আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্পিনোজার জীবন ও তাঁর সমসাময়িক জগৎ-২

আমার ভুবন কান পেতে রয় ... ... দ্বীপ নিভে যায় সকলই ঘুমায় মোর আঁখি রহে জাগিয়া এএম হারুন অর রশিদ (পূর্ব প্রকাশের পর) স্পিনোজা ডাচ এবং হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন এবং পরে ল্যাটিনও আয়ত্ত করেছিলেন, কিন্তু গৃহে তিনি পর্তুগিজ এবং বিদ্যালয়ে হয় পর্তুগিজ, না হয় স্পেনীয় ভাষা ব্যবহার করতেন। স্পিনোজা একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, তাঁর ডাচ এবং ল্যাটিন ভাষায় দক্ষতা পর্তুগিজ ও স্পেনীয় ভাষার ওপর দখলের সমান ছিল না। 'আমার ইচ্ছা হয় আমি যদি আপনার কাছে সেই ভাষায় লিখতে পারতাম, যে ভাষায় আমি বড় হয়েছিলাম', বলেছিলেন স্পিনোজা তাঁর এক পত্রলেখককে। ছাত্র হিসেবে স্পিনোজা ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু যে পরিশ্রম এবং কৌতূহল স্পিনোজাকে ইহুদি ধর্মশাস্ত্র 'টালমুড' সম্বন্ধে একজন অতি অভিজ্ঞ মানুষ করে গড়ে তোলে, সেই একই কৌতূহল তাঁকে এই প্রচলিত জ্ঞানের প্রকৃত ভিত্তি সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

তিনি ঈশ্বর, মানুষ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অজস্র প্রশ্ন করতে শুরু করলেন; যা তাঁকে প্রচলিত ইহুদি ধর্মের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। অবশ্য এই পথবিচ্যুতি ঘটেছিল খুব ধীরে ধীরে এবং প্রথমে তা কেউ লক্ষ্য করেনি। ১৮ বছর বয়স থেকে স্পিনোজা একজন ব্যবসায়ী হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত যিনি যথাসময়ে সিনাগগে প্রার্থনায় যোগ দেন এবং সিনাগগকে নিয়মানুগ আর্থিক অনুদানও দিয়ে থাকেন। তাই সিনাগগের সঙ্গে স্পিনোজার সরাসরি কোন সংঘাত ঘটেনি। স্পিনোজার বয়স যখন বিশের কাছাকাছি তখন তিনি অ্যামস্টারডামের ভ্যান ডেন এনডেনের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ল্যাটিন ভাষা শেখার জন্যে।

এই ভ্যান ডেন এনডেন ছিলেন একজন ধর্মত্যাগী ক্যাথলিক, একজন মুক্ত চিন্তার মানুষ, বহু ভাষাবিদ, গণিতবিদ, চিকিৎসা ও আইন উভয় শাস্ত্রেই অভিজ্ঞ। তিনি দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম, সংগীত, শিল্প এসব অনেক কিছুই জানেন এবং তাঁর সবকিছু জানার প্রচ- আকাঙ্ক্ষা অবশ্য তাঁকে কোন বিপদে ফেলেনি; কিন্তু তাঁর সাহচর্য তরুণ স্পিনোজাকে বিপদগ্রস্ত করে তুলল। প্রথমে নীরবে, পরে প্রকাশ্যে স্পিনোজা জীবন কী, ঈশ্বর কী_ এসব ব্যাপারে তাঁর মনোভাব প্রকাশ করা শুরু করলেন। প্রথমে ইহুদি সম্প্রদায় তাদের স্বর্গোদ্যানের অভ্যন্তরেই ভিন্নমত প্রকাশ দেখে হতাশা ব্যক্ত করলেন, পরে ব্যক্ত করলেন তীব্র প্রতিক্রিয়া। ১৬৫৬ সালে স্পিনোজার বাবার মৃত্যুর দু'বছরের মধ্যেই ২৪ বছরের স্পিনোজা, যিনি এখন 'বেন্টো এবং গ্যাব্রিয়েল দ্য স্পিনোজা' নামক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত, তিনি তাঁর ঈশ্বর, প্রকৃতি এবং ধর্মীয় আচার-আচরণ সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আর লুকিয়ে রাখতে চাইলেন না।

পিতাকে আর তাঁর লজ্জায় ফেলতে হবে না- এই ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে বেন্টো বারুচ স্পিনোজা তাঁর নতুন দর্শন সবার সামনে খোলাখুলি প্রকাশ করলেন। এর পরেই শুরু হয় বেনেডিকটাস স্পিনোজার একুশ বছরের বাকি জীবন, যা আর আগের আরাম-আয়েসের জীবন ছিল না। ৪. স্পিনোজার সমসাময়িক জগৎ স্পিনোজার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণকারী তাঁর ক্ষুদ্র লাইব্রেরি থেকে আন্দাজ করা যায়, তিনি তাঁর সময়ের নব্য দর্শন এবং নয়া পদার্থবিজ্ঞান সম্বন্ধে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন এবং এই দুই বিষয়ই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব বিকাশের মূল উপাদান। দেকার্ত এবং পদার্থবিজ্ঞানের গ্রন্থই ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। সঙ্গে ছিলেন হবস এবং বেকন।

স্পিনোজা ভালোভাবেই জানতেন, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক যাচাইকরণের নতুন পদ্ধতি পদার্থবিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। স্পিনাজার বেড়ে ওঠার সময় দেকার্ত এবং হবস ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত আধুনিক চিন্তাবিদ, কিন্তু তিনি নিজে নিয়মমাফিক পরীক্ষণবিদ ছিলেন না_ যেমন ছিলেন না বেকনও। তবু তিনি বিজ্ঞানে পরীক্ষণলব্ধ ফলের গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত অধ্যয়ন এবং আলোকবিদ্যায় তাঁর কাজ থেকে। দর্শনেও তাঁর সাফল্যের মূলে ছিল এই ভৌত সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনার উপস্থিতি, যার সঙ্গে যোগ হয়েছিল তাঁর শক্তিশালী স্বজ্ঞা। ভ্যান ডেন এনডেনের বিদ্যালয় এবং তাঁর প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া সুতীক্ষ্ন বিচার করার অনুঘটকই ছিল স্পিনোজার মেধাভিত্তিক বিকাশের মূল সহায়ক উপাদান।

সুতরাং বলা যায় যে এ বিদ্যালয়টি ছিল স্পিনোজার জন্য এক আদর্শ স্থান, যেখানে তিনি তাঁর মনে জাগ্রত অসংখ্য প্রশ্ন প্রকাশ্যে বা সীমিতভাবে আলোচনা করতে পারতেন। তাঁর মেধা এবং সহমর্মিতা নিয়ে ভ্যান ডেন এনডেন ছিলেন ম্পিনোজার একজন আদর্শ প্রেরণাদায়ক শিক্ষক। স্পিনোজার সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয় হয় তখন তাঁর বয়স প্রায় ৫০ এবং ২০ বছর পর ফ্রান্সে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় রাজা চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। তিনি উচ্চবিত্ত ছিলেন না বলেই বোধহয় তাঁকে গিলোটিনের সামনে হাজির করার গৌরব দেয়া হয়নি। স্পিনোজা ভ্যান ডেন এনডেনের স্কুলে এসেছিলেন ল্যাটিন শিখতে, কেননা সেটাই ছিল দর্শন ও বিজ্ঞানের মূল ভাষা।

কিন্তু তিনি শুধু ল্যাটিনই শিখলেন না, তিনি শিখলেন দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং রাজনীতি। এখানে স্পিনোজা প্রেমেরও প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলেন তাঁর ল্যাটিন শিক্ষক ক্লারা মারিয়া ভ্যান ডেন এনডেনের কাছ থেকে। এই নতুন পরিবেশে স্পিনোজার প্রশ্নপ্রবণ জিজ্ঞাসু মন পুরাতন সব ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে গেল। স্পিনোজা টালমুড এবং টোরাহ্ ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন এবং অ্যামস্টারডামের পর্তুগিজ ইহুদিদের মধ্যে জনপ্রিয় সেফারডীয় ঐতিহ্যের কাব্্বালাহ গ্রন্থের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। সুতরাং সংঘর্ষ যখন ঘটল তখন তা নাটকীয়ভাবেই ঘটল।

প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে বিভিন্ন দৈব- ঘটনা বা অতিপ্রাকৃতের কথা বলা হয়, কিন্তু এসব মিরাকলের ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দেয়া সম্ভব। অবশ্য বিশ্বাসীর কাছে এসব রহস্য ছিল ঐশ্বরিক ব্যাপার, যা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সুতরাং সংঘর্ষ ছিল অবশ্যম্ভাবী, যা স্পিনোজার ব্যক্তিগত জীবনযাপনের জিজ্ঞাসা-প্রবণতা আরও নিকটবর্তী করে তোলে। স্পিনোজার মা যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স মাত্র ৬ এবং মার এ মৃত্যু বালকের জীবনের ওপর এক গভীর ছায়া ফেলে। তরুণ স্পিনোজা তাঁর বাবার ব্যবসায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন এবং জীবনের কঠোর বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন।

এভাবেই স্পিনোজা অল্প বয়স থেকেই কুসংস্কার এবং অযৌক্তিক কথাবার্তা ঘৃণা করতে শেখেন, যা অনেক সময় তাঁর শিক্ষকদের বেশ অসুবিধার মধ্যেই ফেলে দিত। স্পিনোজা ধর্মগ্রন্থের শিক্ষা এবং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যে বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করতে থাকেন এবং এভাবেই তাঁর ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করার অভ্যাস সৃষ্টি হয়। বলা যায়, স্পিনোজা যুগেরই সৃষ্টি, পরিবেশেরই অবদান। কিন্তু স্পিনোজার মানসিক বিদ্রোহ যে ঘটনাটি দিয়ে ঘটেছিল তা হলো ইউরিয়েল দা কস্টার জীবনের শেষ কটা বছর। দা কস্টা ছিলেন স্পিনোজার মায়ের দিক দিয়ে এক আত্মীয় এবং অ্যামস্টারডামের ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব।

ঘটনাটির তারিখ ১৬৪০ (অথবা ১৬৪৭) যখন স্পিনোজার বয়স ৮ (অথবা ১৫)। ইউরিয়েল জন্মগ্রহণ করেছিলেন গ্যাব্রিয়েল হিসেবে পোর্তো শহরে এবং তাঁর পরিবারও ছিল ধনী শেফারডীয় ব্যবসায়ী। এই পরিবার বাহ্যিকভাবে ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইউরিয়েল কইমব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করে সেখানেই অধ্যাপক হতে পেরেছিলেন। কিন্তু ইউরিয়েল তাঁর চিন্তাশীল মনোভাবের এন্যই অচিরে ক্যাথলিক ধর্মের নানা অসঙ্গতির প্রতি সজাগ হয়ে উঠলেন এবং তাঁর বংশের পুরাতন ইহুদি ধর্মের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করতে লাগলেন। যেহেতু তিনি তাঁর মনের সন্দেহ কাউকে জানাতে কার্পণ্য করলেন না, তাই তিনি এবং তাঁর মা হয়ে গেলেন কনভার্সো থেকে মার্রানো অর্থাৎ এমন খ্রিস্টান, যে গোপনে ইহুদি ধর্ম পালন করে।

যে কোন কারণেই হোক, দা কস্টা অনুভব করতে শুরু করলেন যে ভয়ঙ্কর বিচারসভার বেড়াজাল তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে এবং একদিন তিনি তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে এক জাহাজে উঠে বসলেন হল্যান্ড যাওয়ার জন্যে। অ্যামস্টারডামে এসে তিনি তাঁর পর্তুগিজ নাম গ্যাব্রিয়েল পরিত্যাগ করে হিব্রু প্রতিশব্দ ইউরিয়েল গ্রহণ করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তিনি এবার ইহুদি ধর্মের বিভিন্ন আচার-আচরণ নিয়ে সমালোচনা করতে শুরু করলেন। তাঁর কথা হলো_ ধর্মীয় আচার-আচরণ সব কুসংস্কারমূলক, ঈশ্বর কখনো মানুষের মতো হতে পারেন না, মানুষের পরিত্রাণ আসতে পারে না ঈশ্বরভীতি থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব তিনি যে প্রকাশ্যে বলতেন তা-ই নয়, তিনি এসব কথা লিখেও প্রকাশ করতেন।

সুতরাং সিনাগগের পক্ষে এ ধরনের বিদ্রোহ উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তাই দা কস্টাকে প্রথমে ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়, তারপর ফিরিয়ে নেয়া হয় এবং সব শেষে পুনরায় তাঁকে ধর্মচ্যুত করা হয়। (চলবে) [লেখক : সাবেক অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।