আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিবিরের আমলনামা (১) ------‘ছাত্র সংঘ’ থেকে ‘ছাত্র শিবির’

[গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি আস্থাবান যে কোনো নাগরিকই রাজনৈতিক দল গঠন করে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কোনো গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দল, যারা বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বেই বিশ্বাস রাখে না এবং দেশটির সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে কাজ করে, তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকা উচিত কি না সে প্রশ্ন তোলাটা এখন অত্যন্ত জরুরি। ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ ও তার ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির’ এই কাজটিই করে চলেছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও জামায়াত একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এখন জেলে থাকলেও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির এখন সক্রিয় রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

কিন্তু ইসলামের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে কত ধরনের নৃশংসতা, অধার্মিকতা, কূটকৌশল আর স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কার্যকলাপ যে করে চলেছে শিবির, তা অনেকেই জানেন না। গত প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে শিবির যে ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে, তার কিছু চিত্র তুলে ধরার জন্য এ আয়োজন ‘ছাত্র শিবিরের আমলনামা’। আজ পড়–ন এর প্রথম কিস্তি। ] ছাত্র শিবির নিষিদ্ধ কোনো সংগঠন নয়, বরং দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম সক্রিয় সংগঠন। সরকার জামায়াত সম্পর্কে সক্রিয় থাকলেও শিবিরের কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতনতা চোখে পড়ার মতো নয়।

তৃণমূল পর্যায়ে শিবির তৈরি করছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। একটু অতীত ঘাঁটলেই বেরিয়ে আসে এই সংগঠনটির নানা অপকর্ম, নৃশংসতা আর অপরাজনীতির তথ্যাদি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে জঙ্গি-কার্যক্রম কমেছে বলে দাবি করা হলেও গণমাধ্যমে বারবারই উঠে আসছে নানা তথ্য, যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, দেশের ভেতরে ও বাইরে বর্তমান সরকার এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশবিরোধী যে কর্মকাণ্ড চলছে তাদের নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় এখনও রয়েছে এই সংগঠনটি। পাঠক, আসুন আমরা জেনে নিই আজকের ছাত্র শিবির কীভাবে গঠিত হয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে তাদের তৎপরতার নানা খোঁজখবর। ‘সংঘ’ কেটে ‘শিবির’ যোগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে প্রণীত ‘১৯৭২ সালের দালাল আইন’ ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে বাতিল করে দেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

দালাল আইন বাতিলের ফলে জেলে আটক প্রায় সাড়ে ১০ হাজার রাজাকার সে সময় মুক্তি পেয়ে যায়। তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের মুক্ত করে দেয় সাবেক এ সামরিক সরকার। এছাড়া যেসব রাজাকার পাঁচ বছর ধরে পালিয়ে ছিল তারাও তখন বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে আসে। এ সুযোগে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয় জামায়াত। তাদের পুরনো ‘ছাত্রসংঘ’কে নতুন করে ঢেলে সাজাতে ১৯৭৭ সালের ফেব্র“য়ারির ৬ তারিখে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয়রা মিলিত হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই সংগঠনটির কার্যক্রম প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। রাজনীতির মাঠে প্রকাশ্যে নামার প্রস্তুতি নেয় ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’ নামের দেশবিরোধী সংগঠনটি। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্র“য়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ছাত্র সংঘের নতুন নাম হয় ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির’। শুধু ‘সংঘ’ বাদ দিয়ে ‘শিবির’ যুক্ত করা হয়, আর সবকিছুই একই থাকে। পতাকা, মনোগ্রাম সবই এক।

প্রশিক্ষণব্যবস্থা, এমনকি জেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত নেতৃত্ব-কাঠামো সবই এক থাকে। মীর কাশেম আলীকে সভাপতি ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে জামায়াতের এই ছাত্র সংগঠন নতুন কার্যক্রম শুরু করে। নাম পরিবর্তনের নেপথ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের মূলশক্তি ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের হাতে। কারণ ছাত্র সংঘ মানেই তরুণ রাজাকারদের শক্তি। ১৯৭৬ সালে যখন জামায়াত রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করে তখন জামায়াতের নীতি নির্ধারকদের মনে এই ভয় ছিল যে, ছাত্র সংঘ নামটাকে হয়তো এ দেশের মানুষ একাত্তরে তাদের জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য ভুলে যাবে না।

এই চিন্তা থেকেই তারা ছাত্র সংঘের ‘সংঘ’ কেটে সেখানে ‘শিবির’ যোগ করে দেয়। দ্বিতীয়ত, জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের হিংস্র এবং পৈশাচিক কার্যকলাপ বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা স্থায়ী ঘৃণার ভাব সৃষ্টি করেছে। জামায়াত তখন ভালো করেই জানতো এই ঘৃণাটা কখনো দূর হবে না। ইসলামী ছাত্র সংঘের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে আলবদর বাহিনীর কথা চলে আসবে। ফলে সংগঠনের প্রচার-প্রচারণা বাধাগ্রস্ত হবে।

তৃতীয়ত, যদি কখনো স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তখন আইনগতভাবে ফেঁসে যেতে পারে ইসলামী ছাত্র সংঘ। সেক্ষেত্রে যাতে সংগঠনের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য জামায়াতের নেতৃবৃন্দ সংঘ নামটি কেটে ফেলে। নতুন করে স্বাধীনতাবিরোধী কার্যকলাপ নতুনরুপে এলেও তাদের কার্যকলাপ আগের মতোই থাকে। এক বছরের মধ্যেই শিবির শুরু করে তাদের প্রথম অভিযান। ১৯৭৮ সালে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভেঙ্গে ফেলার জন্য স্বাক্ষও গ্রহণ শুরু করে।

এতে ছাত্রসমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে রাতের অন্ধকারে তারা অপরাজেয় ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু সচেতন ছাত্রসমাজের প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হঠে এবং সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। এরপর একইভাবে তারা জয়দেবপুরে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। সেখানেও তারা ব্যর্থ হয়। তারপর ঢাকা ছেড়ে নিজেদের সারা দেশে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করে।

শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখলের লড়াই। একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর হাতে যেসব আলবদর রাজাকার নিহত হয় তাদের নামানুসারে বিভিন্ন সেল গঠন করে তারা তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে শুরু করে। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তারা একদিকে যেমন অস্ত্র ও অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যে কোনো স্মৃতি মুছে ফেলার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের দখলদারিত্বের রাজনীতি। এ দেশে আবার নতুন করে শুরু হয় আলবদর রাজাকার স্টাইলে তাদের খুনের রাজনীতি।

দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা রাজধানী ঢাকায় নানা কার্যক্রমে ব্যর্থ হয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধারণী মহল শিবিরকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। জামায়াতের কার্যকরী পরিষদের সভায় ১৯৭৮ সালে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, ছাত্রসংঘ নাম পাল্টিয়েও যেহেতু শিবিরের কোনো লাভ হয়নি, তাই শিবিরকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তখন জামাতের নেতৃত্ব শিবিরকে ঢাকাকেন্দ্রিক না রেখে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। তারা শিবিরকে শহরকেন্দ্রিক না রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং মফস্বল আর গ্রামকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করে। এই বিষয়টি পরবর্তী সময়ে শিবিরের উত্থানে সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।

মিশন চট্টগ্রাম ১৯৭৭ সালে শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন মীর কাশেম আলী আর সেক্রেটারি কামারুজ্জামান। ঢাকায় তাদের কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হয়ে ছাত্র শিবিরকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার মূল পরিকল্পনা করে সভাপতি ও সেক্রেটারি। মীর কাশেম আলী পাকিস্তান আমলে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘের চট্টগ্রামের সভাপতি ছিল, তাই সত্তরের দশকের শেষ দিকে শিবির যখন চট্টগ্রামে তাদের রাজনীতির সূচনা করে তখন মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামের শিবিরের রাজনীতিতে তার বাহিনীর লোকজনকেই প্রাধান্য দেয়। একাত্তরে যাদের হাত এ দেশের মানুষের রক্তে রাঙানো ছিল, সেই বর্বর খুনে বাহিনীর অনেকেই নিজেদের বাঁচাতে এবং একটি নিশ্চিত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশ্বাসে ছাত্রশিবিরে যোগ দেয়। চট্টগ্রামে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা শুরুতেই মানুষের মনে একটা আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে একাত্তরের মতো বর্বরতার আশ্রয় নেয়।

মূলত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের অস্তিতের ঘোষণা দিতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতেই তারা চট্টগ্রাম থেকেই শুরু করে তাদের হত্যার রাজনীতি। এই হত্যার রাজনীতি শুরু করা হয় শিবির নামটি শুনে মানুষ যাতে ভয় পায়, যাতে শিবিরকে সমীহ করে চলে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলো যাতে শিবিরকে রাজনীতির মাঠে প্রবেশের সুযোগ দেয়, সমীহ করে, ইসলামী ছাত্র শিবির নাম শুনে যাতে ভয়ে ছাত্ররা শিবিরে যোগ দেয় এসব কারণেই Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.