আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রুমানা মনজুরের বাম চোখ,কেস অব আমিনা বাহরামী : হাজার বছরের ধ্বজভঙ্গ সভ্য-আইনের ভিকটিম

মেঘমুক্ত নীলাভ দিঘীর কবোষ্ণতা খুঁজছে মন! ১. রুমানা মনজুর আমার বড় বোনের কোর্স টিচার ছিলেন ঢাকা ভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। প্রথম যখন শোনা গেল একটা অমানষিক বর্বরতার শিকার তিনি, তখন এ ঘটনায় দেশের অধিকাংশের মতই স্তব্ধ হয়ে যাই আমরা, বড় বোন ক্রমাগত আফসোস করছিল, আহারে এত ভালো একজন মানুষের সাথে এই আচরণ কীভাবে করতে পারলো! তখনও জানি না তার দুই চোখই নষ্ট হয়ে গেছে, নাক কামড়ে ছিড়ে ফেলা হয়েছে। সবাই বিস্ময় নিয়ে একটা জঘন্য বর্বরতার সংবাদ শুনলো- তার দুচোখই নষ্ট প্রায়, এ পৃথিবীর কোন দৃশ্য,তার ছোট্ট মেয়ের মুখখানাও তিনি আর দেখতে পারবেন না। পাষন্ড সাঈদের উপযুক্ত বিচারের দাবি উঠলো সর্বস্তর থেকে। এ বর্বরতার এমন এক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া দর্কার যাতে সমাজের সব পশু-মানুষগুলোও শিউড়ে উঠে-বরাবরের মতই সবার দাবি যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘচনা না ঘটে।

নর-পশুটাকে ধরা হল কিছুদিন পর। অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাক, ব্যাটা ধরা পড়েছে, একটা ঘটনার সুরাহা হল। কিছু হাঁটু-বুদ্ধির অসভ্য মানুষ আবার ইনিয়ে বিনিয়ে সাঈদের নাটুকে প্রণয়-ঘটিত বক্তব্যের সাফাই গাইতে এল। কোন অস্ত্র ছাড়া, শুধু হাত,নখ, দাঁত ব্যবহার করে যে আরেকজন মানুষের উপর ভয়াবহ অত্যাচার করতে পারে, তার প্রতি সমবেদনা জানানোর কোন ইস্যু খোঁজে যেগুলো সেগুলো সেই সাঈদের চেয়ে নূন্য কিছু না।

আস্তে আস্তে সাইদের এই পশুত্ব অনেকের গা সওয়া হয়ে গেছে, কারন হল সাঈদ ধরা পড়েছে, ব্যস! এবার বোঝ ঠ্যালা!বাঘে ছুলে এক ঘা আর পুলিশে ছুলে আঠারো! ২. ২০০৪ সালে অক্টোবর, আমিনা বাহরামী, তেহরান ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া একজন তরুনী, কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিল। তার ইউনিভার্সিটির সহপাঠী মোভাহেদী নামক এক ছেলে তাকে বেশ কিছুদিন থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। আমিনা শুরু থেকেই নেগেটিভ রেসপন্স করায় মোভাহেদী তাকে নানা সময়ে থ্রেট দিয়ে আসছিলো। সেদিন মোভাহেদী নারকীয় জঘন্য হামলা চালায় আমিনার উপর, এক জার এসিড ছুড়ে মারে আমিনার মুখে। ঝলসে যায় সাথে সাথে সারা মুখ,কদাকার একটা মাংসপিন্ডে পরিণত হয় সুশ্রী এক মুখমন্ডল।

একটা চোখ সাথে সাথে ঝলসে নষ্ট হয়ে যায়। আরেকটা চোখও অন্ধ হয়ে যায় শীঘ্রই। ১৭ টা অপারেশন করা হয় মুখটাকে রিশেপ করার জন্য। লাভ হয় না কিছুই। পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায় আমিনা।

ধরা পড়ে মোভাহেদী,ইরান হওয়ায় সে বিচার কিসাস ( শরীয়া আইনের একটি শাখা)এর আওতায় আমিনা এর বিচার চায় । কিসাস পদ্ধতির ব্যাপারটা হচ্ছে ভিকটিম তার ক্ষতির সমপরিমান ক্ষতি যেন অপরাধীকে করা হয় সে দাবি করতে পারে কিংবা ক্ষতিপূরণ-অর্থ চাইতে পারে। আমিনা প্রথমটাই বেছে নিল। তার দাবি ছিল কোর্টে inflict the same life on him that he inflicted on me ইরান আদালত তাই রায় দেয় মোভাহেদীকেও এসিডের মাধ্যমে অন্ধ করে দেয়া হবে। কোর্ট আমিনাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তার পুরো মুখ ঝলসে দিতে চায় কিনা সে, আমিনার রিপ্লাই ছিল, তার দর্কার নেই,তার উপর যা করা হয়েছে অতটা ভয়াবহ পরিণতি সে চায় না।

কয়েক ফোটা এসিডই যথেষ্ট তার দুই চোখ অন্ধ করে দেয়ার জন্য, তাহলে সে বুঝতে পারবে অন্ধ হওয়ার কী যন্ত্রনা এখন সে ভোগ করছে। পাশাপাশি এটা এই ধরনের ক্রাইমের বিরুদ্ধে দারুন রোল প্লে করবে। কিসাসের বিচার-পদ্ধতি শুধুমাত্র শরীয়া আইনের মৌলিক কোন অ্যাপ্লিকেশন না। মূলত এর প্রথম ভুক্তি পাওয়া যায় হাজার বছর আগের তৈরি করা হাম্বুরাবী আইন এ। ওল্ড টেস্টামেন্ট এ আইনের বিধান আছে, an eye for an eye।

চোখের বদলা চোখ দিয়ে দাঁতের বদলা দাঁত দিয়ে। আইনের ভাষায় এর নাম lex talionis বা The law of retaliation." শাস্তির রায় ঘোষিত হয়ে যায়,কিন্তু আর্ন্তজাতিক নানা মহলের চাপে সেটা আর কার্যকর হয় না। কিছু মানবাধিকার সংঘ তথাকথিত সভ্য আইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার দাবি জানায়। তাদের মতে এই শাস্তি বিধান ‘অমানবিক!!!’ তাই ২০০৮ সালে ঘোষিত এ রায় আজও কার্যকর হয় নি! ৩. গতকাল এক নিউজ সাইটে দেখলাম রুমানা মনজুর বাম চোখে আর দেখতে পারবেন না সেটা কনফার্ম হয়ে গেছে- কানাডার ডাক্তার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন অপারেশনের পর । বাম চোখের অপটিক নার্ভ পুরোপুরি ছিঁড়ে গেছে ।

আর ডান চোখের ব্যাপারে বলা যাবে ১৬ তারিখের পর, আগামী শনিবার ১৬ জুলাই ভোরে ডান চোখে অস্ত্রোপচার করা হবে। ইন্ডিয়া থেকে ডাক্তাররা ফিরিয়ে দেবার পর এখন রুমানা মনজুরকে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় শেষ চেষ্টা করার জন্য। হয়তো ডান চোখের ব্যাপারেও একই কথা বলা হবে। তারপরও স্বজন আর শুভাকাঙ্খী মানুষরা আশায় বুক বেঁধে আছে হয়তো ডান চোখটা রক্ষা করা যাবে। ৪. রুমানা মনজুর আর আমিনা বাহরামী-মোটেও বিচ্ছিন্ন কোন ভিকটিম নয়,এ ধরনের শত শত ভিকটিমের কথা আমরা নানা সময়ে নিউজে দেখেছি।

সাঈদ বা মোভাহেদীও হঠাৎ করে নরক থেকে উত্থিত কোন দুলর্ভ পশু নয়, কাল পরিক্রমায় এসব হাজারো পশুর কথা আমরা শুনেছি, ভবিষ্যতে শুনবো। এসব ঘটনা ঘটবার পর কিছুদিন খুব রমরমা থাকে, বিচারের (দৃষ্টান্তমূলক) দাবিতে হাজারো মানুষের জনমত তৈরি হয় । অপরাধী একসময় ধরা পড়ে এবং ভিকটিমের ভাগ্য ভালো থাকলে বিচার হয়। কারো ৫ বছর, কারো ১০ বছর কিংবা আরো বেশি কারাদন্ড হয়, যদি ভিকটিম বহু লড়াই করে নিজেকে ভিকটিম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে তবেই। আমার কথা হচ্ছে এসব নর-পশুর শাস্তি কি হওয়া উচিত, ৫-১০ বছরের বা কখনো তার বেশি কারাবাসই কী তাদের ওই সীমাহীন বর্বরতার জন্য প্রাপ্য দন্ড? নারী নির্যাতন টাইপ বিচার যেমন এসিড সন্ত্রাসের জন্য ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের দাবি শুনছি অনেকদিন ধরে।

কিন্তু একজন আমিনা বা রুমানা যে ধরনের নিশংসতার শিকার তাতে মৃত্যুদন্ডও তো কিছুই না। (মৃত্যুদন্ড যদিও অনেক অনেক পরের কথা) আমি সাধারণ মানুষ, আইনের নানা প্যাচ বুঝতে চাই না, বোঝার চেষ্টা করাও বৃথা মনে হয়। আমাদের দেশে যে কোম্পানী আইন চালু সেটা নিজেই একটা জোকস, ভিকটিমকে নিজের প্রমাণ করতে হয় সে ভিকটিম। আর আরও সভ্য দেশে আইন যেন তৈরি হয়েছে অপরাধীকে বাঁচানোর জন্য। জেলখানার ভিতরের ছবি দেখলে মনে হয় থ্রি স্টার হোটেল।

মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ অনেক দেশেই। মানবাধিকার বইলা কথা! কথা হল- আমার কাছে মনে হয় একজন সাইদ বা মোভাহেদী কে তথাকথিত এই সভ্য আইনের মাধ্যমে বিচার করাটা হল চরম এক অবিচার। lex talionis এর মাধ্যমে যদি তাদের বিচারের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে আমার মত ‘ নর-পশুর মানবাধিকার নিয়া না ভাবা’ মানুষ শান্তি পেতাম। সাইদ কুত্তাটার একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত ঠিক একই ভাবে ওর নাক কেটে ফেলা এবং চোখ উপড়ে ফেলা!আরেক পশু মোভাহেদীর শাস্তি হওয়া উচিত এসিড দিয়ে ওর মুখ ঝলসে দেয়া, নিদেন পক্ষে অন্ধ করে দেয়া। যদিও এসব নি:ষ্ফল আক্রোশের কথা।

নর-পশুর মানবাধিকার সচেতন সভ্য মানুষরা এসব কথায় শিউড়ে উঠবে। ভিকটিমের যা ইচ্ছে হোক ব্যাপার না কিন্তু অপরাধীদের জন্য দরকার ফেয়ার প্রসিডিউর। ইরানের মত দেশও তাদের চাপে আমিনা বাহরামীর রায় আজও কার্যকর করতে পারলো না,আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলা তো সে তুলনায় নস্যি। ৫. কাল সকালে (১৬ জুলাই) রুমানা মনজুরের ডান চোখের অপারেশন হবে। বাম চোখ চিরতরে নষ্ট তার।

এখন একটাই প্রার্থনা তার ডান চোখটা যেন ভাল হয়ে যায়। নাহ! কোন বিচার নয়, একজন নিষ্ফল আক্রোশে হাত কামড়ে থাকা অনেক মানুষের মত আমারও খুব ইচ্ছা কালকে একটা ভাল সংবাদ শুনি,রুমানা মনজুরের ডান চোখটা যেন ভাল হয়ে যায়। পোষ্টের শিরোনামটায় বাম-চোখের জায়গায় যেন ‘দুই চোখ’ না হয়ে যায়। এছাড়া আর কীই বা চাওয়ার আছে! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.