আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নওগাঁর শালবনে আলতাদিঘি

হাফিজুর রহমান চৌধুরী নওগাঁর বালুডাব্দা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে চেপেছিলাম সকাল ৭টায়। প্রায় ৫৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ধামইরহাট সদরে। পৌঁছতে লেগে গেল প্রায় দেড় ঘণ্টা। সেখান থেকে যাব ৬ কিলোমিটার দূরে ধামইরহাট-জয়পুরহাট সড়ক থেকে উত্তরের শালবন আর আলতাদিঘি। রিকশায় সামান্য পাকা রাস্তা আর বাকিটা লালমাটির রাঙা পথ পেরোতেই চোখে পড়ল শালবন।

ঠাঠা বরেন্দ্রভূমিতে যেন একচিলতে মরূদ্যান। এ প্রাকৃতিক বনভূমি আর দিঘি দেখতে প্রতিদিন আসেন শত শত প্রকৃতিপ্রেমী। বনের দিকে যতই এগিয়ে চলেছি ততই যেন রোমাঞ্চিত হচ্ছি। পথের ধারে মাঝেমধ্যে ছোট্ট ছোট্ট পাড়া। বেশিরভাগই ওঁরাও আদিবাসীর বসবাস।

এরপর হঠাত্ করেই যেন শুরু বন, চারদিকে শুধু উঁচু উঁচু শালগাছ। সকালের সোনারোদ শালগাছের পাতায় আছড়ে পড়ছে। সেই রোদের আলোছায়া বাতাসের দুলনিতে মাটিতে পড়ে নানান ছবি আঁকছে। সর্পিল পথ ধরে গহিন শালবনে প্রবেশ করার সময় এমনিতেই অজানা ভয়ে গা ছমছম করে উঠছে। তবুও প্রকৃতির হাতছানি নিয়ে যাচ্ছে নির্জন বনের গহিনে।

মাঝেমধ্যে পাখির আচমকা ডাকে চমকিত শরীরে শিহরণ জাগাচ্ছে। শালপাতার ফাঁকে ফাঁকে আলোছায়ার লুকোচুরি তার সঙ্গে বাতাসের খেলা দেখতে দেখতে দুচোখ জুড়িয়ে গেল। বুনোপথ ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতে পেয়ে গেলাম শালবনের মধ্যে বিশাল টলটলে জলের আলতাদিঘি। কথিত আছে পাল যুগে পাল বংশের কোনো এক রানী এই শালবন দেখতে আসেন। রানীমাকে কাছে পেয়ে জলকষ্টের কথা জানায় সেখানকার প্রজারা।

কোমলপ্রাণ রানী প্রজাদের ওই কষ্টে ব্যথিত হন। তিনি প্রজাদের বলেন, ‘আমি যতদূর পর্যন্ত হাঁটতে থাকব ততদূর পর্যন্ত দিঘি খনন করা হবে। আমার পা থেকে যতক্ষণ না রক্ত ঝরবে আমি ততক্ষণ হাঁটতে থাকব। ’ রানী হাঁটতে শুরু করলেন। রানীর ওই কষ্টে পরিচারিকারা বিচলিত হয়ে উঠল।

এ সময় তাদের কাছে থাকা আলতা রানীর পায়ে ছুড়ে দিয়ে তাকে জানানো হয়, তার পা দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। রানী হাঁটা বন্ধ করলেন। রানীর হাঁটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খনন করা হয় বিশাল এ দিঘিটি। দিঘির মিষ্টি শীতল পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। ক্লান্তি চলে গেল অনেকটাই।

আবারও বুনোপথে হাঁটা শুরু। শালবনের ভেতরে মাঝেমধ্যেই লাল রংয়ের বিশাল বিশাল উইপোকার ঢিবি। শালগাছকে জড়িয়ে উঠে গেছে হিংলোলতা, গুরঞ্চলতা, অনন্তমূল, ঝারিশত, বনবরইসহ নানা লতাগুল্ম আর বনফুল। মাঝেমধ্যে ঘন বেতবন। ভারত সীমান্তঘেঁষা এ বন আর দিঘি।

প্রায় ১০০ একরের দিঘি আর ৩০০ একরের রিজার্ভ ল্যান্ড ফরেস্ট। এ বনে আছে সাপ, শিয়াল, খরগোশ, বাঘডাসা, বনবিড়াল, বনরুই, বেজি, গুইসাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আর পাখি। একটা গাছের ওপর দেখতে পেলাম বকের বাসায় অদ্ভুত শব্দ করে মাকে ডাকছে বকছানা। পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটি বেজি। মনে হয় বকছানার লোভে কোথাও ওতপেতে ছিল, মানুষ দেখে চম্পট দিল।

বনের ভেতর শিশুকে কাপড় দিয়ে পিঠের সঙ্গে বেঁধে রেখে কাঠ সংগ্রহ করছে কয়েকজন ওঁরাও নারী। পথ যেখানে শেষ, সেখানেই ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। ওপারে ভারতের মানুষ জমি চাষ করছে, বিএসএফ টহল দিচ্ছে। আবার ফিরে এলাম বনে। দুপুর গড়িয়েছে।

এ বনভূমিতে কোনো বিশ্রামাগার নেই। বনের উত্তর ধারে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। যারা বেড়াতে এসেছেন সেখানে বসে সবাই সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার খাচ্ছেন। আমিও তাদের মতোই মাটিতে বসে পড়লাম নওগাঁ থেকে সঙ্গে আনা খাবারগুলো সাবাড় করতে। নিঝুম নিস্তব্ধ বন।

মাঝেমধ্যে পাখি ডাকছে। সময় যে কীভাবে কেটে গেল তা বুঝতে পারলাম না। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। ফেরার তাগিদ অনুভব করলাম। দুচোখে শুধুই সবুজ আর সবুজ মাখিয়ে একগুচ্ছ স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম শালবন আর আলতাদিঘিকে বিদায় জানিয়ে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.