আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুরে এলাম আগ্রা ফোর্ট

আল্লাহ তা'লা বলেন, "নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমাসমূহ এবং ভাগ্য নির্ধারক শরকসমূহ অপবিত্র ও শয়তানের কাজ ছাড়া কিছুই না। অতএব, এগুলো থেকে বিরত থাক যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার। " সূরা আল মায়েদা - ৯০ ইন্ডিয়া। নানান জাতের মানুষের বসবাস। শুধু জাতের বিচারে নয়, সেখানে রয়েছে নানান ভাষা-ভাষীর মানুষ।

আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট, সংস্কৃতি আর রীতিনীতি। কোলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছিলাম ব্যবসায়ের প্রয়োজনে। ট্রেনে প্রায় ৩৩ ঘন্টার জার্নি, আমরা বাঙালি তাই এতো বড় লং জার্নিতে অভ্যস্ত নই। তার পরেও দেশ দেখার আনন্দে ট্রেনকেই প্রাধান্য দিলাম। সাথে আমার ব্যাসায়িক পার্টনার জসিম সাহেব।

ছোটবেলা থেকে হিন্দি ফ্লিম দেখতে দেখতে হিন্দিতে আমরা বেশ পারদর্শী। তাছাড়া চেহারগত দিক থেকে আমাদের মাঝে কোন আলাদা বৈশিষ্ট নাই যেটা প্রমান করে যে আমরা বাংলাদেশী। এর পরেও ট্রেন ছেড়েছে হাওড়া থেকে তাই কামরার মাঝে বেশ কয়েকজন বাঙালী পেয়ে গেলাম। আমাদের ট্রেন ছুটে চলেছে রাজধানী দিল্লীর উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ পথ দেখতে দেখতে পেছনে ফেলে ছুটে চলেছি সামনের দিকে।

দুই পাশের অবারিত সবুজ আর সবুজ, বাংলাকে যদি বলি "দ্যা মাদার অফ নেচার" তাহলে ইন্ডিয়া তার অন্যতম দাবীদার। এতো বিশাল বিশাল মাঠ চোখে পড়ে যার শেষ প্রান্ত খালি চোখে ধরা পড়ে না। মাঠের মাঝে রয়েছে প্রচুর ফলের গাছ, বিশেষ করে আমগাছ। কখন যে সন্ধা ঘনিয়ে রাত নেমে এলো টেরই পেলাম না। ট্রেনের যাত্রীরা যার যার মতো করে বসে আছে।

কেউ বা ঘুমিয়ে নাক ডাকছে আর কেউ বা বসে পান চিবোচ্ছে। সব মিলিয়ে বেশ ভালই লাগছিল। পরেরদিন দুপুর গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা যখন তিন ছুঁই ছুঁই কামরার ভিতরে থাকা আমাদের সহযাত্রী জ্যাঠা জানান দিলেন একটু পরেই আমরা আগ্রা ফোর্ট চলে আসব। শুধু তাই নয় ষ্টেশনে পৌঁছার পূর্বেই তাজমহল চোখে পড়বে। মনেমনে বেশ উত্তেজনা হচ্ছিল কারন ছবির পাতায় আর ইতিহাসের মধ্যমনি এই তাজমহল।

আজ আমরা স্বচক্ষে দেখতে যাচ্ছি। একটু পরেই চোখ পড়ল বিশাল দুর্গের যার চারিপাশে রয়েছে অনেক উঁচু পাচিল। সেই সাথে দুরে দাড়ানো সাদা ধবধবে পাথরের তৈরী ইতিহাসের সেই বিখ্যাত এবং সপ্তম আশ্চার্যের এক আশ্চার্য সম্রাট শাহজানের "তাজমহল" ক্যামেরা প্রস্তুত ছিল, ধামাধাম কয়েকটি শট নিয়ে নিলাম। যেহেতু আল্লাহপাক কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে তাই দুরের শটকে তেমন প্রাধান্য দিলাম না। আসলে প্রথম দেখলে যা হয় তাই আরকি !! ষ্টেশনে পৌঁছে গেলাম বিকাল নাগাদ।

প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা এই আগ্রা ফোর্ট ষ্টেশনে সেই সাথে রয়েছে দালালদের দৌরত্ম। কে কিভাবে কাকে করায়ত্ব করতে পারে তার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা। আমাদের লাগেজ ব্যাগ দেখেই বেশ কয়েকজন কাছে ছুটে এলো। "স্যার আপকা হোটেল জানা হে? মে আপকো ইনতেজাম করুঙ্গা, মেরা সাথ চলিয়ে প্লিজ। মে আপলোকগকা পুরি সে পুরি আগ্রা গুমাওঙ্গা একদম সস্তামে, চলিয়ে স্যার হামারা সাথ চলিয়ে।

" চারিদিক থেকে এমন কথা শুনে আমরা কিছুটা ভ্যাবচ্যাকা কারন কোলকাতা দেখেছি ভয়ংকর রকমের দালালের দৌরত্ম। ফ্রট, চিটার আর ধান্দাবাজদের আড্ডাখানা এই ইন্ডিয়া। ওদের ঈমান আমল একেবারে শূন্যের কোঠায়। অবশেষে আমরা দালালদের হাত থেকে রেহাই পেলাম না। একজনকে চয়েজ করে বললাম "ভাই চলিয়ে, কই সস্তা সম্তা হোটেল চলিয়ে" ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম সেলিম।

মুসলমান, তাই একটু ভরসা পেলাম। যেতে যেতে টুক টাক কথা হলো, আর যেটা বুঝতে পারলাম সে আমাদের পুরা আগ্রা ঘুরাতে চায়। সে ওখানকার স্থানীয় এবং সবজায়গা ভালোভাবে চিনে। আগ্রাতে রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান, তারমধ্যে আগ্রা ফোর্ট, তাজমহল, সম্রাট আকবরের কবরস্থান ও বেবি তাজ। সন্ধা হয়ে গেছে প্রায়, টেক্সি ড্রাইভার আমাদের একটা হোটেলে নিয়ে গেল।

সেখানে বেশ কিছু কোলকাতার বাঙালী আছে। আমাদের রুমটি বেশ ভালই, জানালা খুললে তাজমহল দেখা যায়। চটপট গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে নিলাম। রমজান মাস এবং সারাদিনের রোজা আমাদের বেশ কাহিল করে ফেলেছে। ইফতার সেরে নিচে নেমে খোঁজ নিলাম এখানে কোন ভাল রেষ্টুরেন্ট আছে কিনা সেহরী খাওয়ার জন্য।

শহরের মাঝখানে একটা ভাল রেষ্টুরেন্টের সন্ধান পেলাম যেখানে নাকি বাংলাদেশী খাবার পাওয়া যায়। ইন্ডিয়া যাবার পর থেকে পাঁচ ফোড়নের তরকারী খেতে খেতে আমাদের দু'জনের অবস্থা বড্ড কাহিল। পরেরদিন প্রথমেই যাব ফোর্ট, এরপর আকবরের সমাধি এবং তাজমহল যাবার পথে পাব বেবীতাজ। আপাতত আমাদের টার্গেট এই চার স্থপত্য। সকালে ঘুম ভেঙ্গেই হোটেলের লবিতে দেখতে পেলাম বান্দা হাজির।

টেক্সি ডাইভার সেলিম আমাদের আগ্রার অন্যতম সুন্দর নির্মানশৈলী সম্রাট আকবরের দুর্গ দেখাতে রওনা হলেন। পথিমধ্যে আমাদের বেশ কিছু টিপস দিয়ে দিলেন যা খুব কাযকরী এবং পয়সা বাঁচাতে উত্তম। ওখানে কিছু নিয়ম আছে, যেমন ধরুন বিদেশী পর্যাটকদের টিকিট দু'শো রুপি আর ইন্ডিয়ানদের জন্য মাত্র বিশ রুপি। যদি ওখানে প্রমান করা যায় আমরাও ইন্ডিয়ান তাহলে বেশ টাকা সেভ হয়ে যাবে। সেলীম সে-কথাই শিখিয়ে দিচ্ছিল আমাদের।

কারন আমাদের চেহারা কোলকাতার বাঙালীদের মতো, হিন্দিও জানি এক আধটু। সুতরাং ট্রাই করতে দোষ কোথায়; জসিমভাই আমাকেই ঠেলে দিলেন টিকিট কিনতে। আমি কাউন্টারে চল্লিশ রুপী জমাদিলাম। ভিতর থেকে প্রশ্ন এলো "আপ বাংলাদেশী হ্যায়?" নেহি ম্যায় কোলকত্তাসে আরাহাহু, ১০০% ইন্ডিয়ান হু মে। এই লিজিয়ে টিকিট, অন্দর আপকা আইডি চেক হোঙ্গি।

ওকে, টিকিট দে দিজিয়ে, আমারা কই প্রবলেম নেহি। ব্যাস হয়ে গেল চারশ রুপী সেভ। এবার পড়লাম গাইড বিড়াম্বনায়। দালালদের মতো চারিদিক থেকে গাইড আমাদের জেঁকে বসল। স্যার গাইড লাগেগি, হামারা ফিস মাত্র ১০০ রুপী, অন্দর বহুত কুছ হ্যায় আপলোগকা গাইড কি বিনা কুছ নেহি সমজ পায়োগি।

বহু কষ্টে এই জোঁকগুলোকে এভোয়েট করতে পারলাম। গেট থেকে ভিডিও ক্যামেরার জন্য আলাদা ৪০ রুপী টিকিট কিনতে হলো। ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখ জুড়িয়ে গেল, এই সেই স্থাপত্য যেখানে একসময় ছিল কি জাঁকজমক, ডামাডোল, হর্ষধ্বনিতে উৎফুল্ল। আজ পড়ে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে। নিঃসন্দেহে আমরা বলতে পারি আকবরের যুগ ছিল আর স্থাপত্যের যুগ।

এমন নির্মনশৈলী এখন আর চোখে পড়ে না। কি অভূতপূর্ব কারুকাজ, খোদাতালা ধ্বংস না করলে হয়তো পৃথিবীর শেষ সময়ের স্বাক্ষী হয়ে থাকরে এই স্থাপত্য। কানের কাছে যেন রাজকীয় হাক ডাক বেজে চলছিল। অনেক পর্যাটকের সমাহার এই স্থাপত্য দেখার জন্য। ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেছে সমতল সিঁড়ি।

পুরাটাই পাথরের নির্মিত, কোথাও ইট চোখে পড়ে না। ভিতরে ঢুকেই হাতের ডান পাশে রয়েছে বিশাল এক দরবার। ঠিক যেন কোন ইউনিভার্সিটির ক্লাশরুম। অসম্ভব সুন্দর, এর পর থেকে শুরু ভিতরে প্রবেশের গেট-১। ইতিমধ্যে আমরা দুইটা প্রধান গেট পার করে এসেছি।

এমন সুরক্ষিত দুর্গ আমি স্বপ্নেও কখনো দেখিনি। ঋত্মিকের "যোদ্ধা আকবর" হিন্দি সিনেমাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। ইতিহাসকে বাস্তবে রুপ দেওয়া বড়ই কঠিন, তারপরেও কল্পলোকে আমরা এই সিনেমাকেই বাস্তব বলে মেনে নেই। এই সিনেমার ডায়লগ এবং পটভুমি আমাদের পিছনে ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করে। আমরা সহজে বুঝতে পারি এখানটা কেমন ছিল, কিভাবে এখানকার লোকজন চলাফেরা করত, কোথায় কি থাকত ইত্যাদি।

ভিতরের প্রশস্ততা এতোই যে এক দিন কিছুই না এই দুর্গের কাছে। দ্রুত বেগে হাটতে লাগলাম সামনের দিকে আর মাঝে মাঝে ক্যামেররা শট। ভিডিও ক্যামেরা সাথে থাকায় বেশী সময় নষ্ট করতে চাইলাম না কারন আমাদের আরো কয়েক জায়গায় যেতে হবে আজকের মধ্যে। ভিতরের প্রবেশ করে এ কামরা থেকে ও কামরা ঘুরতে ঘুরতে পা ব্যাথা হয়ে আসছিল। কি অদ্ভুত এই ফোর্ট, এমন কারুকার্জ এ যুগে সম্ভব নয়।

এখন থেকে দেখা যায় তাজমহল। নদীর পাড়ে দাড়িয়ে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে। তিনঘন্টা যে কোথা থেকে পার হয়ে গেল টেরই পেলাম না। ফেরার সময় সংগে নিয়ে এলাম কিছু আনন্দের স্মৃতি যা আমার মনকে সারা জীবন নাড়া দিবে এ ভেবে যে, "সে যুগে এতো চমৎকার স্থাপত্য নির্মান করা কিভাবে সম্ভব?" এখন কি সম্রাট আকবরের মতো লোক পৃথিবীতে নাই? ঐ সময় সম্রাটদের ক্ষমতা কতো ছিল? কেমন ছিল তাদের জীবন ব্যাবস্থা? কতোদিন ধরে এই স্থাপাত্য নির্মান করেছিল তারা? মাথা ঘুলিয়ে যায় আমার, সবকিছু আবোল তাবোল মনে হয়। বের হতে মন চাইছিল না ওখান থেকে, তার পরেও সময়ের হাত ধরে চলতে হবে সেই হিসাবে সেলিমের সাথে রওনা দিলাম সম্রাট আকবরের সমাধীস্থলের দিকে, যেখানে শুয়ে আছে তার পরিবারের সবাই।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.