আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইসলাম বনাম চিন্তার স্বাধীনতা বা বাক স্বাধীনতা

আগুন্তক আমার এক নাস্তিক বন্ধু একদিন আমাকে বলল “ তুমি উদারমনস্ক নও” “কেন?” আমি প্রশ্ন করলাম। -তুমি কি স্রস্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস কর? -হ্যা -তুমি কি তাঁর আদেশ অনুসারে প্রার্থনা কর এবং রোযা রাখ? -হ্যা -তাহলে তুমি উদার বা মুক্ত চিন্তার লোক নও। -তুমি কিভাবে বল যে আমি মুক্ত চিন্তা করার মত লোক নই? -কারন তুমি এমন একটা শক্তিতে বিশ্বাস কর যার কোন অস্তিত্বই নেই। -আর তুমি? তোমরা কোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী? তোমার কি মনে হয়, কে বা কি এই মহাবিশ্ব, পৃথিবী এবং প্রানের সৃষ্টি করেছে? -প্রকৃতি -প্রকৃতি জিনিসটা কি?একটু ব্যাখ্যা করবে কি? - এটি এমন একটি অসীম, গোপনীয় এবং রহস্যময় শক্তি যা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায়। আমি বললাম “ তোমার কথা দ্বারা বুঝা গেল যে তুমি আমাকে এক অপরিচিত বা অপ্রকাশ্য বিশ্বাস করতে বাধা দিচ্ছ কারন তুমি চাও যে আমি আরেকটি প্রায় একি রকম অপরিচিত শক্তিতে বিশ্বাস করি।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমি নিজের স্রস্টা বা খোদা কে অবিশ্বাস করব আরেকটি প্রায় একই রকম কিন্তু মিথ্যা স্রস্টার জন্য? বিশেষ করে যখন যে বিশ্বাসটি আমাকে মানসিক প্রশান্তি এবং শক্তি যোগায়। প্রকৃতি আমার প্রার্থনার জবাবও দেবে না আবার আমার মনে প্রশান্তিও আনবেনা। উপরের আলোচনাটি আমার কয়েকটি বন্ধুর মধ্যে একজনের সাথে যারা নিজেদের মুক্ত চিন্তার অনুসারী বলে দাবি করে। তাদের কাছে মুক্ত চিন্তা বা চিন্তার স্বাধীনতা মানেই স্রস্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করার স্বাধীনতা। স্রস্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করলেই যেন মুক্ত চিন্তার অধিকারী হওয়া যায়।

এটি আসলে চিন্তার স্বাধীনতা নয়। এটি হচ্ছে নাস্তিকতার স্বাধীনতা। তাদের ধারনা অনুযায়ী “ If you are a believer than you are not a free thinker” । বিষয়টিকে এই দৃষ্টিতে দেখে তারা ইসলামকে মুক্ত চিন্তার পথে বাধা হিশেবে গন্য করে। কারন ইসলাম নাস্তিকতার বিরুদ্ধে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মুক্ত চিন্তা বা চিন্তার স্বাধীনতা আর নাস্তিকতা কি একই জিনিস? নাস্তিকতা কি চিন্তার স্বাধীনতার পূর্ব শর্ত? তারা এক্ষেত্রে প্রমান হিশেবে ইউরোপের ইতিহাস নিয়ে আসে। কিন্তু তারা ইউরোপের ইতিহাস থেকে একটি ব্যাপার অগ্রাহ্য করে যায়। তা হচ্ছে, কিছু স্থানীয় বিষয় ইউরোপে নাস্তিকতা বিস্তৃতিতে প্রভাবক হিশেবে ভুমিকা রেখেছিল। তার মানে এই নয় যে একই ব্যাপার পৃথিবীর সবখানেই ঘটবে বা ঘটতে পারে। সেসময় ইউরোপের চার্চগুলো বিজ্ঞানের বিরুদ্ধাচরণ, বৈজ্ঞানিকদের উপর দমন, পীড়ন অত্যাচার এবং স্রস্টার বানী ব্যবহার করে কিছু মিথ্যাচার করে খ্রিস্টান ধর্মের যে রূপ তুলে ধরেছিল তা মুক্তচিন্তার অধিকারী ইউরোপীয় পণ্ডিত এবং বিজ্ঞানিদের নাস্তিকতার দিকে যেতে প্রভাবক হিশেবে কাজ করেছিল এবং তারা সাধারন মানুষদেরও ধর্ম ত্যগ করে বিজ্ঞানের অনুসারী হতে প্রভাবিত করেছিল।

ইউরোপীয় পণ্ডিতরা একত্রীত হয়ে চার্চকে জানিয়ে দিল “ তোমাদের খোদাকে তোমাদের কাছেই রাখ। আমরা ঐ সৃষ্টিকর্তা কে চাই না যার নামে তোমরা আমাদের দাসত্বের শিকলে বন্ধী করতে চাও। এমন খোদাকে আমাদের দরকার নেই যার নামে তোমরা মানুষকে ভয় ভীতি এবং কুসংস্কারের শিকলে বন্ধী করছো। আমরা এক নতুন গডের সন্ধান পেয়েছি যা তোমাদের গডের বেশিরভাগ গুণাবলী এবং শক্তিমত্তার অধিকারী। কিন্তু তার কোনো চার্চ নেই আমাদের দাসত্বের শিকলে বাধার জন্য।

এই স্রষ্টা কোন নৈতিকতা, নিয়মনীতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় না যেমনটা তোমাদের গড করে। এই নতুন গড হচ্ছে বিজ্ঞান। “ কিন্তু ইসলাম এমন কোন আচরণ করে না যা মানুষকে নাস্তিকতার দিকে ধাবিত করে। ইসলাম কোন বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করে না। ইসলামের মূলকথা হচ্ছে“বলুন, তিনি আল্লাহ, এক,আল্লাহ অমুখাপেক্ষী,তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি.এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।

Sura: Al-Ikhlaas এটি একটি পরিস্কার , স্বচ্ছ সহজ সরল মতবাদ যা বস্তুবাদী এবং নাস্তিকদেরও অগ্রাহ্য করতে কষ্ট হয়। ইসলামে চার্চের মত কোন ব্যাপার নেই। নেই চার্চের প্রধানের মত কোন পদও যেমনটা ইউরোপিয়ান চার্চে ছিল। ইসলাম ধর্ম সবার জন্য এবং প্রত্যেক মুসলিম সমানভাবে এর আত্মিক, নৈতিক জ্ঞান অর্জন এবং সুবিধাভোগের অধিকার রাখে। সব মানুষই এখানে সমান এবং প্রত্যেকে নিজের কর্ম অনুযায়ী শাস্তি এবং পুরষ্কার ভোগ করে।

এ ধর্ম অনুযায়ী সবচেয়ে সম্মানিত ব্যাক্তি নিজ নিজ তাকওয়া বা আল্লাহ্‌ ভীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। সে হতে পারে যেকোনো মানুষ, যেকোনো লিঙ্গের, বর্ণের এবং শ্রেণীর। ইসলাম ধর্মে যে যত বেশী তাকওয়া সম্পন্ন সে তত বেশী আল্লাহ্‌র কাছে প্রিয়। ইসলামে ধনী গরীব সবাই সমান এবং সমান অধিকার ভোগ করে। এখানে নেতৃত্ব মানে কোন ক্ষমতা নয় দায়িত্ব যেখানে নেতাকে সবসময় তার দায়িত্বপালন এবং ন্যায়বিচার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়।

সে তার যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতা রাখে না। তাকে ইসলামের সকল নিয়ম কানুন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হয়। যখন ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন উলামা বা ইসলামী পণ্ডিতগন শাসক বা মন্ত্রী বা দেশ প্রধান হয়ে যান না। শুধুমাত্র আইন এবং নিয়মকানুন গুলো ইসলামী আইন বা শরিয়া মোতাবেক পরিবর্তিত হয়। এছাড়া আর সব ঠিক থাকে আগের মতোই।

যে যার মত আগের মতোই জীবনযাপন করতে পারেন। সব পেশা সব শ্রেণীর মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজ ঠিক ভাবেই করে যেতে পারে। অর্থনীতিবিদরা আগের মতোই দেশ ও জনগণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত করতে থাকে। শুধুমাত্র ইসলামী অর্থনীতি তাদের দিক নির্দেশনা দেয় এক্ষেত্রে। ইসলামের ইতিহাস থেকে লক্ষ্য করা যায় যে ইসলামের বিশ্বাস, আইন কানুন, নিয়ম নীতি কখনোই বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিলনা।

কোন মুসলিম বিজ্ঞানীকে তাঁর বৈজ্ঞানিক সত্য আবিস্কারের জন্য বা প্রচারের জন্য হত্যা বা অত্যচারিত নিপীড়িত হতে হয়নি। বিজ্ঞানের যেসব প্রশ্নাতীত সত্য বা fact তা কখনো ইসলামের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। ইসলাম মানুষকে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করে। ইসলাম মানুষকে মহাশূন্য, পৃথিবী মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে বলে যাতে মানুষ আল্লাহর মহত্ত এবং শক্তিমত্তা অনুধাবন করতে পারে। ইসলামে এমন কিছু নেই যা একজন মানুষকে নাস্তিকতার দিকে ধাবিত করতে পারে।

এশিয়ার নাস্তিকরা তাদের পশ্চিমা গুরুদের দ্বারা সম্মোহিত হয়ে অন্ধের মত আচরণ করে। অন্যের বিশ্বাসের উপর আক্রমণকেই তারা চিন্তার স্বাধীনতা হিশেবে ভেবে থাকেন। কিন্তু কেন তারা ধর্মের এমন বিরোধিতা করেন? তখনকার সময়ে ইউরোপের জনগণ ধর্মযাজকদের নিষ্ঠুরতা, একছত্র আধিপত্য, অন্যায় এবং কুসংস্কার হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য। কিন্তু ইসলাম যেখানে তাদের সবধরনের স্বাধীনতা দিচ্ছে যেমনটা তারা দাবী করে, তাহলে কেন তারা এর বিরোধিতা বা একে আক্রমণ করে? কারন উনারা চান কোন নিয়ম নীতিহীন জীবন ব্যবস্থা। “মুক্তচিন্তা বা মুক্তমনা বা Free Thinking “ ধারনাগুলোকে উনারা উনাদের ঢাল হিশেবে ব্যবহার করেন।

তারা ইসলামের বিরোধিতা করেন কারন ইসলাম সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থার কথা বলে। তারা ইসলামের আইনকানুন নিয়মনীতিকে স্বৈরতান্ত্রিক বলেন কারন রাষ্ট্র প্রধানের হাতে এখানে অনেক ক্ষমতা থাকে। তাই তারা বলতে চায় যে এত ক্ষমতা থাকার ফলে রাষ্ট্র প্রধান স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হয়, বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। কেউ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করে না কারন এর ফলে তাকে খোদাদ্রহি হিশেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এসব ভয়ানক মিথ্যাচার।

তাদের এসব মিথ্যা অভিযোগের জবাব কোরআনের কিছু আয়াত থেকেই দেয়া যায়। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার-মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায় ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদিগকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী। ( আল কোরআন ৪:৫৮) ইসলামের প্রথম খলিফা আবুবকর (রাঃ) যখন ইসলামের নেতৃত্ব গ্রহন করেন তখন উপস্থিত মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বলেন “ আমার অনুগত থাক যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আল্লাহ এবং নবীর অনুগত থাকি।

যদি আমি তা না থাকি তাহলে আমিও তোমাদের আনুগত্যের যোগ্য নই। “ ইসলামের ২য় খলীফা উমর (রাঃ ) বলেন “ যদি আমি ভুল হয়ে থাকি তবে অবশ্যই তোমারা আমার ভুল ধরিয়ে দেবে। “ ইসলামে খলীফা বা রাষ্ট্র প্রধানকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। জনগনের কাছে তাঁকে স্বচ্ছ এবং সঠিক থাকতে হয়। জনগণ খলীফার ভুল হলে তা বলার অধিকার রাখে।

হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেন “ "A word of Justice uttered before all unjust ruler is the greatest of Jihad (holy war)". ইসলামের ২য় খলীফা উমর (রাঃ) কে কোন প্রকার প্রলোভন, অত্যাচার ও সমালোচনা সত্যের পথ থেকে বিচলিত করতে পারনি। ধুলার তখতে বসে তিনি অর্ধ পৃথিবী শাসন করেছেন। একটি মাত্র ভৃত্যকে সাথে নিয়ে জেরুজালেম যাওয়ার পথে ভৃত্যের কষ্ট লাঘবের জন্য পালাক্রমে উটের পিঠে চড়েছেন। এবং রশি টেনে নিয়ে গেছেন। উমর (রা) এর সময় বিশ্ববিজয়ী বীর সেনাপতি খালিদের (রাঃ) প্রশংসায় মানুষ এতই বিভোর হয়ে পড়েছিল যে, যা কিনা মানুষ পূজার শামিল হয়ে যাচ্ছিল, এহেন পাপ থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য তিনি সেনাপতির পদ থেকে খালিদ (রাঃ) কে মামুলি সেনাতে পরিণত করে দিলেন।

নগর ভ্রমণে বের হয়ে ক্ষুধাতুর শিশুদের কান্না করতে দেখে, তিনি বায়তুল মাল থেকে নিজে পিঠে করে ঘি, আটা বহন করে নিয়ে গেলেন এবং শিশুদের রুটি তৈরি করে খাওয়ালেন। মদ্যপানের অপরাধে উমর (রাঃ) তার পুত্র আবু শাহমাকে নিজ হাতে দোররা মেরেছেন। অনেক ক্ষমা প্রার্থনা সত্ত্বেও তিনি তাকে ক্ষমা করেননি। উমর (রাঃ) অর্ধ জাহানের সম্রাট ছিলেন কিন্তু তিনি একটি মাত্র জামা পরিধান করতেন। ধোয়ার পরে শুকানোর অভাবে তার সাথে দেখা করার জন্য আগত মানুষদের সাথে দেখা করতে পারেননি।

এমন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোথায় দেখা গেছে? একটি সত্য কাহিনী বলছি উদাহরন স্বরূপ “হযরত উমর(রা) খলীফাতুল মুসলিমীন। মদিনা শাসনকেন্দ্র, অঘোষিত রাজধানী। পবিত্র মসজিদে মদিনা এখানেই। এই শহরেই মুসলমানদের প্রধান বিচারালয়। প্রধান বিচারপতি কাজী উবাই ইবনে কাব (রা)।

মসজিদে নববীতে মুসলমানদের অবিরাম যাতায়াত। ভিড় লেগেই থাকে। খলীফাতুল মুসলিমীন এই মসজিদেই নামাজ পড়েন। এই মসজিদের দেয়াল ঘেঁষেই হযরত আব্বাস(রা) এর ঘর। সম্পর্কে তিনি রাসূলুল্লাহ(সা) এর চাচা হন।

তাঁর ঘর আর মসজিদের নববীর মাঝে ফাঁক ছিল না। তাঁর ছাদের নালাটিও ছিল মসজিদ বরাবর। এই নালা দিয়ে বৃষ্টি হলেই পানি পড়তো। মুসল্লিদের কষ্ট হতো এতে। এই ভেবে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর(রা) নালাটি তুলে ফেললেন।

ঘটনাক্রমে হযরত আব্বাস(রা) তখন ছিলেন বাড়ির বাইরে, অন্য কোথাও। বাড়িতে এসে যখন এই কাণ্ড দেখলেন, চটে গেলেন। মামলা দায়ের করলেন মদীনার আদালতে। মদীনার এক নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছেন মুসলিম জাহানের মহান শাসক উমর(রা)। কিন্তু তাতে কি? খলীফা বলেই কি তাঁর বিচার হতে নেই? তাহলে আইন বেঁচে থকবে কার ভরসায়! কাজী উবাই মোকদ্দমা গ্রহণ করলেন।

পরোয়ানা জারী করলেন। যথাসময়ে হাজির হওয়ার আদেশ দিলেন খলীফা উমর(রা)কে। উমর(রা) প্রস্তুত। প্রহর গুনছেন। যথারীতি যথাসময়ে আদালতে হাজির হলেন।

অনুমতি চাইলেন প্রবেশের। কিন্তু অনুমতি এলো না। খবর এলো কাজী এখন ব্যস্ত। বাইরে অপেক্ষা করতে হবে। আরো দশজনের মত আদালতের আঙিনায় অপেক্ষায় রইলেন খলীফা উমর(রা) ।

কিছুক্ষণ পর অনুমতি এলো। প্রবেশ করলেন উমর(রা) । দাঁড়ালেন আসামির কাঠগড়ায় এবং বলতে চাইলেন কিছু। কিন্তু বাধা দিলেন বিচারক উবাই(রা)। বললেন- আমিরুল মুমিনীন! একটু থামুন।

আদালতের বিধান মতে আগে বাদীকে বলতে দিন। তারপর আপনি বলুন। উমর(রা) খামোশ হয়ে গেলেন। এবার বলা শুরু করলেন আব্বাস(রা)। তিনি তাঁর ঘরের পানির নালা স্থানান্তরের পুরো ঘটনা আদালতে উত্থাপন করলেন।

সবশেষে বললেনঃ"আমি এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, মর্মাহত হয়েছি, সীমাহীন দুঃখ পেয়েছি। আমার অনুরোধ, আমি আশা করবো, আদালত আমার প্রতি ইনসাফ করবেন। " - আপনি নিশ্চিত থাকুন। আপনার প্রতি ইনসাফ করা হবে। আদালতের আশ্বাস।

-আমিরুল মুমিনীন! বলুন,আপনার কি বলার আছে। আদালতের জিজ্ঞাসা। - নালাটি আমি সরিয়েছি। আমি এর দায়িত্ব নিচ্ছি। উমর(রা) বললেন।

- কিন্তু অনুমতি ছাড়া অন্যের বাড়িতে হস্তক্ষেপ করলেন কেন? সে কারণও বলতে হবে আপনাকে। -জনাব ! এই নালা বেয়ে পানি পড়তো। কখনো কখনো মুসল্লিদের কাপড়ও নষ্ট হয়ে যেত। মুসল্লিদের সুবিধা ও আরামের দিকে লক্ষ্য করেই আমি এমনটি করেছি। আমার ধারণা, আমি অন্যায় করিনি।

-এর জবাবে আপনার কিছু বলার আছে, আব্বাস? আদালতের প্রশ্ন। হযরত আব্বাস(রা) বললেনঃ অবশ্যই বলার আছে, আদালত! আমার মনে আছে, প্রিয় নবী(সা) এর হাতে লাঠি ছিল। লাঠি দিয়ে তিনি মাটিতে ক'টি চিহ্ন এঁকে দিলেন। আর আমাকে বললেন- সেই চিহ্ন অনুসরণ করে ঘর বানাতে। আমি তাই করলাম।

আমার ঘর যখন তৈরি হয়ে গেল , তখন রাসূলুল্লাহ(সা) বললেনঃ আব্বাস! আমার কাঁধের উপর ওঠ এবং এখানে পানি সরে যাবার নালাটি লাগিয়ে দাও। আমি বেয়াদবি মনে করলাম। বললাম; এ কি করে সম্ভব! হুযুর আমাকে বারবার বলতে লাগলেন। অগত্যা রাসূল(সা) এর কাঁধে চড়েই আমি নালাটি স্থাপন করেছিলাম। রাসূলের যুগে এটি সেখানেই ছিল।

প্রথম খলীফার আমলেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আপনি আমিরুল মুমিনীন, আমার সেই নালাটি উঠিয়ে ফেলেছেন। সত্যি আমি মর্মাহত। - এই ঘটনার কোন সাক্ষী আছে আব্বাস? আদালত জানতে চাইলেন। হযরত আব্বাস(রা) বললেনলঃ শুধু সাক্ষী, অসংখ্য সাক্ষী আছে।

কাজী উবাই বললেনঃ তাহলে সাক্ষী ডাকুন। ফয়সালা এখনই হয়ে যাবে। হযরত আব্বাস(রা) বাইরে গেলেন। কয়েকজন আনসারী সাহাবী(রা)সহ আদালতে প্রবেশ করলেন। তাঁরা সকলেই বললেন - হ্যাঁ, আমরা তখন উপস্থিত ছিলাম যখন রাসূল(সা) তাঁর চাচা হযরত আব্বাস(রা)কে রাসূলের কাঁধে চড়ে এই নালাটি স্থাপন করেতে বলেছিলেন।

অবনতে মস্তকে দাঁড়িয়েছিলেন এতক্ষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাসক উমর(রা) । এবার এগিয়ে এলেন ধীর কদমে হযরত আব্বাস(রা) এর কাছে। কাছে এসে অনুশোচনা জানালেন। অবনমিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন- আবুল ফযল! আমি ঘুণাক্ষরে জানতাম না এটা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(সা) স্থাপন করিয়েছিলেন। অন্যথায় আমি ভুল করেও এমনটি করতাম না।

রাসূলের নালা ওঠাবার হিম্মত কার আছে- তুমিই বল! যতটুকু হয়েছে ভুলক্রমে হয়েছে। আমার এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত এই হতে পারে, আপনি আমার কাঁধের উপর উঠে নালাটি যথাস্থানে স্থাপন করবেন। বিচারক উবাই বললেন- হ্যাঁ, আমিরুল মুমিনীন ! এটাই ইনসাফের কথা এবং আপনাকে এমনটিই করতে হবে। থমথমে পরিবেশ। রা নেই কারো মুখে।

ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আমিরুল মুমিনীন হযরত আব্বাসের বাড়ির দিকে। সকলের অপলক দৃষ্টি উমর(রা) দিকে। বিশ্বের পরাক্রমশীল শক্তি কায়সার-কিসরা-রুম-পারস্য যার তলোয়ারের কাছে পরাজিত, কম্পমান পৃথিবী যার নামে, সে উমর দেয়ালের কোল ঘেঁষে দাঁড়ালেন যেন পাথরের সিঁড়ি হয়ে। তাঁর কাঁধে চড়ে আপন ঘরের ছাদে নালা স্থাপন করছেন তাঁরই প্রজা হযরত আব্বাস(রা) পৃথিবীর কোন ইতিহাসে এর তুলনা পাওয়া যাবে কি? নিশ্চয়ই না। ইসলাম একই সাথে বাক স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, মানবতা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ সবকিছু নিয়ে এসেছে।

তারপরও কি তারা বলবেন ইসলাম স্বৈরতান্ত্রিক? এসব বলে মানুষকে ধোঁকা দেয়া হয়। সবশেষে বলতে চাই চিন্তা বা বাক স্বাধীনতার মানেই যা খুসি তা করা নয়। সত্যিকারের স্বাধীনতা মানেই ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া নয়। ইসলামই দেখিয়ে দেয় প্রকৃত স্বাধীনতার পথ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.