আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাইনাস গ্রহের আগন্তুক

শফিক হাসান (লেখাটি দৈনিক সমকাল, প্যাঁচআল-এ প্রকাশিত। ২২.০৮.২০১১) মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর অলিখিত উপন্যাস সাইনাস গ্রহের জীবনধারা চলছিল একই রকম, এ গ্রহ প্রতিষ্ঠার তিন হাজার কোটি বছরেও জীবনধারা ও সংস্কৃতির তেমন একটা ব্যত্যয় ঘটেনি। ঘটবেই বা কেন, গ্রহবাসীদের কোনো চাওয়াপাওয়া-ক্ষুধাতৃষ্ণা, যুদ্ধবিগ্রহ কোনো কিছুই যেখানে দৈনন্দিন জীবনে আঁচড় কাটে না, সেখানে পরিবর্তন আসার কথাও নয়। এ গ্রহের নাগরিক প্রায় এক লাখ। গ্রহের সমানই তাদের বয়স_ তিন হাজার কোটি বছর।

গ্রহে মৃত্যু-জরা-ব্যাধি বলে কিছু নেই। বিয়ে বলে কিছু না থাকায় সুবিধাই হয়েছে_ জনসংখ্যা থেকে গেছে স্থির। গ্রহটিতে প্রতি ১০ বছর পর রাজা বদলায়। ভোটাভুটির বালাই নেই। শীর্ষস্থানীয় নাগরিকরা উপযুক্ত একজনকে রাজা হিসেবে মনোনয়ন দেন।

নির্বাচিত রাজা সানন্দচিত্তে আলঙ্কারিক পদ গ্রহণ করেন। এ পদের কোনো কাজ নেই। শুধু খাওয়া আর ঘুমানো_ এমন অভিধায়ও অভিহিত করার সুযোগ নেই মোটেও। কারণ সাইনাস গ্রহে খাওয়া বা ঘুম কোনোটাই নেই! তাহলে কী করেন রাজা? কিছুই না। সাধারণ নাগরিকদের মতোই নিরুদ্বেগ, আকাঙ্ক্ষাহীন ম্যাড়মেড়ে ম্যান্দামারা জীবন তার।

এরা বেঁচে থাকে শুধু বেঁচে থাকার জন্য। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হয়ে জীবনকে অর্থবহ করে তোলার কিছুই তাদের নেই। তবে বর্তমান রাজা তিউয়েন পূর্ববর্তী রাজাদের মতো না_ একটু খেয়ালি এবং পড়ূয়া। যা কিনা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই প্রথম। কীভাবে খেয়ালি, সে কথায় পরে আসা যাবে।

আপাতত তার পড়ূয়া পরিচয়টা দেওয়া যাক। এ গ্রহে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বলে কিছু নেই। সঙ্গত কারণেই অধিবাসীরাও বই খাতা কলমের কিছুই চেনে না। কিন্তু ওই যে বললাম, রাজা খেয়ালি। খেয়ালি রাজা কীভাবে যেন বেশকিছু বই সংগ্রহ করে ফেললেন।

নিজে নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে পড়াটাও শিখে নিলেন। ভুল বানানে হলেও কবিতা লেখা তার শখের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিউয়েন বাংলা, ইংরেজি, হিব্রু এবং তুন্তু ভাষা জানেন। বিভিন্ন রকম বই পড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতি তার আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আগ্রহটা তিনি শেয়ার করেন কাছের কিছু মানুষের সঙ্গে।

তারা রাজার খেয়াল দেখে অবাক হয় কিন্তু বিরক্ত হয় না। বিরক্তি কী জিনিস তারা বোঝে না। আজ রাজা তার প্রিয় কিছু সভাসদকে ডেকে পাঠালেন। তারা এলে আলোচনার ঢঙে বললেন, 'লেখাপড়ার চর্চা না করে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ' 'লেখাপড়া? লেখাপড়া কী!' বুঝতে না পেরে আগন্তুকরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

এদের মধ্যে একজনের নাম তিনিত্রি। সে বলল, 'লেখাপড়া কী? এটা করে কী হয়?' রাজা তিনিত্রির কৌতূহল দেখে খুশি হলেন। একটা পেপার বিছিয়ে দিলেন তার সামনে। বললেন, 'এখানে কিছু লেখা আর কিছু ছবি দেখতে পাচ্ছ, এসবই হচ্ছে লেখাপড়ার ফল। ' সবাই অবাক হয়ে পেপারের দিকে তাকাল।

শিউয়াক নামের একজন বলল, 'এটা কী? 'পেপার। ' উত্তর দিলেন রাজা। 'পেপার কী?' 'সংবাদপত্র। ' 'সংবাদপত্র কী?' 'যেখানে সংবাদ ছাপানো হয়। ' 'সংবাদ কী?' শিউয়াকের বেতাল প্রশ্নে রাজা বিভ্রান্ত হলেন।

বুঝলেন, এভাবে এদের বোঝানো যাবে না। অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ফাও কথা না বাড়িয়ে তিনি কাজের কথায় এলেন_ 'আমাদের এ গ্রহের বাইরেও আরও অসংখ্য গ্রহ রয়েছে। পড়াশোনার চর্চা না থাকায় যা হয়তো আমরা জানার প্রয়োজন বোধও করি না। তেমনই একটি গ্রহের নাম পৃথিবী।

এ পৃথিবীতে আছে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা একই সঙ্গে নাজুক এবং শক্তিশালী। অর্থাৎ ধনী এবং নির্ধন বৈষম্য প্রবল। আর মাত্র ক'দিন পরই বাংলাদেশে পালিত হবে ঈদ। প্রতি বছর ঈদের আগক্ষণে জাকাত আনতে গিয়ে প্রচুর বাংলাদেশি প্রাণ হারায়।

হুড়াহুড়ি করে, মানুষের পায়ের নিচেই পিষ্ট হয় মানুষ। তথাকথিত দাতাগোষ্ঠী এভাবেই মানুষের জীবন নিয়ে মানুষকে যৎকিঞ্চিত সাহায্য দেয়। ' একটু থামলেন রাজা তিউয়েন। তারপর প্রশ্ন করলেন, 'তোমরা কি আমার কথা বুঝতে পারছ?' সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এ শব্দগুলো তাদের মেমোরিতে নেই।

একমাত্র নিনি বলল, 'জি বুঝতে পারছি, রাজামশাই। ' রাজা খুশি হলেন। যদিও নিনি সত্যিই বুঝতে পারছে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান তিনি! নিনির দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমরা বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। তুমি কী বলো?' 'ভালোই। কিন্তু কীভাবে করব?' 'আমরা ওদের অর্থসাহায্য দেব।

' 'কোত্থেকে! আমাদের কি অর্থসম্পদ বলে কিছু আছে!' 'ওদের টাকাই ওদের মাঝে বিলিয়ে দেব। ' 'মানে?' 'একটা নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেছি। এটির নাম ইগ২। এর বড় একটা খোপ আছে। সুইচ অন করলেই তাবত কালো টাকা এই খোপে এসে জড়ো হবে।

' নিনি যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করল, 'কিন্তু মহারাজ, ওদের টাকা ওদের মাঝেই যদি বিলিয়ে দিই তাহলে আমাদের ভূমিকা কী ওখানে? এর মাধ্যমে সত্যিই কি আমরা তাদের সাহায্য করতে পারব?' 'অবশ্যই। একপক্ষের অঢেল আছে অন্যপক্ষের কিছুই নেই। সম্পদের সুষম বণ্টন করতে পারলে মানুষের জীবনযাত্রা আরও সহজ করা সম্ভব। ' রবিন নামের একজন বলল, 'তো এখন আমাদের কী করতে হবে?' 'প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আমাদের কোনো একজনকে বাংলাদেশে যেতে হবে। কে যেতে চাও?' 'জি, আমি!' নিনি আগ বাড়িয়ে বলল।

'তুমি পারবে তো? বাংলাদেশ কিন্তু সহজ দেশ নয়। বিপদের ঝুঁকি পদে পদে। ' 'আপনি নিশ্চিন্তে আমার যাওয়ার এন্তেজাম করুন। ' রাজা নিনিকে একটি ফ্লাইং সসার দিয়ে, চালানোর পদ্ধতি এবং খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিলেন। তার পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত।

নির্দিষ্ট দিনে নিনি বাংলাদেশে অবতরণ করল। পরদিনই বাংলাদেশি পত্রপত্রিকায় ছোট্ট একটি সংবাদ প্রকাশিত হলো_ প্রচুর পরিমাণ বাংলাদেশি টাকাসহ ভিনদেশি আগন্তুক গ্রেফতার। বাংলাদেশে যাত্রার প্রাক্কালে নিনির চেহারা-সুরত পরিবর্তন করার পাশাপাশি তার 'মস্তিষ্কে' ল্যাংগুয়েজ কনভার্টার ইনস্টল করে দেওয়া হয়েছে। এখন সে পৃথিবীর যে কোনো ভাষা বুঝতে এবং বলতে সক্ষম। কিন্তু দুর্ভাগ্য নিনির, বাংলাদেশি পুলিশের উল্টাপাল্টা জেরা আর মারের চোটে ল্যাংগুয়েজ কনভার্টারটা কোথায় যে পড়ে গেছে টেরই পায়নি।

ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় অদৃশ্যমান ফ্লাইং সসারে চেপে সে চম্পট দিতে পারে; কিন্তু তাও পারছে না। ভয়ের চোটে কোড নম্বর ভুলে গেছে সে! ষ [অলিখিত উপন্যাসটি লিখেছেন শফিক হাসান] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।