আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিকৃত

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। বিকৃত মোহাম্মদ ইসহাক খান ১. মানুষটি একা থাকতেন। অকৃতদার।

আত্মীয়স্বজন ছিল না। তাঁর সবসময়ের সঙ্গী ছিল একটি পোষা কুকুর। পাড়াপড়শির সাথে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। কুকুরটিই ছিল তাঁর সব। আদুরে চেহারার, বড় বড় লোমে ঢাকা শরীরের, পুতুলের মতো দেখতে কুকুরটি তাঁর একমাত্র বন্ধু ছিল।

কুকুরটিকে তিনি গোসল করাতেন, খাইয়ে দিতেন, বিকেলে নিয়ে ঘুরতে বেরুতেন, এক বিছানায় নিয়ে ঘুমোতেন। এক মুহূর্ত ওকে না দেখলে সবকিছু অন্ধকার ঠেকত তাঁর। একদিন তিনি দোতলার ঘরে, জানালার ধারে বসে বই পড়ছিলেন। নিচতলায় একটা হুটোপুটির শব্দ শুনে ছুটে বেরুলেন। অমঙ্গল আশঙ্কায় বুক কাঁপছিল তাঁর।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতেই বুকের রক্ত জল হয়ে গেল। সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে আছে তাঁর প্রিয় কুকুর, গলা কাটা। গাঢ় লাল রক্ত জায়গাটা ভাসিয়ে দিয়েছে। তিনি কুকুরটির খোলা দু'চোখের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সে যেন এখনো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, অভিযোগের দৃষ্টিতে।

যেন বলছে, আমার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী। তুমি আমাকে বাঁচাতে পারো নি। মানুষটির মনে হল, তাঁর আর কেউ নেই, কিছু নেই। ২. তিনি লেখক হবার জন্য প্রাণপণ লড়ছিলেন। মনে বড় আশা ছিল, একটি উপন্যাস, একটি বড় পরিসরের গল্প লিখবেন, তারপরই সবাই চিনবে তাঁকে।

গত দু'বছর ধরে তিনি দরজা বন্ধ করে একটানা লিখে চলেছেন, বাইরে যান নি বড় একটা। পুরো মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন তাঁর উপন্যাসটির ওপর। তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল তাঁর লেখা, নাওয়া-খাওয়ার দিকে কোন দৃষ্টি ছিল না। সে রাত পুরোটাই জেগে কাটালেন তিনি, শেষ করে আনলেন লেখা। কাল সকালেই সমাপ্তি টেনে দেবেন, এমনটাই চিন্তা ছিল তাঁর।

সারারাত জেগে কলম চালানো খুব ক্লান্তিকর, কিন্তু নিজের সৃষ্টিকর্মের উত্তেজনায় তাঁর ক্লান্তি আসে নি। গল্পের সমাপ্তি দেখতে পেয়ে কেমন একটা পরিতৃপ্তি এসে ভর করলো তাঁর ওপর, তিনি আরাম করে গুটিসুটি মেরে চেয়ারের ওপরই ঘুমিয়ে পড়লেন। চোখে সুখস্বপ্ন, কালই তাঁর উপন্যাস শেষ হতে যাচ্ছে, গল্পটি পরিপূর্ণতা লাভ করতে যাচ্ছে। এত আনন্দ তিনি রাখবেন কোথায়? বড় একটা পাষাণভার যেন বুক থেকে নেমে যাচ্ছে, যেন গুরুদায়িত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছেন তিনি। কাল থেকে বিশ্রাম নেবেন তিনি, বেশ কয়েকদিন আর কলম নিয়ে বসবেন না।

বিশাল কলেবরের উপন্যাস তাঁর। লিখেছেন যত, কাটাকুটি করেছেন তার চেয়েও বেশি। ঘরের মেঝে, টেবিল ইত্যাদি ভর্তি হয়ে গেছে কাগজের স্তূপে, দলামোচড়া করে রাখা কাগজে। কত বিনিদ্র রজনী, কত পরিশ্রম, সবই এই গল্পের পেছনে দিয়েছেন। নিজের লেখার ক্ষমতা যা ছিল, তার সবটাই ঢেলে দিয়েছেন এই গল্পে, কিচ্ছুটি বাদ রাখেন নি।

টেবিলে রাখা আছে তাঁর গল্পের পাণ্ডুলিপি, পেপারওয়েট চাপা দেয়া। তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সহসা ঘুম ভেঙে যায় তাঁর, ধোঁয়ার গন্ধ নাকে আসাতে। ভয়ার্ত চোখে তিনি দেখলেন, তাঁর ঘরে আগুন জ্বলছে, পাণ্ডুলিপিটা চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, কুঁচকে কালো হয়ে যাচ্ছে শুভ্র কাগজ। নিজের সবকিছু যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে, তিনি কিছুই করতে পারছেন না।

চিৎকার করতে শুরু করলেন তিনি। আগুনের ভেতর হাত বাড়িয়ে দিলেন, বাঁচাতে চেষ্টা করলেন তাঁর লেখার পাণ্ডুলিপিটিকে, তাঁর সন্তানসম লেখাটিকে। সবাই এসে তাঁকে উদ্ধার করলো, তিনি দগ্ধ হলেন না। কিন্তু তাঁকে দেখা গেল, নিজের সন্তানের মৃত্যুর পর মানুষ যেমন বিলাপ করে, ঠিক তেমনি করে তিনি ছাইয়ের গাদায় বসে কাঁদছেন। পুড়ে যাওয়া কাগজ বুকে চেপে ধরে কাঁদছেন, ছাইগুলোতে চোখের পানি লেগে নরম হয়ে যাচ্ছে, মেখে যাচ্ছে তাঁর হাতে।

৩. ছোট্ট মেয়েটি ছিল তাঁর প্রাণ। বাসায় ফিরলেই সে "বাবা, বাবা" করে তাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তো, আর তাঁর বুকটা আনন্দে ভরে উঠত। মা'মরা মেয়েটিই ছিল তাঁর সব। সে যখন ফ্রক পরে আর চুল ঝুঁটি করে বেঁধে বাগানে ছোটাছুটি করে খেলত, সাইকেল চালাত, বারবি পুতুল বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতো, রংতুলি নিয়ে ইচ্ছেমতো কাগজের ওপর আঁকিবুঁকি করতো, তখন নিজের ছায়া দেখতে পেতেন ওর মধ্যে। সোনালী চুল আর নীল চোখের শিশুটি যেন এক টুকরো স্বর্গ নিয়ে এসেছিল তাঁর কাছে, উচ্ছল, প্রাণবন্ত একটি পরীর মতো।

আদর করে মেয়েকে তিনি ডাকতেন "মামনি" বলে। ওকে ছাড়া ভাবতে পারতেন না কিছু। বাইরে কোন গেলে চেষ্টা করতেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার। কন্যাকে পড়া দেখিয়ে দিতেন তিনি, হাসিঠাট্টা করতেন, একসাথে বসে কার্টুন দেখতেন। মেয়ে মনে করতো, বাবাই তার সব, মায়ের কথা সে ভুলেই গেছে বুঝি।

একদিন তিনি কাজে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন, হাতে ফলের ঠোঙা। ছোট্ট মেয়েটি আপেল পছন্দ করে। মেয়েকে বলেছিলেন লক্ষ্মী হয়ে থাকতে, তিনি শীঘ্রই ফিরে আসবেন। নিশ্চয়ই সে কথা রেখেছে।

লনের কাঠের দরজাটি ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। সবুজ ঘাসের ওপর কী পড়ে আছে ওটা? তিনি হাতের জিনিসপত্র ফেলে ছুটে গেলেন তিনি। প্রাণপণে চাইছিলেন, তাঁর মামনির যেন কিছু না হয়। কিন্তু মন যা চায় না, অনেক সময় তাই হয়। তিনি দেখলেন, লনের ঘাসের ওপর পড়ে আছে তাঁর মেয়ে, দেহে প্রাণ নেই।

কেউ একজন মেরে ফেলেছে ওকে, শ্বাসরোধের চিহ্ন স্পষ্ট। তিনি মেয়ের মৃতদেহ বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। মামনি আমার! সোনা আমার! মানিক আমার! আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন তিনি, দু'গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। সম্ভবত মানুষটি ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ করছেন। ৪. গত ত্রিশ বছর ধরে তিনি সংগ্রহ করে চলেছেন দুষ্প্রাপ্য আর মূল্যবান সব পুরাকীর্তি।

কোনটা কয়েকশো বছরের পুরনো, কোনটা বা হাজার বছরের। মুদ্রা, পুতুল, মূর্তি, খেলনা, বাসনকোসন, চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ এসব। কিছুই বাদ নেই। প্রতিবেশীরা এলে খুশি হয়েই দেখান তিনি, আর এসব দেখে, এসবের পেছনের ইতিহাস শুনে যখন তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়, তখন বিমলানন্দ উপভোগ করেন। এমনি করেই কেটে যাচ্ছিলো তাঁর দিন।

আনন্দে ছিলেন তাঁর পুরনো জিনিসপত্র নিয়ে। দোকানে নিয়ে বিক্রি করতে গেলে হয়তো ফুটো পয়সাও দাম পাবেন না এসবের, কিন্তু সমঝদার লোকেরা পেলে প্রতিটি জিনিস লুফে নেবে। তবে তিনি নির্লোভ মানুষ, প্রাণ ধরে কোন কিছু বিক্রি করেন না। এগুলোই তাঁর সব। পুরাকীর্তি সংগ্রাহকেরা একটু ছিটগ্রস্ত হন, নিজেদের সংগৃহীত বস্তুগুলোর প্রতি একটু বেশিই মায়া করেন, তিনিও এর বাইরে নন।

দেখতে দিলেও কাউকে ছুঁতে দেন না তিনি, বলেন, নষ্ট হয়ে যাবে। কেউ কেউ রসিকতা করে বলে, বুড়োকে দেখো, তিনি কি আশ্চর্য স্বভাবের। নিজের বউ তিন বছরের পুরনো হয়ে গেলেই আর তাকে ভাল লাগে না, আর একটা বাটি কিংবা চামচকে তিনি বলছেন দুর্মূল্য, খুব দামী! সজ্জন এই মানুষটি যখনই কথা বলতেন, যার সাথেই কথা বলতেন, তাঁর আলোচনা থাকতো এই জিনিসগুলো ঘিরে। অন্য কিছু নিয়ে কথা বলতে জানতেন না তিনি। মানুষটি কী একটা দরকারে গিয়েছিলেন বাইরে, তালা লাগাতে ভোলেন নি দরজায়।

কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন, দরজার তালা ভাঙা। তবে কি সবকিছু চুরি হয়ে গেছে? কাঁপতে কাঁপতে তিনি দরজা ঠেলে নিজের সংগ্রহশালায় ঢুকলেন। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন মাটিতে। সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে গেছে কেউ। মূল্যবান দলিলগুলো কুচিকুচি করে ছেঁড়া, মূর্তিগুলো ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে দুর্বৃত্ত।

হাজার বছরের পুরনো একটা মূর্তির মাথা ভেঙে তাঁর পায়ের কাছে পড়ে আছে, অসহায়ের মতো। তিনি বুক চেপে ধরলেন। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে তাঁর। এক দিনের নয়, দু'দিনের নয়, ত্রিশ বছরের সংগ্রহ তাঁর, সবকিছু ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। পাড়াপড়শিরা, বন্ধুবান্ধবেরা এসে তাঁকে সান্ত্বনা দিলো, বলল, যা হবার হয়ে গেছে, এখন কেঁদে আর লাভ নেই।

তিনি সান্ত্বনা পেলেন না। জীবনের চেয়েও মূল্যবান জ্ঞান করতেন যে জিনিসগুলোকে, সেগুলো সম্পর্কে "যা হবার হয়ে গেছে" জাতীয় মন্তব্য তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল না। ৫. এই যে বৃদ্ধকে দেখছেন, সে ছিল এই চারটি ঘটনার পেছনে। এক এক করে ঘটিয়েছে সে জিনিসগুলো। সেই মানুষটির প্রিয় কুকুরকে গলা কেটে হত্যা করেছে, লেখকের দু'বছর ধরে তৈরি করা পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে দিয়েছে, সেই ভদ্রলোকের শিশুকন্যাকে নৃশংসভাবে খুন করেছে, আর আরেকজনের ত্রিশ বছরের সংগ্রহশালা ভাঙচুর করে শেষ করে দিয়েছে।

ধরা পড়েছিল সে, তদন্তে বেরিয়ে পড়েছিল নেপথ্যে কে রয়েছে। নিরীহ জীবনযাপন করা, নিভৃতচারী এই বৃদ্ধের বিকৃত সব অপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল। শেষ ফলাফল কী হয়েছিল জানেন? কী? বিচার শেষে বিচারকেরা রায় দিলেন, এই বৃদ্ধ বিকারগ্রস্ত, পাগল, উন্মাদ। তার অপরাধের ধরণ হল, সে মানুষগুলোকে সেভাবেই আঘাত করেছে, যেভাবে করলে তাঁরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান। প্রিয় জিনিসগুলো থেকে বঞ্চিত করা ছিল তার পদ্ধতি, যাতে তাঁরা বেঁচে থাকবেন ঠিকই, কিন্তু আমৃত্যু মানসিক যন্ত্রণায় পুড়বেন।

অতঃপর বিচারকেরা রায় দিলেন, তাকে এখানে পাঠিয়ে দিলেন, চিকিৎসার জন্য। সেদিন থেকে সে এখানেই আছে, আর আসা অবধি মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে, একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। আপনি কী বলেন? তাকে দেখে মনে হয় সে এসব কাজ করেছে? একটু দূরে চুপচাপ বসে থাকা, কপালে ভাঁজ পড়া, সৌম্যদর্শন, নিতান্ত সাধারণ চেহারার বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়ে ডক্টর সিম্পসন ঢোক গিললেন। (৩ মার্চ, ২০১৩) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৯ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।