আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমানিশার চন্দ্রিত রূপান্তর

নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই পা চুবিয়ে উপভোগ করছিলাম ছাদের বহমান নদীটাকে। উপরে মুখ তুলে ধরতেই কাঠি আইসক্রিমের মতো গলে পড়া বৃষ্টি মুখ ভিজিয়ে দেয়। মা বেশীক্ষণ এই সুখ ধরে রাখতে দিলেন না। কিশোরীর মত হাত ধরে টেনে আনলেন। মুখে তোয়ালে মেখে দিলেন।

স্নান ঘরে অসমাপ্ত গোসলটুকু সেরে, সালওয়ার কামিজ পাল্টে, ঢুকিয়ে দিলেন নিজের ঘরে। খুব পরিচিত ঘর। বিছানায় উঠে বসলাম পা গুটিয়ে। দমকা বাতাস বইছে। রেডিওতে সেন্টারের কাটা ঘুরিয়ে দিলে স্টেশনহীন জায়গায় যেমন শো শো হাওয়ার আওয়াজ আসে - তেমন।

আমার ঘরটা ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। এখানে মিষ্টি শিমুলের ছাঁকরা ঘ্রাণ নাকে আসে বালিশ থেকে। বার্ণিশ করা চেয়ারের গন্ধ আসে । আপুর বিয়ের সময় নতুন সোফা কেনা হয়। চেয়ার টেবিলটাও নতুন হয়।

তখন বাড়িটা সাজিয়েছিল। পারফিউমের সুগন্ধে মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। ওরা বলল সাদা পোশাকে আমাকে পরীর মত লাগছিল। উড়ে আসা সাদা পরীর মত। আমি তো আর সাদা পরী দেখি নি।

তবে কাল বা স্বচ্ছ পরী হলে আমাকে মানাতো। যার কোন রঙের রোশনাই থাকে না। বারান্দা ভিজে যায়। ছককাটা গ্রিলে ধরে দাড়িয়ে থাকতে আমার খুব ভাল লাগে। ভেজা না হলে চেয়ার টেনে বসে থাকতাম।

বিছানায় বসে থাকি। জানলার কাচে বাম কান চেপে ধরে বর্ষণের শীতল অনিন্দ্য তাপ উপভোগ করি। ফোটাগুলো বাড়ল মনে হয়। রাস্তা দিয়ে ভিজে বর্ষণের ভেতর একটা মোটরগাড়ির হর্ন শুনি । ফের চলমান শব্দ।

বাষ্পীয় রেলগাড়ির মতো তার অভিষেক। খস খসে কর্ণফুলীর কাগজের মত মৃদু তার বুনন। নেচে নেচে যায় কেউ - প্রথমে ডান পাশে, তারপর বামে। জানালার সার্সির ফ্রেমের পুডিং উঠে গেছে। নখে আনমনে তুলে আনি নমনীয় এক খণ্ড।

বড় ভাইয়া গান ধরেছে। মাথা পাগল মানুষ। বৃষ্টির দিন গান গাইছে - ও চাঁদ সামলে রাখ জোছনাকে। একটা হাড়ির কানায় হাত দিয়ে জেনেছিলাম কিরকম সেই রূপার বলয়। খাবার থালায় ভাত মেখে নেই।

থালার বৃত্তের প্রান্ত থেকে ঝোল মুছে নেই। মনে হয় চাঁদটাও বড় উপাদেয়। আমার একদিন নিকষ কালো আঁধারের ঘরে বিয়ে হবে। কাল একটা হাত কি আমার শরীর থেকে আঁচল সরিয়ে নেবে। আমার সঙ্গে কি সে মধুচন্দ্রিমায় যাবে? চাঁদের পাশে আমাকে দেখে তার যদি কখনো বুকে ব্যথা বাজে? মানুষের চেহারাটা জ্যামিতিময়।

ঝড়ের হলকা বের হয়ে আসে পাথুরে নাক থেকে। সুড়ঙ্গে যে বাতাসের যে প্রাণ তাই তো জীবন। ঠোট ধরে রাখে সিক্ততা। চোখের ধনুকের ভেতর এত রঙ! গালটা এমন ভাবে তৈরি যাতে সে কাঁদতে পারে। চোখ থেকে কান্না গড়িয়ে কখনোই স্বাদ-গ্রন্থিতে মিশে যায় না।

জীবিত মুখ-কাণ্ড, অথচ বড় একটা অংশই দীঘল মৃত তন্তু..যাকে ভিজিয়ে দিলে বেড়ে যায়। আমার চুল তখনও ভেজা। ডগায় নরম পানি ঝরছে। পতঙ্গের লাফ দেবার মত খুট করে শব্দ আসে। বেল বাজল।

আব্বা ছাতাটা নিয়ে ঢুকেছেন বাড়িতে। কাল ছাতা। বাদুরের ভাঁজ করা পাখনার মতো শিক। এক পাড়ার ছেলে একসময় পড়াতে আসতেন আমাকে। রিপন ভাই।

বড় ভাল মানুষ। এমন পুরুষালী কণ্ঠ আগে কখনো শুনি নি। একদিন আমার হাত মুঠোয় নিলেন। বললেন ছন্দা, আঙুলগুলো যেমন বৃক্ষদের শাখাও তেমন। তবে কোনটা চিরল কোনটা মোটা।

আর হাতের কড়ে আঙুলের উঁচু ভিতের মত হয় পাথর। পাথর জমে জমে পাহাড় হয় । পাথর অবজ্ঞায় দূরে ছুঁড়ে দেয় মানুষ। আর পাহাড়কে সমীহ করে। এজন্যই বড় হতে হয়।

আমি কি সত্যি বড় হব? চাইলেই কি পাথরগুলো পাহাড় হয়ে যায়? - আমি বলেছিলাম। তিনি সচতুরভাবে উত্তরটা এড়িয়ে বলেছিলেন, অনেকেই হয়। পাহাড় বড় রহস্যময়। ওর ঢালে মানুষ চাষাবাদ করে, তার গুহায় মাকড়সার জাল আর তিনকোনা বাদুরকে দেখে সবাই ভীত হয়। আমি ভেজা ছাতায় হাতের তেলো স্পর্শ করে বাদুরের আর প্রাগৈতিহাসিক গুহার কথা ভাবছিলাম।

বহুদিন আগে আরেকবার ঠিক এমন বর্ষায় ভিজেছিলাম। সামান্য জ্বরে কোঁকাচ্ছিলাম। বাবা আমার পিঠে চুমু মেখে জড়িয়ে শুয়েছিল । সবুজ পাতার মত গন্ধ তার গায়ে। আমি টের পাই গন্ধটা কাছে আসছে।

আব্বা ঢুকলেন সন্তর্পণে। -মায়ের কি ঘুম পাইসে? দুপরে খাইতে আস -না আব্বা, খিদা নাই। বৃষ্টি তো, একটু থাকি। পরে যাব -ছাদে ছেড়ে দিছিলো? -জি আমার ঘন চুলের ভেতর আব্বা আঙুল বুলিয়ে দেয়। আমিও বুঝতে তে পারি বাবার হাতের মতো চিরুনি হয় না।

পাশের ঘরে মা বসে আছে। টিভি চলছে। হিন্দি গান। সানাই বাজছে। সানাইয়ের কিম্ভুত শব্দটা আমার কিছুতেই সহ্য হয় না।

কান্না এনে দেয়। মানুষ কেন এত কাঁদতে পছন্দ করে? আব্বা চলে গেলেন অন্য রুমে -হিন্দি ছবি রাখ তো, খবরটা দেখি। শুনলাম লিবিয়ায় একশত লোক মারা গেছে। -একটু দাঁড়ান, শেষ হয়ে যাবে - আম্মা বলল। -আগে তো দেখসো, দেখ নাই? কম করে হলেও পাঁচবার দেখলা -আচ্ছা নেন রিমোট - আম্মা বিরক্ত হয়, নিজের টা ছাড়া কিছুই বোঝেন না আপনে।

আম্মা গটগট করে চলে যায়। আম্মার মনে হয় স্পঞ্জের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। এক পা টেনে হাটার শব্দ হয়। আপু চলে যাবার পর আম্মা আর আব্বা প্রায়ই সামান্য বিষয়ে ঝগড়া করে। আমারও ভাল লাগে না।

তবে সুসংবাদ পাই ভাইয়ার কাছে। আমাকে বলল, -শোন, দার্জিলিং যাবে সব - দারুণ হবে -সত্যি -হ্যাঁ, কিন্তু আমার যে টেস্ট সামনে। -তাইলে কি যাবেন না? -আরে ধুর, পাহাড় মিস করবো নাকি -অনেক বড় বড় পাথর। তাই না ভাইয়া? -হুম -পড়ে যাব না উপর থেকে? শক্ত করে ধরে রাখবেন কিন্তু -বোকা মেয়ে, ওখানে পাহাড়ের উপর রাস্তা থাকে। তুই হাঁটবি তোর মত।

কত নানান শব্দ, পাখির গান, রঙবেরঙের গাছের পাতা। -আমাকে কিন্তু বলে দিয়েন কেমন দেখতে। পাতাগুলো ছিঁড়ে হাতে দিলে বুঝতে পারব। আমি দেখব আমার আঙুলের চেয়ে কত বড় সেই পাতা। সেদিন রাতটা আমি দার্জিলিং স্বপ্ন দেখলাম।

কালোর ভেতর সাদা সাদা রেখাচিত্র। বড় বড় পাথর। আমার হাতের চেয়ে অনেক বড়। অনেকগুলো আঙুল, হরিণের ডাক, বাংলা পাঁচের মত বাঁকা সেতু। মানুষের চুলের মত চিকন রেখাগুলো হারিয়ে গেছে কোথাও।

ভাইয়া বলল ওখানে একটা মন্দির আছে। ঘুম স্টেশনের কাছে। তার ভেতর সারি সারি ঘণ্টা সাজানো। রূপকথার মত ছবি আঁকা দেয়ালে। রূপকথা তো জানি না।

জানবোও না। অন্ধকারের ভেতর থাকে যে রূপ তাকেই চিনি। আমি টেবিলে বসলাম পরদিন সকালে। ভোর বেলায় ফেরিওয়ালার শব্দ। কাক ডাকছে।

ব্রেইলের গুটি গুটি অক্ষরে একটা বই পড়ছিলাম। নাম "বিশ্ব পরিচিতি"। বেশ দ্রুত পড়তে জানি আমি উঁচু নিচু ধরে ধরে। একট পর স্কুলের গাড়ি আসবে । লাইব্রেরীতে থাকতে ভাল লাগে আমার।

ছোট পাঠাগার। রূপকথার কোন বই নেই। হয়তো অন্ধকারের অরণ্যে রূপকথার গল্প কেউ চায় না । আমি নিজেই লিখবো আমার কথাগুলো সেই বিন্দুর ছকে। স্বপ্নে দেখে ফেলা উঁচুতে হাটার দেশ - হাতের পাথরটাকে পাহাড় করে ফেলে আঙুলের কসরতে নিজের মত ।

--- ড্রাফট ১.০/ মুক্তগদ্য ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।