আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কালপুরুষ, ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমি সত্য জানতে চাই একুশের প্রথম সংকলনে লেখা ‘কোন এক মাকে’ কবিতার কবি, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তিনি একাধারে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, মন্ত্রী, কবি ও গীতিকার ছিলেন। কর্ম জীবনে সুনামের সঙ্গে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ২০০১ সালের ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। কিংবদন্তির কবির মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

১৯৩৪ সাল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য তখন পটে বসছে। বিশ্বের দিকে দিকে স্বাধিকার আন্দোলনের দাবীতে ব্রিটিশ শোষণে অতিষ্ট বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে উঠছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থির ডামাডোল পেরিয়ে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সমগ্র বিশ্ব তখন এক অস্থির আশংকায় কম্পমান। এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর শুদ্রাখাদি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পুরো নাম আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ খান, ডাকনাম সেন্টু। (স্পিকার আব্দুল জব্বার খান) বাবা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন বিচারক। হাইকোর্টের জজ হিসাবে তিনি অবসর নেন। পরবর্তীতে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার হন। মা সালেহা খাতুন ছিলেন গৃহিনী।

অল্প বয়সে তাঁর মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নতুন মা নিজেকে সত্‍ মা হিসেবে কখনও বুঝতে দেননি তাঁদের। ফলে সহোদর ভাই বোন এবং সত্‍ ভাই বোনের কোন ভেদরেখাও ছিলনা তাঁদের। আট ভাই পাঁচ বোনের সকলেই ছিলেন মেধাবি, একনিষ্ট এবং কর্মঠ। ফলে তাঁরা আজ সকলেই নিজ নামে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত।

তাঁর এক বোন বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাহসী কন্ঠস্বর সাবেক মন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান। তাঁর ভাইদের মাঝে রয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক 'হলিডে' সম্পাদক মরহুম এনায়েত উল্লাহ খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক সাদেক খান, ছোট ভাই মাহীদুল্লাহ খান বাদল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনি আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। তাঁর আর এক ভাই বাংলাদেশের বাম রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। (ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন) শান্ত স্বভাবের আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লেখাপড়ার প্রতি ছিলেন গভীর আগ্রহী।

পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহে আবু জাফর ওবায়দুল্লার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু। তাঁর পিতা আবদুল জব্বার খান তৎকালীন সময়ে ময়মনসিংহের জেলা জজ। তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে মাধ্যমিক, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এবং ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ হতে এম.এ. পাস করেন। এম, এ পাশ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন।

১৯৫৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১১৯৫৭ সালে অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। ১৯৫৮ সালে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসনের ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন। এ বছরই বিয়ে করেন তিনি। তাঁর স্ত্রী মাহজাবীন খান।

এই দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ে। ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গবেষণা করার জন্যে ফেলোশিপ পান আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হনলুলুর ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টারের ফেলো ছিলেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৯৭ এই ৪৩ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে তিনি বহু বৈচিত্রময় পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তিনি উচ্চপদস্থ আমলার দায়িত্বও পালন করেছেন।

১৯৮২ সালে তিনি সচিব হিসেবে অবসর নেন এবং মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারেরকৃষি ও পানি সম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করে ১৯৮৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থায়। ১৯৯৭ সালে তিনি একই সংস্থা থেকে পরিচালক হিসেবে অবসর নেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি ঢাকায় ফিরে একটি বেসরকারী সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবেও বেশ কয়েকদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।

(কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ স্মরণ মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিশুদের নৃত্য পরিবেশনা) কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কালপুরুষ। তার কবিতায় আমাদের বীরত্বগাথা যেমন উঠে এসেছে তেমনি এসেছে এ দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কথা। তাকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে ভাবা যায় না। সাতচল্লিশোত্তর বাংলা কবিতায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ একটি বিশিষ্ট নাম। দশক বিচারে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মূলত পঞ্চাশ দশকের কবি।

পঞ্চাশের দশকেই তাঁর কবি হিসেবে আবির্ভাব এবং এই দশকেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সাতনরী হার' প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। পঞাশ দশকের সঙ্গে চিহ্নিত ও ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর লেখায় সমকালীন বাস্তবতা এবং প্রকৃতির কথাই বারবার উঠে এসেছে। তিনি লোকজ ঐতিহ্যের ব্যাবহার করে ছড়ার আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। কাব্যের আঙ্গিক গঠনে এবং শব্দ যোজনার বিশিষ্ট কৌশল তাঁর স্বাতন্ত্র চিহ্নিত করে।

যদিও তিনি লোকজ ধারায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন তথাপি তাঁর কবিতায় আধুনিকতা এবং আধুনিক কবিতার আঙ্গিকের কমতি ছিল না কোন ক্রমেই। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিল তাত্‍পর্যপূর্ণ অবদান। সবধরনের কর্মকাণ্ড, মিছিল-মিটিং সবখানেই তাঁর ছিলো সরব উপস্থিতি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিলো উল্লেখযোগ্য অবদান। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে তখন শাসক গোষ্ঠী ছাত্রদের মিছিলে ১৪৪ ধারা জারি করে।

কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলি বর্ষণ করে এবং শহীদ হয় রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। ১৯৫২ সালে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। '৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে, মিছিলে, মিটিঙে তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব। '৫২-র সেই মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহীদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তাঁর মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করেছিল। সেই বেদনা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত আবেগময় কবিতা কবিতা 'কোন এক মাকে'।

যা তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে লিখেছেন। এছাড়াও রয়েছে 'মাগো ওরা বলে' উল্লেখযোগ্য কবিতা, যা ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ১৯৫২ সালের মহান একুশে ফেব্রুয়ারির পটভূমিকায় রচিত। নিম্নে 'মাগো ওরা বলে' কবিতাটির কিয়দংশ তুলে ধরছিঃ 'কুমড়ো ফুলে-ফুলে নুয়ে পড়ছে লতাটা, সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি। খোকা তুই কবি আসবি? -------------------- মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে।

তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না। ' আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। পরবতীতে তাঁর কবিতায়ও এর প্রতিফলন ঘটেছিলো বিভিন্নভাবে। 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি' কবিতায় কবির স্বাধীনচেতা ভাবের পরিস্ফুটন ঘটেছে। প্রকৃতির রূপ ও রঙের বিচিত্রিত ছবিগুলো তাঁর কবিতাকে মাধুর্যমন্ডিত করেছে।

তাঁর দুটি দীর্ঘ কবিতা আমি কিংবদন্তির কথা বলছি এবং 'বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা' আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে অভূতপূর্ব সংযোজন। কবির প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থঃ সাতনরী হার (১৯৫৫), কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০), কমলের চোখ (১৯৭৪), আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি (১৯৮১), সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২), প্রেমের কবিতা (১৯৮২), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩), আমার সময় (১৯৮৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১), আমার সকল কথা (১৯৯৩), মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ প্রভৃতি৷ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর সফল কর্মকাণ্ডের জন্যে জীবত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। (কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পুরস্কার-২০১০' পেলেন ১৯ গুণীজন) বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ফাউন্ডেশন ২০০৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এ পদক প্রদান করে আসছে। ব্রিটিশযুগে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, পাকিস্তান যুগে যৌবন এবং বাংলাদেশে দেখেছেন নিজের পরিণতি ও সফল পরিসমাপ্তি। ত্রিকালদর্শী এই মহতী পুরুষ, মহান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রায় এক বত্‍সর অসুস্থ থাকার পর ২০০১ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর মুত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.