আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্ষণ গণমাধ্যমে

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা যাদের নিতান্ত অসভ্য বলি, ন্যুনতম কাপড় পরা আদিবাসীদের দল, তাদের সমাজে বস্ত্রের প্রচলন নেই, প্রায় নগ্ন মেয়েরা চারপাশে ঘুরলেও সেসব সমাজে ধর্ষণ হয় না বললেই চলে। এখানে, সভ্য সমাজে, মেয়েদের সাজপোশাকে ধর্ষণের উস্কানী থাকে। সভ্যতা আড়াল করতে শেখায়, নিজের নগ্নতা, নিজের বিশ্বাস, সভ্যতা এভাবেই আড়াল নির্মাণ করে, সভ্যতা ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণা শেখায়, ব্যক্তিকে সমষ্টিবিচ্ছিন্ন করে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতায় ব্যক্তি সামাজিক সামষ্টিক দায়বদ্ধতা ভুলে নিজের সম্পদ রক্ষার লড়াই করে, সম্পদ আহরণ এবং কুক্ষীগত সম্পদ রক্ষায় যুযুদ্ধমান মানুষের ভেতরে সামাজিক স্থিরতার শর্তে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে, সেসব আপাতসামাজিক স্থিরতা ব্যক্তি ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কে আড়াল নির্মাণ করে, শাররীক কামনা ও কৌমের চাহিদাপুরণে ক্রমাগত শ্রমিক সরবরাহ করতে পারে কেবলমাত্র নারীই, সভ্যতার যে পর্যায়ে নারী কৌমসম্পদ থেকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিবর্তিত হলো সে সময় যৌনসম্পর্ক স্থাপনে বিভিন্ন বিধিনিষেধের জন্ম, সেসব বিধিনিষেধ, কামনা ও কামনিবৃতির প্রয়োজনে ব্যক্তির ভেতরে সামাজিক শালীনতাবোধ জন্মায়, ব্যক্তি সভ্য ও সামাজিক হয়ে উঠতে চাওয়ায় অবশেষে যৌনাঙ্গে অসহায় ঝুলে থাকে সভ্যতা। এমন ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণা না থাকায় অসভ্য সমাজের সাথে সভ্য সমাজের এই বৈষম্য না কি ওদের কামবোধ নেই। সভ্যতা আড়াল করতে শেখায়, যে সভ্যতা পোশাক আমদানি করে সেই সভ্যতা অতীত ভুলে একই সাথে অবগুণ্ঠমমুক্তাদের দেখে কামার্ত হতে শেখায়।

সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন, নারীকে যৌনহয়রানি এবং নারী অবমাননার ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে উঠে আসছে, গণমাধ্যমে ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হলে সেটার সাথে চাটনি হিসেবে ধর্ষণের আনুমানিক বিবরণ থাকে, এভাবে আরেকদফা শ্লীলতাহানী ঘটে ধর্ষিতার, দুঃস্বপ্নের মতো অনিশ্চিত একটি দিনের শুরুতে পত্রিকা খুলে আরও বীভৎস ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার আগে এমন সীমিত যৌনশিহরণ পাঠককে চনমনে রাখতে পারে এমন ভাবনায় হয়তো সম্পাদকগণ এভাবে সংবাদ পরিবেশন অনুমোদন করেন , কালের কণ্ঠের সম্পাদক এবং লেখক ইমদাদুল হক মিলন ভিকারুন্নেসার আক্রান্ত মেয়েটির ঘটনা উপস্থাপন করতে গিয়ে আরেক দফা মেয়েটার শ্লীলতাহানি করেছেন তার কলামে, সেটা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ হয় নি, ভিকারুন্নেসার ঘটনা যেভাবে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে তা সংশ্লিষ্ঠ কারোই ভালো লাগে নি, ধর্ষিতার অসহায়ত্ব প্রকট করতে চেয়ে তাকে কিভাবে ধর্ষণ করা হলো তার আনুমাণিক বিবরণে ইমদাদুল হক মিলন একটা পর্যায়ে বাকসংযম প্রদর্শণ করেছেন, প্রথম আলোর রিপোর্টের একটা অংশ জুড়ে মেয়েটার পোশাকের বর্ননা থাকায় মনে হয়েছে পোশাকেই ধর্ষণের উস্কানি ছিলো। ভিকারুন্নেসার আক্রান্ত মেয়েটির প্রতি সহানুভুতি এবং নিজেদের আন্দোলনের সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে ফেসবুক গ্রুপ তৈরি হয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ঠ আন্দোলনকারীরা গণমাধ্যমে ধর্ষিতার এমন অশালীন উপস্থাপনে নিজেদের ক্ষোভ স্পষ্ট প্রকাশ করলেও সম্ভবত সেটা বিডিনিউজের সম্পাদকের নজরে পড়ে নি, তারা ধর্ষিতার সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে লিখেছে " গত ২৮ মে আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার পাশে 'এফ' ব্লকে ৬ নম্বর রোডের ৩৫৯ নম্বর বাসায় একতলা ভবনের একটি কক্ষে ওই স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ওই ছাত্রীকে হাত বেঁধে, মুখে ওড়না গুঁজে ধর্ষণ করেন পরিমল। " গণমাধ্যমে যখন ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয় তখন পুরুষতান্ত্রিক গণমাধ্যম মেয়েটির দুর্বলতা এবং ধর্ষকের আগ্রাসনকে পাশাপাশি তুলে আনতে চান, সেখানে সে কারণেই সংবাদভাষ্যে উপস্থাপিত হয় মেয়েটির ক্ষীণ প্রতিরোধের সংবাদ, মেয়েটি প্রতিবাদ করতে চেয়েচে, নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছে, হাত পা ছোড়াছুড়ি করেছে, ধর্ষক অধিকতর শক্তিশালী বলেই মেয়েটির সক্রিয় প্রতিরোধের পরেও ধর্ষণ হয়েছে, সুতরাং অসহায় মেয়েটির করুণা প্রাপ্য, একই ভাবে বিভিন্ন সংবাদভাষ্যে নারী নিগ্রহের সংবাদ উপস্থাপিত হওয়ার সময় বিভিন্ন শব্দের প্রায়োগিক অর্থও বদলে গিয়েছে, সুতরাং "হাত পা বেঁধে", "মুখে কাপড় গুজে", "ঘরের দরজা বন্ধ করে", "অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে", "নিভৃতে", "প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়ার পর","রাতের অন্ধকারে ", "মুখ চেপে ধরে", "একদল যুবক অস্ত্রের মুখে ভয় ভীতি প্রদর্শণ করে", "পরিবারের সদস্যদের আটকে রেখে" ধর্ষণ করতে পারে। একজন অসভ্য যুবক " উত্যক্ত করে", "মেয়েটিকে কুপ্রস্তাব দেয়", সেই কুপ্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় মেয়েটি আক্রান্ত হয়। এই কুপ্রস্তাবও শাররীক সম্পর্ক স্থাপনের মন্ত্রনা হতে পারে, এমন কি হুমকিও হতে পারে, কিন্তু "কুপ্রস্তাব" শব্দটির অন্য সকল আভিধানিক অর্থ বিলুপ্ত হয়ে গণমাধ্যমের কলয়ানে কুপ্রস্তাব নিছক শাররীক হয়ে উঠেছে, একই ভাবে "অনৈতিক সম্পর্ক", কিংবা "অনৈতিক কার্যকলাপ" শব্দগুলোর অনৈতিকতাও নিছক শাররীক এবং আরও স্পষ্ট করে বললে শাররীক সম্পর্ক স্থাপন সম্পর্কিত বক্তব্য।

আমাদের সমাজে সতী, সভ্য মেয়েদের শাররীক সম্পর্ক বিষয়ক জড়তা এবং সাংবাদিকদের নিজস্ব অনুধাবন এই দুই শব্দেই সীমাবদ্ধ। আজও পত্রিকায় সংবাদ এসেছে একজন আত্মহত্যা করেছেন, তার সাথে "জোরপূর্বক অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সেটার ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে অন্য সবাইকে দেখানোর" পর মেয়েটি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। পুলিশের এসআইও এমন অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্ররোচনা দিয়ে এবং হুমকি প্রদর্শণ করে বহিস্কৃত হয়েছে, পরিমল, এসআই, রাজশাহীদের পঞ্চাশোর্ধ একজন আদিবাসী মহিলাকে ধর্ষণ করে তার নগ্ন মৃতদেহ গাছে ঝুলিয়ে রাখা মানুষগুলো আমাদের চারপাশেই ঘুরছে, সভ্যতা নারীর আব্রু ও শাররীক বিশুদ্ধতায় অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করে নারীকে সামাজিকবিকলাঙ্গ করছে কি না তা নিশ্চিত বলা না গেলেও এটুকু বলা যায় নারীর শরীর পুরুষের আধিপত্য প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে, অনেক দিন থেকেই পুরুষ নিজের ক্ষমতা এবং আধিপত্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে নারীর শরীর, নারী পুরুষের মর্জমফিক না চললে তাকে শাররীক নির্যাতন করা হয়, প্রতিশোধ নিতে গিয়ে স্বামী সবান্ধব স্ত্রীকে ধর্ষণ করে এখানে, এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মানুষ খুব সাধারণ ভাবে বলছে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে বলেই এমন ঘটছে, নৈতিকতাও একই রকমভাবে যৌনাঙ্গ নির্ভর শব্দ হয়ে উঠতে পারে অচিরেই কিন্তু সরকার কি তার দায়িত্ব পালনে আন্তরিক? সরকারী কর্মকর্তা যখন ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন, যখন অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হন উচ্চপর্যায়ের কুটনৈতিক কর্মকর্তা, যখন ত্রান ও সামাজিক কল্যানের দায়িত্বে নিয়োজিত দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তারাও সহযোগিতার বিনিময়ে সাহায্য চাইতে আসা নারীদের শাররীক ভাবে লাঞ্ছিত করেন সেসব ক্ষেত্রে সরকার তেমন ত্বরিত প্রতিক্রিয়া দেখায় না, তাদের চারিত্রিক সনদ, তাদের পুলিশ এনকোয়ারী এবং বিভিন্ন দাপ্তরিক দাবি পুরণ করেই নিয়োগ দেওয়া হয়, এইসব " সেক্সুয়াল অফেন্ডার" কিভাবে এত যাচাই বাছাি প্রক্রিয়া অতিক্রম করে সরকারী চাকুরীতে নিযুক্ত হতে পারে? সরকারকে এই দায়টুকু স্বীকার করতে হবে। দুটো জেলার বিভিন্ন থানায় পুলিশ কিশোর কিশোরীদের মোবাইল আটক করা হয়েছে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের মোবাইলের সীম দেওয়ার নিয়ম নেই, এবং এইসব কিশোর কিশোরী বিভিন্ন যৌনাপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, মোবাইলে অনৈতিক ভিডিও ধারণ এবং মোবাইলে বিভিন্ন অনৈতিক ভিডিও বহন ও সম্প্রচারের অভিযোগ তাদের মোবাইল জব্দ করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার অভিভাবকদের হাতে মোবাইল ফেরত দিয়েছেন, কিন্তু যারা মোবাইলে এমন সম্মত ও অসম্মত সঙ্গমদৃশ্য ধারণ করছে কিংবা নিজেদের একান্ত সময়ের ভিডিওচিত্র ধারণ করছে তাদের সবাই কি অপ্রাপ্ত বয়স্ক? আজকে যে মেয়েটি আত্মহত্যা করলো সেই যুবক প্রাপ্ত বয়স্ক, অনলাইনে ফিসফাসের মতো প্রচারিত হচ্ছে অরুণ চৌধুরী এবং কোনো এক টিভিঅভিনেত্রীর ভিডিওচিত্র, অরুন চৌধুরী এবং সেই টিভিঅভিনেত্রীর ভিডিওটি এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয় কিন্তু এমন টিভিঅভিনেত্রীর ব্যক্তিগত সময়ের ভিডিওচিত্র এর আগেও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে, সেসব ভিডিওচিত্র যারা ধারণ করেছে তাদের সবাই প্রাপ্ত বয়স্ক। আমরা যদি প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতার প্রমাণ রাখতে ব্যর্থ হই তার প্রতিক্রিয়ায় সরকার কি সংশ্লিষ্ট প্রাযুক্তিক সুবিধা বাতিল করতে পারেন? অরুন চৌধুরীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সেটা ঘটনাটির একটি ডাইমেনশন মাত্র, অরুন চৌধুরী যদি কোনো সুযোগ দেওয়ার বিনিময়ে অভিনেত্রীকে লাঞ্ছিত করেন সেটা এক ধরণের অপরাধ, যদি এটি তাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ঘটে সেটা অন্য ধরণের নৈতিক সংকট।

ব্যক্তিগত জীবনযাপনে স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বস্ততার প্রতিক্রিয়ায় তাদের দাম্পত্যজীবনের সংকটগুলো মিডিয়ায় উঠে আসা বাঞ্ছনীয় নয়, কিন্তু তাদের এই ভিডিওচিত্র ধারণ করা কোন ভিত্তিতে অবৈধ কিংবা অশালীন অনৈতিক বিবেচিত হবে না? যে ব্যক্তি এই ভিডিওচিত্র ধারণ করেছেন তিনিও প্রাপ্তবয়স্ক, যদি তার মনে হতো অভিনেত্রী আক্রান্ত, তিনি নিজের ভয়েআরিজম চরিতার্থ করে ভিডিওচিত্র ধারণ না করে বরং মেয়েটিকে সহযোগিতা করতে যেতেন, তিনি যদি মনে করতেন অরুন চৌধুরী নৈতিক অপরাধ করেছেন, সম্পর্কের বিশ্বস্ততাকে অসম্মান করেছেন, তিনি সেই ভিডিওচিত্র বিভিন্নজনকে সরবরাহ না করে বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকেই দেখাতেন, তিনি হয়তো অরুণ চৌধুরির দ্বিচারিতা তুলে ধরতে পেরেছেন কিন্তু একই সাথে তিনি সংশ্লিষ্ট অভিনেত্রীকেও সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন, সেই সামাজিক নিগৃহনের ফলশ্রুতিতে তারও অভিযুক্ত হওয়ার কথা কিন্তু তাকে কেউ অনৈতিকতার দায়ে অভিযুক্ত করছে না, তার আচরণকে কেউই অগ্রহনযোগ্য মনে করছে না। এভাবেই নিজের নৈতিকতার বিভ্রান্তিতে আমাদের নারীনিগৃহনের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে প্রচারিত হলেও কোনটি নারীর সামাজিক শ্লিলতাহানী কোনটি নারীর উপরে শাররীক আগ্রাসণ, কোনটির প্রভাব কতটুকু পরতে পারে আক্রান্তের উপরে সেসব বিবেচনা না করে অবিবেচকের মতো আচরণ করছে গণমাধ্যমগুলো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।