আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিআরপি ॥ বিব্রত চ্যানেল, বিভ্রান্ত বিজ্ঞাপনদাতা

গভীর কিছু শেখার আছে .... টেলিভিশন রেটিংস পয়েন্ট বা সংক্ষেপে টিআরপি-এর ধারণাটি বিশ্ব জুড়েই পরিচিত। বিশেষ করে, কোন চ্যানেলের অনুষ্ঠানের মান ও গ্রহণযোগ্যতা দর্শকদের কাছে কতটুকু সেটি বোঝার সহায়ক ভূমিকা হিসেবে টিআরপির বিকল্প নেই। ফলে টিআরপির মাধ্যমেই সেই চ্যানেলের উদ্যোক্তা ও বিজ্ঞাপনদাতারা চ্যানেলে কেমন ইনভেস্ট করবেন বা কোন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ইনভেস্ট করলে তা ফলপ্রসূ হবে সেটি বুঝতে পারেন। আমাদের দেশে টিআরপির ধারণাটি একেবারে নতুন হলেও ইতোমধ্যে এটি বিভিন্ন চ্যানেল ও চ্যানেল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিজ্ঞাপনদাতাদের দৃষ্টিতে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। তবে পাশাপাশি টিআরপির ফলে বিজ্ঞাপনদাতা ও চ্যানেল কর্তৃপক্ষ স্রেফ বিভ্রান্ত হচ্ছেন বলেও অনেক চ্যানেলের হর্তা-কর্তারা অভিযোগ করেছেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশে সিরিয়াস নামের একটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি চ্যানেলগুলোর টিআরপি জরিপ নিয়মিত প্রকাশ করে থাকে। তারা ঢাকা শহরের ১৪৬টি বাড়ির টেলিভিশন সেটের সঙ্গে বিশেষ যন্ত্র সংযোজন করে এই টিআরপি জরিপটি করে থাকে। এখন টিআরপির এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে মূল যে অভিযোগ সেটি হলো, মাত্র ১৪৬টি টেলিভিশন সেটের মাধ্যমে যে জরিপটি করা হচ্ছে সেটি কতটুকু যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য? কারণ সারা দেশের লাখ লাখ টেলিভিশন সেট ও দর্শকদের বদলে মাত্র ১৪৬টি টেলিভিশন সেটের দর্শকদের তথ্য গ্রহণ করা হচ্ছে এবং সেটিই টিআরপি জরিপ হিসেবে প্রকাশ করা হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক যে, এই জরিপটি কি আদৌ বাংলাদেশের সব ধরন ও শ্রেণী-পেশার দর্শকদের প্রতিনিধিত্ব করে কিনা? রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ জরিপ প্রতিষ্ঠান সিরিয়াসের মিডিয়া রিসার্চ এক্সিকিউটিভ প্রণব জানান, তাঁরা কেবল ঢাকা মেট্রোতেই তাদের জরিপ চালিয়ে থাকে। ১৪৬টি বাড়ির টেলিভিশন সেটে তাদের জরিপ ডিভাইসটি বসানো আছে।

সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়েই তারা প্রতি সপ্তাহের জরিপ ফলাফলটি প্রকাশ করে থাকে। কিভাবে তাদের জরিপটি হাতে পাওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি জানান, বার্ষিক গ্রাহক হবার ভিত্তিতে নিয়মিত জরিপ তালিকাটি পাওয়া যাবে। বার্ষিক গ্রাহক ফি ভ্যাট ব্যতীত ৬ লাখ টাকা বলে তিনি জানান। এ প্রসঙ্গে আরটিভির রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিংয়ের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রবিশঙ্কর মৈত্রী বলেন, আরটিভিতে প্রচারের উদ্দেশ্যে ধাক্কা নামের একটি এক পর্বের নাটক জমা পড়ে। নাটকটির মান ও কাহিনীতে অসঙ্গতি থাকায় তা প্রচারের অনুপযোগী হিসেবে ফেরত দেয়া হয়।

পরে আরটিভির মার্কেটিং শাখা থেকে ক্রয়কৃত চাঙ্কে প্রচারের জন্য সেই নাটকটি আমাদের কাছে দেয়া হয়। আমরা নাটকটি প্রচার করতে বাধ্য হই। পরে আমরা আরেকটি ধাক্কা খাই, যখন দেখলাম পরবর্তী সপ্তাহের টিআরপি তালিকায় সেই নাটকটি শীর্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে আমাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, যাদের ওপর টিআরপি করা হচ্ছে তারা আসলে কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ? একই চ্যানেলের হেড অব প্রোগ্রাম মিনহাজুর রহমান বলেন, আরটিভির রাতের সঙ্গীতানুষ্ঠানগুলোতে দর্শকরা প্রচুর ফোন ও ই-মেইল করেন। এছাড়া পরিচিত অনেকেই যে অনুষ্ঠানটি নিয়মিত দেখেন সেটি আমরা তাদের কাছ থেকেই শুনতে পাই।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, টিআরটির জরিপে লাইভ সঙ্গীতানুষ্ঠান তেমন জোড়ালো অবস্থানে থাকে না বললেই চলে। আবার বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আমরা যে পরিমাণ টিআরপি পাই সেটি আমাদের মোট টিআরপির ৩৫-৪০ শতাংশ। মিনহাজুর রহমান আরও বলেন, আমাদের বিজ্ঞাপনদাতারাও বোঝেন যে এই টিআরপির মূলত কোন মূল্য নেই। তবুও তারা এটি সামনে নিয়েই চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনের মূল্য ও পরিমাণ ভাগ করেন। আর এর জন্য আমাদের অনুষ্ঠান যেন এই ১৪৬টি সীমিত টেলিভিশন সেটের মাধ্যমেই টিআরপিতে অবশ্যই আসে সেই চেষ্টাই করতে হয়।

সিরিয়াস নামক প্রতিষ্ঠানে টিআরপি নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করতেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজন কর্মী জানান, মূলত ঢাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর টেলিভিশন সেটের মাধ্যমেই তারা টিআরপি জরিপটি সংগ্রহ করেন। কারণ টিআরপির জন্য টেলিভিশন সেটে যে যন্ত্রটি ব্যবহৃত হয়, সেটি লাগাতে দিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তেমন কেউই রাজি হন না। ফলে তাদের বেছে নিতে হয় নিম্নবিত্ত শ্রেণী তথা অপেক্ষকৃত অসচ্ছল শ্রেণী ও পেশাজীবীদের। অনুষ্ঠান নির্মাতা ও প্রযোজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, তাদের কাছে টিআরপি হলো বিভীষিকারূপী দৈত্য বিশেষ। কারণ এই টিআরপির উত্থান বা পতনই তাদের অনুষ্ঠানের দীর্ঘায়ু অথবা মৃত্যু ঘটাতে পারে।

এ কারণে অনেক সময় দেখা যায়, খুব জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠানও টিআরপির অভাবে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। জানা গেছে, সিরিয়াস নামের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকৃত টিআরপিটি কোন পত্রিকা বা চ্যানেল প্রচার বা প্রসার করে না। কেবল একটি অনলাইন নিউজ সাইট-ই তাদের মিডিয়া রিলেটেড নিউজে সিরিয়াসের টিআরপি জরিপের সোর্স দিয়ে নিউজ পরিবেশন করে থাকে। বৈশাখী টিভির এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) ফারহানা নিশো বলেন, ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে মাত্র ১৪৬টি টেলিভিশন সেটের মাধ্যমে টিআরপি করে সেই ফলাফল প্রকাশ করাটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক সেটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। বিশেষত যখন দেখি আমার বা আশপাশের পরিচিত কারোরই টিভি সেটে এই জরিপ করার ডিভাইসটি স্থাপন করা হয়নি, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কাদের টিভি সেটের মাধ্যমে এই জরিপ করা হচ্ছে? চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভিন্নতা থাকে।

এজন্য একই প্রক্রিয়ায় সেরা চ্যানেল নির্ধারণ করার মানদ- নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে জরিপ করা উচিত বলেই আমি মনে করি। শেষ চার সপ্তাহ ধরে টিআরপি জরিপের শীর্ষে থাকা বাংলাভিশনের হেড অব প্রোগ্রাম শামীম শাহেদ এ সম্পর্কে বলেন, যে কোন পদক্ষেপের আগে জরিপ করাটা জরুরী। এজন্য সিরিয়াস যে জরিপটি করছে সেটিকে অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। একই ধরনের বক্তব্য দেন একই চ্যানেলের প্রোগ্রাম ম্যানেজার দেওয়ান শামসুর রকিব। তিনি বলেন, টিআরপি জরিপে যে চ্যানেল শীর্ষ থেকে নিচে নেমে যায় তখন সেটি এই ধরণের জরিপের ওপর ক্ষুব্ধ হয়, অথচ শীর্ষে থাকা অবস্থায় সে এই জরিপটি গ্রহণ করে।

জরিপ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক ধরনের কথাই থাকে। তবু আমার কাছে মনে হয়, যেহেতু আমাদের দেশের অনেক ফার্মগুলোর মধ্যে এই একটি ফার্মই চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান নিয়ে জরিপ করছে, সুতরাং তাদের অবশ্যই সাধুবাদ জানানো উচিত। আর এ কারণে এই জরিপের ফলাফলকে গ্রহণ করা উচিত। অন্যদিকে একুশে টেলিভিশনের এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অঞ্জন রায় এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন নি। *********************************************** [ বিঃ দ্রঃ আমার লেখা এই রিপোর্টটি গত সপ্তাহে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল।

তবে প্রয়োজন মনে করছি বলে ব্লগে শেয়ার করলাম। ] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।