আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পশুত্বের আস্ফালনঃ আংগুলে গোণা ক'টা দিন!

গতদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চেনা অচেনা অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। রাত দুপুরে আমার একজন প্রিয় ভাইকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছে, গতদিনের ঘটনার সাথে ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই। সারাদিনের অফিস শেষে ক্লান্ত পরিবারটির রাত চারটার সময় দরজা খুলতে দেরী হওয়ার অজুহাতে, বেপরোয়া ভাবে হাত তুলতে তাদের বাধেনি, তারপর কোন ধরণের অভিযোগ কিংবা তথ্যের কথা না জানিয়ে ভাইটিকে গ্রেফতার করেছে উর্দি পরা একদল পশু। মাত্র দেড় বছরের বাচ্চা নিয়ে আমার বোনের আশংকা এবং আতংকটি আমি মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারছি, বিশেষতঃ এমন একটি দেশে, যেখানে অহরহই এদের হাতে আটক মানুষেরা কেবলমাত্র স্মৃতি হয়ে যায়! তারপর, যেই মাত্র চোখের আড়ালে চলে যায় প্রিয় মানুষটি, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, সবে মাত্র বোল ফোটা সন্তান কোলে নিয়ে কোনক্রমে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া বিব্রত একটি মেয়ের সমুখে কি থাকে? সীমাহীন আঁধার। শুধুমাত্র একটু খবরের জন্য তাকে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়, কোথায় নিয়ে গেলো, কিভাবে রাখলো, থানার চারদেয়ালের মাঝেই কি আছে নাকি নিয়ে গিয়েছে কোন অজানা স্হানে? রিমান্ডে কি দিয়ে দিবে? রিমান্ডের যে সব রোমহর্ষক কাহিনীগুলো ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে, তার সবগুলো বিভীষিকা নিয়ে উপস্হিত হয় কল্পনায়...আচ্ছা, ওতো কিছুই করেনি, তাহলে কি... ওকে খুব মারবে? সবকিছু ছাপিয়ে প্রায় অগুরুত্বপূর্ণ একটি চিন্তা হয়তো প্রধান হয়ে দাঁড়ায়, বেচারাতো কিচ্ছুটি খেয়ে যেতে পারেনি, সুতরাং কিছু রেঁধে রাখাই দরকার, সকালে খবর পাওয়া মাত্র টিফিন ক্যারিয়ারটি নিতে ভুল যেনো না হয়! চেনাজানার আত্নীয় অনাত্নীয়দের মধ্যে আছে কি কেউ "যোগাযোগ"-এর যোগসুত্রটি গড়ে দিতে পারে? রক্ত, ঘাম, গালাগালি, রূঢ় রুক্ষ চেহারা আর লোলুপ চাউনির এ ক্লেদাক্ত জগতে সমবেদনা কিংবা সৌজন্যের লেশমাত্র অনুপস্হিত।

শুধু টাকাও এ জগতে প্রায় অচল- কেবলমাত্র শক্তিশালী "যোগাযোগ" কিংবা "বাঘের উপরে টাগ"-জাতীয় কোন ধরণের সংযোগ- সেই সাথে প্রয়োজনীয় ট্যাঁকের জোর মিলে যদি কিছু জানা যায়, তথ্য পাওয়া যায়... বহুঘাটের পানি খেয়ে অবশেষে জানা গেলো ভাইটি নাকি "নাশকতা" এবং "অবৈধ অস্ত্র" মামলার আসামী- এসব মামলায় জামিনও হবে না! আমার বোনটি বুঝেই পেলোনা, "অবৈধ অস্ত্র" তবে কি বাসার তরকারী কাটার বটিটা কিংবা কাঁটাচামচ- কারণ তার চেয়ে মারাত্নক আর কোন বৈধ কিংবা অবৈধ অস্ত্রের চেহারাও সে চার বছরের সংসারজীবনে দেখেনি! তার পাশের বাসা থেকেই আরো কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বর্ষীয়ান প্রবীণ কিংবা মধ্যবয়েসী- তবে কি আজকাল আমাদের বিবেচনা করতে হবে আমার প্রতিবেশীদের কার রাজনৈতিক পরিচয় কি? শুধুমাত্র নামাজের সময়ে সালাম, কিছুটা কথা এবং সৌজন্যের বিনিময়ও বোধহয় গুণে গেঁথে রাজনৈতিক পূর্বাপর বিবেচনা করে করতে হবে। প্রবীণ প্রতিবেশীকে তোলা হয়েছে আদালতে, খবর পেয়ে স্বজনেরা বুক বেঁধেছে আশায়, হয়তোবা বিচারালয়ের মাননীয় বিচারকেরা ইনসাফের মত বিরল একটি গুণ আজও ধরে রাখবেন, বিভ্রমে ভুলে থাকা সাম্প্রতিক ঘটনাবলী- মানুষ কি আর নেই কেউ কেউ! নিকষ আঁধার নেমে আসে তাদের ক্ষীণ আশায় বাঁধা বুকে, যখন জানতে পারেন যে- প্রায় তিন সপ্তাহের রিমান্ডের যোগ্য মনে করে তা মঞ্জুর করেছেন কালো কোট পরা একদল বিজ্ঞ মানুষ! আর শেলের মত বেঁধে দুঃসংবাদ, বাবার খোঁজখবর করতে যে বোকা ছেলেটি আদালত প্রাংগনে ভীড় থেকে ভীড়ে দৌড়াচ্ছিল, তাকেও কোমরে দড়ি বেঁধে চালান দেয়া হয়েছে কোন এক অজানা জায়গায়, অজানা অপরাধের আসামী করে... এই মাত্র ফোনে কথা হয়েছিলো বোনটির সাথে, সারাদিনের উদ্বেগ উৎকন্ঠার সাথে লড়াই করে হেরে যাওয়া নিস্তেজ কন্ঠস্বরে কোনক্রমে বলে যাচ্ছিল নাম সাকিন- ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে, না করা অপরাধের অপরাধী কিনা, তা জানার জন্য, আর খুব ভালো মত কষে ডলে থেঁতলে পিষে রক্ত এবং অর্থ নিষ্কাশনের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে- বিজ্ঞ বিচারক! সারাদিন আদালতের চরকিপাকে ঘুরিয়ে অবশেষে আনা হয়েছে থানায়- কাকে না কাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে, কিছুটা ভাত খাওয়া দরকার! আমার বোকা বোনটি বসেছে রাঁধতে- কারণ সারাদিনের মানসিক যন্ত্রণার ধকলে ক্ষুধা নামক অনুভূতিটি এতটাই ভোঁতা হয়েছিলো, যে রান্নার কথা সেভাবে মনেই পড়েনি। আমার ভাইয়ের পরিচিত পুলিশের একজন তরুণ কর্মকর্তা, প্রায়শঃই যাকে আমরা প্রশ্নের সম্মুখীন করে বিব্রত করতাম, কিংবা আমাদের প্রশ্নবোধক ভাবনার উদ্রেক হতো- কেনো একজন বিজনেস গ্রাজুয়েট এবং মাল্টিন্যাশনালে কর্মজীবন শুরু করা একজন বিসিএস দিয়ে পুলিশের ক্যারিয়ার গড়তে চাইবে... যা হোক, তার সাথে কথা বলার পর সে নিশ্চিত করলো আমার ভাইটির অবস্হান-- কিন্তু কিঞ্চিত লজ্জিত এবং অনুতপ্ত স্বরে দেখা করতে নিষেধ করলো, অন্ততপক্ষে আজকের দিনটা যাক... এতসব নিরাশায়, হতাশায় আর কিছু না করতে পারার আত্নধিক্কারে নুব্জ্য ক্লিষ্ট হয়ে, মুখ ভরে আসে তীব্র তিক্ততায়- বিস্বাদ লেগে ওঠে সবকিছু, এমনকি সদ্য বেড়িয়ে ঘরে ফিরে আসা আমার মেয়েগুলোর ছুটে আসা এবং "আব্বু" ডাকটাও। কেবলি মনে হয়, কিছু করছি না, কিছুই করছি না- কিন্তু কিযে করার ছিলো তাও ঠিক বোধের বাইরে। কেবলি আশংকা আর নিরাশার নিরম্বু অন্ধকারেই ঘুরে ফিরে ভাবনাগুলো জড় হচ্ছে... সকল ক্ষমতার উৎস হিসেবে যে আল্লাহকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছি, রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার এবং বিচারালয়- সকল নষ্ট সিস্টেমের অনাচার থেকে মুখ ফিরিয়ে- এ বিপদে তাই তার দিকেই ফিরেছি।

পরীক্ষার প্রহর যাতে দীর্ঘতর না হয়, ধৈর্য্যের পরীক্ষায় যাতে হেরে যেতে না হয়, আর জালিমের সকল অন্যায় আর আস্ফালনের হিসেব পাই পাই যাতে বুঝিয়ে দেয়া হয়- তার তরফ থেকে, কেননা তিনিই শিখিয়েছেন, জমীনে দম্ভ ভরে আস্ফালনরত জালিমদের দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কারণ তাদের ক্ষমতার পরিধি সীমিত, এমনকি পদচারণাটুকুও গোণা গোণা ক'টা দিন মাত্র ... (কুরআন ৩: ১৯৬, ১৯৭) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।