আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ আশ্রম

আহ অমরত্ব, তোমার উষ্ণ ঠোঁটে রাখি ঠোঁট, চোখ বন্ধ করে সবটুকু আনন্দ ভোগ করি। তোমার উষ্ণতায় বারেবারে বিলীন হয়ে যাই, দিতে পারিনি কিছুই, শুধু নষ্ট করে যাই। একজন কি চিন্তা করছে, তা যদি তার আশেপাশে থাকা মানুষগুলো বুঝতে পারতো তাহলে কি হত চিন্তাও করা যায়না। একজনের সামনে বসে মুখে আমরা এক কথা বলছি, কিন্তু মনে মনে অন্য কিছু চিন্তা করছি। এই যেমন এখন আমি যা চিন্তা করছি, তা যদি মহারাজ জানতে পারতেন, তাহলে কি উনি আমাকে আশ্রমে রাখতেন।

মহারাজ আমাকে অনেক পছন্দ করেন। আশ্রমের প্রতি আমার টানের কারনেই আমার প্রতি মহারাজের এই ভালোবাসা। আমি আমার চিন্তা অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার ভাবনা আমার কথা শুনছেনা। বারবার দৃষ্টি মেয়েটির দিকে চলে যচ্ছে।

এই কাজটা করা আমার ঠিক হচ্ছেনা। আশ্রমে থেকে এসব চিন্তা করা ঠিক নয়। তারপরও আমি তাকে নিয়ে চিন্তা করছি, কিংবা বলা যায় আমাকে এইসব চিন্তা করতে হচ্ছে। আসলে মানুষ কখনোই হয়তো তার চিন্তা ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। চিন্তা তাকে করতেই হবে।

সে পারে চিন্তাটাকে প্রকাশ করতে কিংবা প্রকাশ রোধ করতে। আসলে ব্যাক্তি ভালো না খারাপ সেটা নির্ভর করে তার চিন্তার প্রকাশের উপর। প্রকাশ ভালো হলে ভালো, আর প্রকাশ খারাপ হলে সে খারাপ। সবাই যেমন ভালো চিন্তা করে তেমনি খারাপ চিন্তাও করে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা একজন ভালো মানুষের চিন্তাও জঘন্যতম হতে পারে।

আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশী রঙের জামায় তাকে মনে হচ্ছে একটুকরো আকাশ। এই রঙটা যেন তার জন্যই তৈরি হয়েছে। মেয়েটি প্রতিদিন আসে পূজো দেয়ার জন্য। সে যখন দুই হাত জোর করে চোখ বন্ধ করে পূজো করে তখন তার মধ্য হতে চারদিকে একরাশ স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পরে।

আমি প্রতিদিন এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করি, কখন সে আসবে। তাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই কেন জানি আমার আশ্রমবাসী হৃদয় কেঁপে উঠেছিলো। অনেক মেয়েই আসে পূজো দিতে। কিন্তু কারো জন্যই এমন চিন্তা মনে আসেনি। সে হয়তো আমার ব্যাপারটা জানতেও পারবেনা।

আমি তার সামনে প্রকাশ করি আমার আশ্রমবাসী চরিত্র। কিন্তু আমার হৃদয় জানে তাকে দেখলে আমার হৃদয় আর আশ্রমবাসী থাকেনা। আমি সবার মাঝে প্রসাদ বিতরণ করি,তার হাতেও দেই। সে ভক্তিভরে প্রসাদ গ্রহণ করে। সে যখন আমার দিকে তাকায় ,সে কি চিন্তা করে আমি যেমন জানতে পারিনা, তেমনি সেও জানতে পারবেনা তার জন্য আমার হৃদয়ে জন্মনেয়া অনুভূতিগুলো।

সে পূজো শেষ করে চলে যায়। রেখে যায় কিছু স্নিগ্ধতা। সারাদিন আমি সেগুলো বহন করি। সারাক্ষণ তার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে। প্রথম প্রথম তার কথা ভাবলে অপরাধবোধ কাজ করতো।

কিন্তু এখন আর সেই অপরাধবোধ নেই। এখন তার কথা ভাবলে, ভালো লাগে। আসলে ন্যায় অন্যায় এখানে মূখ্য নয়। মূখ্য হল চিন্তার স্বাধীনতা, ভালোলাগার স্বাধীনতা। রাতকে দ্রুত শেষ করে দেই।

দ্রুত ভোর নিয়ে আসি। তারপর আরেকটি সকাল। তার শান্ত স্নিগ্ধতা। আমি ভুলে যাই এটা আশ্রম, আমি আশ্রমবাসী। আশ্রমে আসি আমার ব্যাক্তিগত ইচ্ছায়।

আমার বাবা মা কেউই চান নি যে আমি আশ্রমে আসি। কিন্তু ছোটবেলায় যখন তাঁদের সাথে আশ্রমে আসতাম তখন আমার আশ্রমের পরিবেশ, মহারাজের কথা সবই ভালো লাগতো। আশ্রম সব সময়ই আমাকে আকর্ষণ করতো। তাই আমি এই জীবন বেছে নিয়েছি। মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছেন।

কারণ আশ্রমে থাকতে হলে পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখা যায়না। আমি সব সম্পর্কের টান ছেড়ে আশ্রমে এসেছি। কিন্তু এখন আবার গৃহী জীবন আমাকে টানছে। আজ সকালটা ঠিক অন্যরকম। সুন্দর বিশেষণ দ্বারা আসলে ঠিক পুরোপুরি প্রকাশ করা যাবেনা।

অবশ্য প্রতিটা সকালই সুন্দর, প্রতিটা ভোরই সুন্দর। ধীরে ধীরে চারদিক আলোকিত হচ্ছে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু নেই। কেউ যদি দুই দিন ভোর দেখে তাহলে তৃতীয় দিন সে অবশ্যই ঘুম ত্যাগ করে ভোর দেখতে উঠবে। আজ সে সাদা জামা পরে এসেছে। শুভ্রতায় ঢেকে আছে সে।

ধীরে ধীরে সে প্রতিমার সামনে দাড়ায়। তার চোখ ভক্তিতে বন্ধ হয়ে আসে। সময় চলে যায়, অনেক সময়। সে তন্ময় হয়ে যায় পূজোয় আমি দাড়িয়ে আছি তার দিকে তাকিয়ে। সে চোখ খোলে আমার সামনে এসে হাত বাড়ায়।

আমি তার হাতে প্রসাদ দেই। আমি তার পিছনে বাইরে আসি। তার সামনে দাড়াই। সে কি ভাববে তা এখন আমার চিন্তায় নেই। তাকে আজ বলতে হবে কিংবা বলা যায় তাকে আজ জানাতে হবে।

"শুনুন। " "হ্যা, বলুন। " "আমি কি আপনার নামটা জানতে পারি?" "আমি দীপান্বিতা সেন। কারণটা জানতে পারি?" "আমি ছোটবেলা থেকেই স্নিগ্ধতা, শুভ্রতা পছন্দ করি। এই স্নিগ্ধতার টানেই এই আশ্রমে আসা।

এখন আমি আপনার মাঝে এই স্নিগ্ধতা খুঁজে পেয়েছি। " সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে হয়তো গুছিয়ে নিচ্ছে। যাই বলুক না কেন, সে কিছু অন্তত বলুক। "আপনি আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন , তা আমি বুঝতে পারছিনা।

" "দীপান্বিতা তোমাকে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। " সে হতবম্ভ ভাবে আমার দিকে তাকায়। সে হয়তো আমার কাছে এটা আশা করেনি। সে বলে, " কিন্তু আপনি তো আশ্রমে থাকেন। " "পৃথিবীতে কি শুধু আমাদেরই শুদ্ধ থাকতে হবে।

পৃথিবী পুরোটাই আশ্রম। এখানে প্রতিটা মানুষই পবিত্র। " সে আমার চোখে চোখ রাখে। জানিনা সে কি চিন্তা করছে, শুধু দেখি সে আমার দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ' আমি তার হাত ধরি, আমার গৃহী হৃদয় তার হাত ধরে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।