আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইঁচড়ে পাকা ছেলেবেলা ৩- নীল ছবির গল্প ( ১৮ পিলাচ, বাচ্চারা দূরে থাকো)

সবচে সুন্দর এই বেঁচে থাকা আগের পর্বের লিঙ্ক এইখানে ১ম পর্ব নিষিদ্ধ জ্ঞান অর্জন ও চটি পর্ব ২য় পর্ব বাল্যপ্রেম এবং একজন ব্যর্থ প্রেমিক নিষিদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে গিয়ে প্রাপ্তবস্কদের বই নিয়ে বমাল ধরা খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এই লাইনে আর না । দুষ্টু বই পড়ার কারণে আমার ওপর যে দমন পীড়ন চালানো হয়েছিল তাতে আমার জীবন মোটামুটি ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল । তাই জ্ঞানার্জনের বাসনাকে জালাঞ্জলি দিয়ে দিলাম । কিন্তু অজানাকে জানবার এবং অদেখারে দেখবার যে এক অদম্য বাসনা আমাদের ভিতরে থাকে তাকে এত সহজে দমন পীড়ণ চালিয়ে ক্ষান্ত করা যায় না । বিশেষ করে যদি তা হয় নিষিদ্ধ কিছু সম্পর্কিত তাহলে ত কথাই নেই ।

আমি যখনকার কথা বলছি তখন টিভি,ভিসিআর এত সস্তা ছিল না । তখন আমাদের এলাকায় কয়েকটি বাড়িতেই শুধু টিভি ছিল,তাও সাদাকালো । আমাদের বাসায় ঠ্যাংওলা কাঠের বাক্সের ভেতর বিশাল গোবদা সাইজের একটা টিভি ছিল,ওইটার বডিও ছিল কাঠের । তাতে মাঝে মাঝে ছবি না আসলে চড় থাপ্পড় মারা হত । রান্নাঘর থেকে ডালের চামচ এনেও মাঝে মাঝে গুঁতানো হত ।

যাইহোক এরপর একটা ‘ফুনাই’ ব্র্যান্ডের ভিসিপি কেনা হল । সেটার হেড আবার একটু পর পরই স্যাভলনে ভেজানো ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে হত । টিভি এবং ভিসিপির ওপর মুরুব্বিদের কড়া নজরদারি থাকায় নিজের ইচ্ছামত কিছু দেখা ছিল অসম্ভব ব্যাপার । অবশ্য বিটিভি ছাড়া অন্য কিছু দেখাও যেত না । তখন ফুটবল খেলার প্রতি মারাত্মক ঝোঁক ছিল সবার ।

কায়সার হামিদ,আসলাম,সাব্বির এরা তখন ছিল সাঙ্ঘাতিক জনপ্রিয় । আবাহনী মোহামেডান খেলা হলেই পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন শ্লোগান শোনা যেত,যেমন- ‘ পানির তলে ট্যাংরা,আবাহনী ল্যাংড়া ’ অথবা ‘ ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা বোয়াল মাছের দাড়ি, মোহামেডান ভিক্ষা করে আবাহনীর বাড়ি ’ এরকম ফুটবল ম্যানিয়ার সময়ে পাড়ায়-মহল্লায় প্রায়ই বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্ট হত । এগুলোতে আবার পুরস্কার হিসেবে কাপ,শীল্ড ইত্যাদি দেয়া হত । তবে সবচে মজা হত কিছু কিছু সময় এইসব খেলাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের খাওয়া দাওয়া ও আনন্দ-ফুরতি যেমন মাইকে গান বাজানো, আনন্দ মিছিল ইত্যাদি । তবে খেলাকে কেন্দ্র করে যে পড়া-মহল্লায় মারামারি এবং বাড়াবাড়ি হত তাও কিন্তু কম না ।

যাই হোক যে প্রসঙ্গে ছিলাম । একবার আমরা পোলাপাইনরা একটা খেলার টুর্নামেন্ট ছাড়লাম,এলাকার বড় ভাইদের সহায়তায় । খেলা ভালই জমল । ফাইনালে কলেজ পাড়াকে হারিয়ে আমাদের টিম চ্যাম্পিয়ন হল । শীল্ডের পাশাপাশি বোনাস পুরস্কার যেটা পেলাম তা হচ্ছে এলাকার বিশিষ্ট চাউলের আড়ৎদার মকবুল হাজী খুশী হয়ে আমাদের খানাপিনার জন্য একটা খাসী দেবার ঘোষণা দিলেন ( কয়দিন পরই পৌরসভার নির্বাচন ছিল,আর তার সেখানে কমিশনার প্রার্থী হবার কথা ছিল ) ।

যাই হোক খাসী পেয়ে আমরা আনন্দে যাকে বলে একেবারে আত্নহারা হয়ে গেলাম । একটা খানাপিনার আয়োজন করার পরিকল্পনা নিলাম । সাথে সাথে বিনোদনের ব্যাবস্থা করার মহা পরিকল্পনা নিলাম । মাইক ভাড়া করলাম তাতে গান বাজানো হবে । বাবুর্চি ঠিক করা হল ।

ভেন্যু ঠিক করা হল আমার বন্ধু রোকনদের বাসায় । কারণ তার বাবা মা দুইজনই চাকরি করে আর তার কোন ভাই বোনও নাই । নিরিবিলি ফ্যামিলি । সেই সময় দোকানে টিভি ভিসিপি ভাড়া পাওয়া যেত । বিনোদনের জন্য আমরা যথারীতি টিভি এবং ভিসিপি ভাড়া করলাম ।

প্ল্যান হল যে রান্নাবান্না চলার সময় আমরা ভিসিপিতে ছবি দেখবো,তারপর দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আরেক প্রস্থ সিনেমা দেখা হবে । প্রতিটি ভিডিও ক্যাসেটের ভাড়া ছিল দশ টাকা করে । তিনটি নিলে বিশ টাকা । আমরা দুইটা হিন্দি আর একটা ইংরেজী সংলাপ বিহীন চলচ্চিত্র নিলাম । আমি এই ঘটনার আগে কখনও এই ধরনের চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিত হউয়ার সু্যোগ পাইনি ।

কাজেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই মাহেন্দ্র ক্ষণের জন্য । কিন্তু কাবাবের মধ্যে হাড্ডির মত উটকো ঝামেলা হয়ে ওইদিন সকালেই গ্রাম থেকে রোকনের বড় চাচা এসে হাজির । আমরা প্রায় পনের - ষোলজন পোলাপাইন যখন হই হুল্লোরে মত্ত, ঠিক ওইসময় বগলের তলে ছাতা নিয়ে উনি এসে হাজির । কাজেই খালি বাড়ীতে নীল ছবি দেখার যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়লাম । তিনি এসেই হাঁকডাক শুরু করলেন ।

মাংস রান্নার অইখানে গিয়ে টেস্ট করার নামে বাবুর্চির কাছে থেকে একগাদা মাংস নিয়ে মজা করে খেলেন । বাসায় কেউ না থাকায় আমরা ভিডিও ক্যাসেটগুলি লুকানোর প্রয়োজন মনে করিনি । এখন বড়চাচার আগমনে ভাল বিপদে পড়লাম । তিনি বাসার ভিতরে গিয়ে টিভি ভিসিপি দেখে ব্যাপক খুশি হলেন । রোকনকে ডেকে ভিসিপি চালু করতে বললেন ।

এখন রোকন পড়লো বিপাকে । ভিসিপির ওপরেই তিনটি ক্যাসেট সাজানো। বড়চাচা খুশি হয়ে ক্যাসেট গুলি নিয়ে নড়াচাড়া করতে লাগলেন । মনে হয় এর আগে উনি ভিসিপিতে কোন সিনেমা দেখেন নাই । রোকনকে ভিসিপি চালু করতে বলে উনি আয়েস করে বসলেন ।

রোকন তার চাচাকে বলল যে এইটার হেডে ময়লা জমছে । পরিষ্কার করতে হবে । স্যাভলন আর ন্যাকড়া আনার ছুতায় সে চাচাকে বসিয়ে বাইরে এল আমাদের সাথে পরামর্শ করতে । এমন সময় আমাদের ব্যাচের সবচে আবুল হিসেবে পরিচিত মালেক ঢুকল ওই ঘরে । আমাদের সাথে মিশলেও ওর বোকামীর জন্য ওকে সবসময় একটু দূরে রাখতাম আমরা ।

আর ডাকতাম মাল+এক বলে । ওইদিন ওকে আমাদের মুভি দেখা দলের সঙ্গে না রেখে পাম্প পট্টি দিয়ে বাবুর্চির সাথে হেল্পার হিসেবে লাগিয়েছিলাম । আমাদের মনে ভয় ছিল যে ওই ব্যাটা এসব দেখে গিয়ে সবাইকে বলে দিতে পারে । ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে রোকন বের হয়ে আসার একটু পরই বেকুবটা রোকনদের রান্নাঘরে যাচ্ছিল, লবণ আনার জন্য । বারান্দা দিয়ে ফেরত যাবার সময় তার চোখে পড়ল চাচা টিভির সামনে বসে আছেন ।

কৌতূহলী হয়ে উকিঝুঁকি মারতেই চাচার কাছ থেকে সমস্যা জানা গেল । সে ম্যাকগাইভারের মত চাচাকে বলল এইটা কোন সমস্যাই না,সে এখনই ঠিক করে দিবে । বেকুবটা ভিসিপি চালু করে দিল । দিবি তো দিবি সেই নীলছবির ক্যাসেটটাই দিল । রোকনের চাচা চশমা ছাড়া চোখে ভাল দেখতেন না।

ওইটা চালু করার পর গরম দৃশ্যের অবতারনা ঘটল টিভিতে । সাথে বিকট আওয়াজে আহ উহ ইত্যাদি শব্দ শোনা গেল । আমরা যারা বাইরে এতক্ষণ রোকনের সাথে চাচাকে কিভাবে ম্যানেজ করব এই ব্যাপারে পরামর্শ করছিলাম তারা এই ধরনের আওয়াজে একেবারেই ভড়কে গেলাম । মালেক বেকুবটাও ঘটনার আকস্মিকতায় এমন হতভম্ব হয়ে গেছে যে ওইটা বন্ধ করতেও ভুলে গেছে । সবকিছু ছাপিয়ে শুনলাম চাচার গলা – “ওই রোকন,এইগুলা কি চাটেরে , এইরকম আওয়াজ কইরা কি চাটে ???” রোকনের চোখে কম দেখা বয়স্ক চাচার প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য ওইখানে ততক্ষণে কেউ নাই ।

অবস্থা বেগতিক দেখে বেশির ভাগই পিটটান দিয়েছে । পরে শুনেছিলাম রোকনই দৌড়ে গিয়ে কোনরকমে ভিসিপিটা বন্ধ করে দিয়েছিল । চাচাকে সাতপাঁচ বুঝিয়ে কোনরকমে ঠাণ্ডা করা গেলেও আসল ঘটনা আর ধামাচাপা দেয়া যায়নি । এলাকায় বিদ্যুতের মত এই খবর ছড়িয়ে পড়ল । এলাকার খালা,চাচি,আন্টিরা একজন আরেকজনের ছেলের দোষ দিতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন “আমার ভাল ছেলেটা অমুকের ছলের সাথে মিশে খারাপ হয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি ……” ।

এই ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ডে মদদ দেয়ার জন্য মকবুল হাজীর প্রতিপক্ষ সামসু কমিশনার হাজী সাহেবের নামে বিভিন্ন স্থানে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে বেড়াতে লাগলেন । হাজী সাহেবের ইলেকশনের বারোটা বাজল । আমরা আয়োজকরা বাড়িতে ব্যাপক উত্তম মধ্যম খেলাম । আর এই ধরনের আয়োজনের ব্যাপারে এলাকায় অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হল। সবচে বিপদে পড়ল রোকন ।

বাসার উত্তম মধ্যম,বকাঝকার পরও সে শান্তি পেল না। কারণ তাকে দেখলেই এলাকার পোলাপাইন অনেকদিন পর্যন্ত বলত – “ওই রোকন,এইগুলা কি চাটেরে , এইরকম আওয়াজ কইরা কি চাটে? ??” (চলবে-পাঠক ভাইয়েরা চাইলে আরও কিছু পর্ব লেখার ইচ্ছা আছে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।