আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খুনোখুনির বীজগণিত নয় এটা অনেক জটিল ক্যালকুলাস

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য কিছুদিন ধরেই সাম্প্রতিক সহিংসতায় ব্যাপক রক্তপাতের ফলে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, সমবেদনা আর নিন্দার যে প্রবল ঝড় বয়ে গেছে সেই ঝড়ো হাওয়ায় অনেকেই বিভ্রান্ত দিকভ্রষ্ট হয়েছেন সেটাতে কোন সন্দেহ নাই। সহিংসতার এই ফেনমেনা বাংলাদেশে নতুন এবং অভিনব তাই এমনকি সমাজের চিন্তাশীল অংশে এই ঘটনাবলীর বিশ্লেষণে পরস্পর বিরোধী এবং বিপদজনক উপসঙ্ঘারে পৌঁছে যাচ্ছেন অনেকেই। তবে এই ফেনমেনা নিয়ে আলাপ আলোচনা, যুক্তি উত্থাপন, যুক্তি খণ্ডন যত বেশী হবে এ বিষয়ে সমাজের নৈতিক অবস্থান তত বেশী দৃঢ় হবে। যে প্রসঙ্গটি একেবারেই আলচনায় আসেনি সেটা হচ্ছে, ফ্যাসিবাদ, তার উত্থান, ফ্যাসিবাদের উত্থানে বুর্জোয়াদের ভুমিকা, ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলার ধরণ, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের নৈতিকতা। চলমান সহিংসতাকে সরকার বনাম জামাতের যুদ্ধ ভাবলেই প্রথমে বিশাল ভুলের সৃষ্টি হবে।

এটা রাষ্ট্রের সাথে ফ্যাসিস্টদের লড়াই। এই লড়াইকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের জন্য রাষ্ট্র এবং ফ্যাসিস্ট বলতে কী বোঝায় সেটা জানা জরুরী। ফ্যাসিবাদের উত্থান হয় যখন বুর্জোয়ারা ব্যর্থ হয়। তাদের প্রত্যক্ষ মদদেই ফ্যাসিবাদের জন্ম এবং পরিপুষ্টি। বুর্জোয়া রাজনীতিই জে এম বি কে পরিপুষ্ট করেছিল, এখনও জামাতকে বুর্জোয়া রাজনীতিই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পরিপুষ্ট করে তুলেছে।

এই লক্ষ্যে এক দল তাকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিচ্ছে আরেক দল তাকে নিষিদ্ধ করার প্রবল নৈতিক চাপ সৃষ্টি সত্ত্বেও তাকে নিষিদ্ধ না করে রাজনীতির বিপদজনক খেলা খেলবার কৌশল গ্রহণ করেছে। ফ্যাসিস্টদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্ধারক চরিত্র হচ্ছে ভয়। এই সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হল সন্ত্রাস এবং আতঙ্ক। ভীতি উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মধ্যেই এই সংস্কৃতির সূচনা, বিকাশ ও স্থায়িত্ব। ভয়ের সংস্কৃতি পরিনিতি লাভ করে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে অথবা ধর্মরাষ্ট্র বা ‘থিওক্রেটিক স্টেট’–এর প্রতিষ্ঠা।

এই ধর্মরাস্ট্র প্রতিষ্ঠাই জামাতের লক্ষ্য। ধর্মরাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধীনস্থ রাখে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ভয় উভয়কে জারি রাখার মধ্য দিয়ে। তারা ইহলৌকিক ভয় জারি রাখে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে আর পারলৌকিক ভয় জারি রাখা হয় ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। ভয়ের সংস্কৃতি ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সহায়ক হয় আরো একটি কারণে, তা হলো অসহায়ত্ব মানুষকে ধর্মাশ্রয়ী করে, তার ইহলৌকিকতাকে লুপ্ত করে। হতাশা এবং অসহায়ত্ব মানুষকে যখন ধর্মীয় ভাবাদর্শের অধীনস্থ করে ফেলে তখনই সমাজে মৌলবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে সক্ষম হয়।

“ভয়” এবং তার উপায় সন্ত্রাস ফ্যাসিস্ট মৌলবাদীদের বিকাশের অন্যতম শর্ত। যদি সেই ফ্যাসিস্ট শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকে তবে সন্ত্রাসের উৎপাদনের জন্য রাষ্ট্রের সাথে অনিবার্য সংঘাতে জড়িয়ে পরে। কেন? এটা বোঝার জন্য রাষ্ট্র এবং তার নৈতিক কর্তৃত্বের সীমানা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। রাষ্ট্র কী? রাষ্ট্র আসলে কী করে? রাষ্ট্র কী একটা গ্লোরিফাইড মিউনিসিপ্যালিটি? ওয়েবার রাষ্ট্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এই বলে The state is seen to be a set of institutions with the capacity to exercise a monopoly on the legitimate use of violence within its territory, the existence of any parallel authority in this regard is a testimony of state’s weakness. ঠিক এই জায়গাতেই রাষ্ট্রের সাথে মিউনিসিপ্যালিটির তফাৎ। বল প্রয়োগের এই নিরঙ্কুশ অধিকার রাষ্ট্র পায় তার নাগরিকদের কাছে থেকে।

ধরুন আমাকে যদি কেউ ঢিল ছোড়ে আমি তো তাকে পাটকেল ছুড়তে ছুটে যাইনা। কিন্তু পাটকেল ছুড়ে দেয়াটা আমার সার্বভৌম অধিকার। আমরা আমাদের পাটকেল ছোড়ার সার্বভৌম অধিকার রাষ্ট্রের কাছে অর্পণ করে রাষ্ট্রকে সার্বভৌম করে তুলি। রাষ্ট্র যে বল প্রয়োগ করে সেটা জনগনের শক্তি। এই শক্তি ভুল ভাবেও প্রযুক্ত হতে পারে অস্বীকার করছি না কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংসতার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শক্তি প্রয়োগে রাষ্ট্রকে বাধ্য করা হয়েছে।

রাষ্ট্রের উপর জামাত একটা ঘোষিত যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এই সহিংসতায় জামাতের লক্ষ্য ছিল ভয়ের উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদন, বল প্রয়োগে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করা ফলে রাষ্ট্রকে দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত করা, রাষ্ট্রযন্ত্রের দৃশ্যমান কাঠামোকে আক্রমন করা এবং রাষ্ট্রের দুর্বল জনগোষ্ঠীকে যাদের রাষ্ট্রের সুরক্ষা দেয়ার কথা ছিল তাদেরকে আক্রমনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করে বশ্যতা আদায়ের চেষ্টা এবং রাষ্ট্রকে এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ বলে প্রমানিত করা। যে গৃহযুদ্ধের ঘোষণা জামাত দিয়েছে সেই যুদ্ধ তারা শুরু করেছে পুলিশের উপর আক্রমন এবং অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার মধ্যে দিয়ে। লক্ষ্য করবেন কোন ক্ষেত্রেই পুলিশের পক্ষ থেকে সামান্যতম উস্কানি ছিল না। ভিডিও তে দেখা যায় একেক জন নিরস্ত্র পুলিশকে বিশ জন মিলে লাঠি পেটা করছে।

নয়া পল্টন, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ীতে পরিকল্পিত নাশকতা, খেয়াল করলে দেখবেন সেই নাশকতার আগে কোন পুলিশ পর্যন্ত সেসব জায়গায় মোতায়েন ছিল না। রাষ্ট্রীয় ভবনে আক্রমন জ্বালিয়ে দেয়া, নির্মাণাধীন রাষ্ট্রীয় ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে প্রকৌশলীকে হত্যা, পুলিশ ফাঁড়ি তে আক্রমন করে পুলিশ হত্যা করে নিজেদের রাষ্ট্রের সমান্তরাল শক্তি হিসেবে পরিচিত করার বাসনা। বিদ্যমান রাষ্ট্রচিন্তায় ফ্যাসিস্টদের এই মাত্রার সহিংসতা রাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের বৈধতা দিয়ে দেয়। এই সহিংসতার লক্ষ্য কী? সেই লক্ষ্য কী ন্যায়সঙ্গত? জামাতের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে তাদের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায় মুক্তি দিয়ে আদালত ঘোষিত দণ্ড মউকুফ করা। এই দাবী কী ন্যায় সঙ্গত? সন্ত্রাস যাদের লক্ষ্য অর্জনের অস্ত্র তাদের আক্রমনের মুখে বল প্রয়োগের নৈতিক অধিকারীদের অহিংস আত্মরক্ষা কী সম্ভব? রাষ্ট্রের হাতে আইনও আছে, কিন্তু আইনের পেছনেও থাকে বলপ্রয়োগ নয়তো সে আইন কাগুজে আইন।

সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বল প্রয়োগের ক্ষমতার উপর যদি আইনের বা রাষ্ট্রের একচেটিয়াত্ব না থাকে তাহলে আইন আর আইন হিসেবে টিকে থাকতে পারেনা। আইনের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের বাইরে ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর বল প্রয়োগ বা সহিংসতা অনুমোদিত নয়। শুধু একটিমাত্র ক্ষেত্রে সন্ত্রাস অনুমোদন পেতে পারে যদি সেটা বিপ্লবী সহিংসতা হয়, যা রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন আইন তৈরি করবে। জামাতের সহিংসতা যদি বিপ্লবাত্মক ও হয় তবে তার বিরুদ্ধে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর পাল্টা অবস্থান নেবার যৌত্তিক শর্ত তৈরি হয়ে যায়।

সেই সংঘাত রক্তপাতহীন হবে সেই আশা করা দুরাশা। পৃথিবীতে কখনো রক্তপাত ছাড়া ফ্যাসিস্টদের পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি। কৃতজ্ঞতা ঃ (আলী রীয়াজ, ভয়ের সংস্কৃতিঃ বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের প্রকৃতি ও পরিসর, ঢাকাঃ সাহিত্য প্রকাশ, ডিসেম্বর ১৯৯৪) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.