আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার মায়েদের জীবন তেতো...আমার মায়েরা যে নিমগাছ!

ঘুনে ধরা সমাজ ভাঙ্গো! নিমগাছ -বনফুল ............... কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকানিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব্যার্থ মহৌষধ।

কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে। এমনি কাঁচাই...... কিংবা ভেজে বেগুন-সহযোগে। যকৃতের পক্ষে ভারি উপকার। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক... দাঁত ভাল থাকে। কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশি হ'ন। বলে-নিমের হাওয়া ভাল, থাক, কেটো না। কাটে না, কিন্তুও যত্নও করে না। আবর্জনা জবে এসে চারিদিকে। শান দিয়ে বাঁধিয়ে দেয় কেউ-সে আর এক আবর্জনা।

হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরণের লোক এল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। বলে উঠল,- বাঃ, কি সুন্দর পাতাগুলি...কি রূপ! থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার... এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাঃ... খানিক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল।

কবিরাজ নয়, কবি। নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সাথে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতরে শিকড় অনেক দূর চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তুপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।

ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মী বউটার ঠিক এক দশা। .......................................................................................... এটি একটি গল্প। ছোটগল্প। সবার পরিচিত ছদ্মনামধারী এক লেখকের। অনেক ছোট একটি ছোটগল্প।

কয়েক মিনিট মাত্র লাগলো আমার শেষ করতে। কিন্তু এক শিহরণ বয়ে গেলো আমার সমস্ত শরীর জুড়ে। কী যেন এক অজানা কম্পিত অনুভূতি খেলে গেলো আমার অনিঃশেষ মনটি জুড়ে। কেমন যেন এক অচেনা কিন্তু চোখের পাতার মত বার বার পলকে সামনে চলে এসে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে আবার চোখকেই। অবাচ্য কিছু কথা অনিঃশেষ ভাবনার ভেলায় ভেসে বেড়াতে লাগলো আমার শিরায় প্রবাহিত লোহিত নদে।

তোলপাড় করে উঠলো আমার সকল সাজানো স্মৃতি। উলটে পালটে গেলো এক মুহুর্তে। সেবার বাড়ি থেকে যখন পুণরায় ফিরে আসছিলাম বিদায় নিয়ে, অনেক এগিয়ে গিয়েও এক্টিবারের জন্য পিছু ফিরেছিলাম। অনেক দূরে ভরা বর্ষার পুকুরের মতো টলমলে চোখের অধিকারিনী মা'কে দেখেছিলাম। বাবা ব্যস্ত মানুষ।

বাড়ি ছিলেন না। মা'ই এগিয়ে এসেছিলেন অনেকদূর পর্যন্ত। মধ্যবিত্তিয় মানসিকতার কারণে মা'কে ভালোবাসি বলে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। আমরা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা কখনো মা'কে শব্দ করে বলতে পারি না 'ভালোবাসি'। আমি সেদিন মনে মনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাকে বলেছিলাম ভালোবাসি।

সারাটা পথজুড়ে বলছিলাম হয়তো 'মা, ভালোবাসি'। সেই সময়টা যেন আজ আমি আমার চোখের ঠিক সামনে দেখছি। সেই টলমল চোখ, সেই শুষ্ক-চিন্তিত মুখ, প্রিয় মুখটি। আমার মা। আমাদের মায়েরা বড্ড শিকড় গেড়ে আমাদের মা হয়ে থাকেন, গৃহস্থের স্ত্রী হয়ে থাকেন, ঘরের লক্ষ্মী হয়ে থাকেন।

সবার আগে ঘুম ভাঙে আমাদের মায়েদের। সবার শেষে তাদের চোখে নিদ্রাদেবীর দয়া হয়। সবার খাওয়ায় যিনি নিত্যকার দর্শক। সবার শেষে যিনি একা খান। সেই মায়েদের কোন আকাঙ্ক্ষা থাকতে নেই।

সেই মায়েদের কখনো বলতে নেই 'আমার বাড়ি'। কোনোটা তাঁর বাপের, কোনোটা তাঁর শ্বশুরের। আমাদের সমস্ত অভিযোগ, অনুযোগ মায়েদের কাছে। সমস্ত রাগ ক্ষোভ, আক্ষেপ, জ্বালা মায়েদের কাছে ঢেলে দিই নির্মূলের আশায়। 'এতো বড় স্থান তোমার কোথায় মা? এতো সব তুমি ধারণ করো কি করে?' আমাদের মায়েদের জগতটা তাদের নিজের, একান্ত ব্যক্তিগত।

দরোজাটায় জং ধরা চাবিহীন তালা। আমাদের মায়ের সেই তালা ছুঁয়েও দেখেন না। কাউকে দেখতে দেন না। আমাদের মায়েরা বলতে ভালোবাসেন 'সুখে আছি'। তাঁরা শুনতে ভালোবাসেন সন্তানদের প্রশংসা; আমাদের প্রশংসা।

নিজেদের কোন দাবি নেই যেনো। তাঁদের নামটি কেউ মনে রাখেনা, নিজেদের অতিমুখস্থ নামটি নিজেরাও ইচ্ছে করেই ভুলে যান আমাদের মায়েরা। তাঁদের কোন নাম থাকতে নেই যেনো। তাঁরা শুধুই 'আমাদের মা' কিংবা 'আমাদের বাবাদের স্ত্রী'। মা কীভাবে তোমরা পরিবারটিকে ভালোবেসে যাও অনিঃশেষ? তোমাদের কী কখনো ক্লান্তি পেয়ে বসে না? তোমাদের কখনো নিজেদের নামে বাঁচতে ইচ্ছে করে না? -আমি জানি মা, তোমাদের বড্ড ইচ্ছে করে।

আমিও তো তোমারই গর্ভজাত, আমিও যে মানুষ। কিন্তু সবার মাঝেও কি এক একাকী জীবন তুমি ধারণ করে আছো মা! বড়ো অবাক লাগে। আমি আজ তোমাদের ভালোবাসার চিরহরিৎ গাত্রে নীলের ছটা দেখতে পাচ্ছি। অসম্ভব সাহসে লুকিয়ে থাকা বেদনা নীল হয়ে ফুটছে। তোমাদের জীবনটা বড্ড তেতো মা।

আমি প্রতিটি ঘরে নিমগাছ স্বরূপ মাতৃমূর্তি দেখছি। আমার বিদায়ক্ষণটি আমার চোখে আবারো হানা দিয়েছে। একটি ঠায় নিমগাছ দাঁড়িয়ে। সমস্ত মুখজুড়ে তার নীলাভ আভা। নীল ফুলে ছেয়ে আছে।

টলমল আঁখি, জল আর গড়িয়ে পড়ে না। মায়ের দূঃখগুলো তাই অপ্রকাশিত। শুধু ছাপ রেখে যায়, মুর্ত হয় না কখনো। আমি যাপন করে যাচ্ছি ব্যস্ততম জীবন। দম ফেলতে হচ্ছে আমাকে রয়ে সয়ে।

কত না পরিবর্তন আমার জীবনে। গাছ থেকে কাঠ, কাঠ থেকে আসবাব-ভার্নিশ-সুন্দর, শোভা বর্ধনের উপাদান......অতঃপর নানা মানুষের সঙ্গ...আহ! কতো না বৈচিত্র্য আমাদের জীবনে। আমাদের পরম্পরা মায়েরা ঠিকই ঠায় নিমগাছ...... [বনফুলের 'নিমগাছ' গল্পটি এক বড়ভাইয়ের কাছ থেকে অনুরোধের অংশ হিসেবে পড়ে আমার সারাটা দিন এলোমেলো কাটলো। আমার অনুভূতি শুধু আমার একলার নয়। আমার বন্ধুরাও জানে এই অনুভূতির কথা।

আমার মধ্যবিত্ত বন্ধুরা। সবাইকে আমার মা'র পক্ষ থেকে 'ভালোবাসা'। এবার গিয়ে মা'কে আমি ঠিক জড়িয়ে ধরে রাখবো দীর্ঘক্ষণ। চিৎকার করে বলবো 'ভালোবাসি'। ] সিলেট ০৭ অক্টোবর ২০১১ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.