদিক আহমদ নামের একজন (নামে হলেও) মুসলমান ভদ্রলোকের এই ‘হোয়াট ইজ আসর’ শুনার পর আসর সম্বন্ধে তাকে আর এক্সপ্লেইন করার কোনো আগ্রহই খোঁজে পেলাম না। রুমে ফিরে এলাম। আর মনে মনে ভাবলাম, এমন মুসলমানও তাহলে আছে, যারা আসরের নামাজ পড়বে দূরে থাক, আসর নাম শুনেই চমকে উঠে! সন্ধ্যার পর সাধারণ কৌতূহলের কারণেই আবার এসে হাজির হলাম রিসিপশনে। রিসিপশনের ডানপাশে রয়েছে মদের বার, বাম পাশে সম্ভবত ডান্স ক্লাব।

সন্ধ্যার পর থেকেই বারে ভিড় বাড়তে লাগলো। প্রচুর লোক আসছে, ড্রিংকস্ করে নেশা মোডে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি লবিতে বসে লক্ষ্য করলাম বারের মেহমানদের ৯০% ই মুসলমান। আর এই পরিচয় নির্ণয়ে আমাকে সাহায্য করলো তাদের সাদা লম্বা আলখেল্লা, মাথার রুমাল ও বেড়িয়া। আমাদের বাংলাদেশেও অভিজাত এলাকায় মদের বার রয়েছে।

ঢাকার গুলশান-বনানীর হাই প্রোফাইল মানুষের জন্য বার, ডান্স ক্লাব, ডিস্কো সবই আছে। ওসব স্থানে যারা যায়, তাদের সামাজিক অবস্থান, কালচারাল অবস্থা এবং পরিচয় আমরা সাধারণ মানুষ থেকে একটু ভিন্ন। যদিও এদের অধিকাংশই মুসলমান, তবুও তাদের দেখে কেউ চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারবে না এরা মুসলমান। কিন্তু দুবাই শহরের ঐ বারের মেহমানদের পোশাক দেখেই তাদের ধর্মীয় পরিচয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে যাওয়া যায়। দেখে খুব বেমানান লাগতে লাগলো আমার কাছে।

যদিও যারা বারে ঢুকছে, তারা সাধারণ আরবী, আলেম নয়। কিন্তু আমি আমার দেশে এমন লম্বা পাঞ্জাবী ও রুমালে আলেম-উলামাকে দেখে অভ্যস্ত বলে দৃশ্যটি বড়ই বেমানান লাগতে লাগলো। মনে মনে বললাম, ব্যাটারা মদ খাবি খা, ইসলামী ঐতিহ্যের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এই সুন্নতি লেবাসটা না পরেই না হয় এই সুকর্মটি কর। তোরা তোদের কাজ-কর্মে বিশ্ব মুসলিমকে হেয় করবি কেন? তোদের অপকর্মের দায় বিশ্ব মুসলিম বয়ে বেড়াবে কেন? কেন তোদের কালচার দেখে বিশ্ববাসী এটাকে মুসলিম কালচার ভেবে ধোকা খাবে? এমন অনেক কথা ভেবে চলে গেলাম হোটেল রুমে। রাত নয়টা বেজে গেছে।

এর মধ্যে এক নাগাড়ে ১৮ ঘণ্টা হয়ে গেছে পান খাওয়া হয় নি। আগেই জানিয়েছি দুবাই এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের পান-সুপারী ডাষ্টবিনে ফেলে দেয়ায় আমরা পড়েছি এই পানের মহামারীতে। সকাল ১১টা থেকেই পরিচিত বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধবের কাছে ফোন করছি একটু পানের ব্যবস্থা করার জন্য। যোগাযোগ করলাম আল আইনের আব্দুল্লাহ ভাই এর সাথে। মুছা তাকে বললো, যে করেই হোক, একটু পানের ব্যবস্থা করে দিন।

আমিও তাতে সায় দিলাম। একবারও ভেবে দেখলাম না পান খাওয়া ও পান বিক্রি যে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ, সেই দেশে প্রায় ২শ কিলোমিটার দূরে থেকে বেচারা আব্দুল্লাহ ভাই আমাদের জন্য পান পাঠাবেন ই বা কেমন করে! যদিও আব্দুল্লাহ ভাই বেশ কয়েকবার ‘ইনশাআল্লাহ ব্যবস্থা করছি’ বলে আমাদের আস্বস্থ করলেন কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করে তাঁর সেই ইনশাআল্লায় আমরা দু’জন খুব একটা ভরসা করতে পারলাম না। এদিকে পানের অভাবে আমাদের অবস্থা কাহিল! নিয়মিত পান খাওয়া কাউকে একনাগারে ১৮ ঘন্টা পান ছাড়া করে রাখলে তার অবস্থা কেমন হয়, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকে বুঝানো যাবে না। যারা খুব বেশি পান খায়, তাদের একবেলা ভাত না দিলে সমস্যা নেই যদি তাদের সামনে পানদান সাজানো থাকে। রাতে সাড়ে নয়টায় আমাদের সকল অপধারণা ও অবিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করে আমাদের জন্য ১০টি পান নিয়ে এসে হাজির হলেন ডেরাডুবাই এর বন্ধু হিফজুর রহমান।

দুর্দিনেই বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। হিফজুর ভাই’র সাথে এর আগে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল না। তখন মনে হল পৃথিবীর সবচে' শ্রেষ্ঠ উপকারী এই মানুষটার সাথে একটু গভীর সম্পর্ক আরো আগে কেন তৈরি হল না? জীবনের সব’চে বেশি আগ্রহের পানটি মুখে দিলাম। পানের খুশিতে এতক্ষণ ভাল করে লক্ষ্য করা হয় নি।

এবারে লক্ষ্য করলাম হিফজুর ভাই একা আসেননি, উনার সাথে এসেছেন আরো দু’জন বাঙালি। তিনজন মিলে অনেক খোঁজা-খুঁজি করে এবং অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১০টি পান বহন করে নিয়ে এসেছেন। ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে’ শব্দটি শুনে হাসার কারণ নেই। পান খাওয়া ও পান বিক্রির অপরাধে ভিসা বাতিল করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার নজিরও আছে যে দেশে, সেখানে পান নিয়ে আসা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ বুঝতেই পারছেন। যদিও মাত্র ১০টি পান ছিল, কিন্তু যে সময় যে অবস্থায় হিফজুর ভাই’রা আমাদের জন্য পান নিয়ে এসেছিলেন, সারা জীবন সেটা মনে থাকবে আমাদের।

আজকের এই লেখা তাদের চোখে পড়বে না জানি, তবুও আমি আমার অন্তর থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি জীবনের সবচে উপযোগী মুহুর্তে পান খাওয়ানোর জন্য। কিছুক্ষণ গল্প-গোজব করার পর তারা আমাদের নিয়ে গেলেন হোটেলের বাইরে। ভাত খাওয়ানোর জন্য খুব সাধা-সাধি করলেন। কিন্তু আমাদের পেটে ভাত খাওয়ার মত পর্যাপ্ত জায়গা খালি ছিল না।

বিকেলে হোটেল রুমে বসে বসে হোটেলের রেষ্টুরেন্টে দু’টো বিরিয়ানীর ওর্ডার দিয়েছিলাম। দশমিনিটের মাথায় রুম সার্ভার মাঝারী সাইজের পিতলের দু’টো ডেকসি নিয়ে হাজির হলো। বিরিয়ানী ভর্তি। দু’টো মিলিয়ে এক কেজি’র কম হবে না। আমি ও মুছা দু’জনে মিলে কোনো রকমে একটার তিন-চতুর্থাংশ সামাল দিলাম।

দু’ প্লেইট বিরিয়ানীল দাম পঞ্চাশ দিরহাম। বাংলাদেশি টাকায় নয়শত পঞ্চাশ টাকা। ঘণ্টাখানেক খচখচ্ করতে লাগলো মনের মধ্যে। ৫শ টাকা জলে গেল! হিফজুর ভাই’রা শেষ পর্যন্ত নাস্তা করতে বাধ্য করলেন। আমাদের নিয়ে গেলেন একটি ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে।

পরটা দই ও কলা’র অর্ডার দিলেন। নাস্তা শেষে তাদেরকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরে এলাম হোটেল কক্ষে। রাত গভীর হয়ে গেছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সকাল সকাল উঠতে হবে।

আগামীকাল ভোরে আল-আইনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা। ক্রমশ---------- ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.