আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাশকাটা ঘর, একটি মেয়ে ও হরিশচন্দ্র

আহ অমরত্ব, তোমার উষ্ণ ঠোঁটে রাখি ঠোঁট, চোখ বন্ধ করে সবটুকু আনন্দ ভোগ করি। তোমার উষ্ণতায় বারেবারে বিলীন হয়ে যাই, দিতে পারিনি কিছুই, শুধু নষ্ট করে যাই। লাশটা অনেক ক্ষণ ধরে মর্গের বারান্দায় পরে আছে। বেওয়ারিশ লাশ। একটি চাটাই দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

লাশটির পা দুটো বের হয়ে আছে। ডোম হরিশচন্দ্র বারান্দার এক কোনায় বসে গাঁজা টানছে। তার চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হরিশ লাশের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ধবধবে ফর্সা দুটো পা।

পা দুটো দেখে মনে হচ্ছে লাশটি কোন মেয়ের। হরিশ পায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে। গাঁজার প্রভাবে সে এক রঙিন ভুবনে বিচরণ করছে। যে দুজন পুলিশ লাশটি নিয়ে এসেছে, তাদের কোন খোঁজ নেই। লাশ পচতে শুরু করেছে।

লাশ থেকে বের হওয়া দুর্গন্ধ ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। রাত প্রায় দশটা বাজে। হরিশ মর্গের বারান্দায় নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। দশটার দিকে দায়িত্বরত ডাক্তার এলেন। তিনি হরিশকে লাশ ব্যবচ্ছেদ করার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন।

হরিশ আড়মোড়া ভেঙ্গে চারদিকে ভালো থাকাল। শুধু বারান্দার বাতিটা জ্বলছে। বাতিটা ঘিরে অসংখ্য পোকা উড়ছে। পচা লাশের তীব্র গন্ধ এসে হরিশের নাকে লাগলো। হরিশ তার পকেট থেকে দিশি মদের বোতলটা বের করে এক চুমুক খেলো।

দরজা খুলে সে রুমের ভেতরের সবগুলো বাতি জ্বালাল। লাশ কাটার টেবিলটা ঠিক করে সে লাশটার কাছে আসলো। হরিশ লাশটা আস্তে করে তুলে টেবিলটার উপর রাখল। সে ধীরে রশির বাধন গুলো খুলে চাটাই টা সরাল। পচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সী একটি মেয়ের লাশ।

হরিশ লাশটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার জীবনে সে এতো সুন্দর মেয়ে দেখেনি। মেয়েটির মুখে অল্প একটু হাসি লেগে আছে। দেখে মনে হয় সে মৃত্যুতে অনেক আনন্দ পেয়েছে। এতো সুন্দর একটি মেয়ে একটু পরেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।

হরিশ লাশটার শরীর থেকে কাপড়গুলো সরিয়ে নেয়। পেটের কাছে আঘাতের ছিন্ন। হরিশ ছুরি দিয়ে পেট বরাবর একটি লম্বা টান দেয়। পেটটা দু ভাগ হয়ে যায়। এই সময় আঃ বলে লাশটি প্রচণ্ড ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে।

হরিশ এক লাফে দূরে সরে যায়। সে অনেক লাশ কেটেছে, কিন্তু কোনদিন এত ভয় পায়নি। হরিশ লাশটার দিকে তাকায়। লাশটা স্থির হয়ে জায়গায় পড়ে আছে, কিন্তু হাত দুটো পেটের কাটা জায়গাটা চেপে ধরে আছে। হরিশ মদের বোতলটা বের করে পুরো বোতলটা শেষ করে দেয়।

মদের প্রভাবে তার ভয় অনেকটা দূর হয়ে যায়। সে আবার লাশটার কাছে যায়। হরিশ লাশের হাত দুটো সরিয়ে আবার ছুরিটা হাতে নেয়। এই সময় লাশটা ধীরে ধীরে উঠে বসে। ভয়ে হরিশের নেশার প্রভাব ছুটে যায়।

মেয়েটা টেবিল থেকে নেমে কাপড়গুলো পড়ে নেয়। ভয়ে হরিশের কণ্ঠ শুকিয়ে আসছে। হরিশ আস্তে আস্তে পেছনে সরে আসতে লাগলো। মেয়েটাও তার দিকে আসছে। খোলা চুল আর মোহময় দৃষ্টিতে সে হরিশের দিকে এগিয়ে আসছে।

হরিশের পা দুটো ভারী হয়ে আসছে। মেয়েটা এসে হরিশের হাত ধরল। হরিশ আর সহ্য করতে পারলো না, মূর্ছা গেলো। চোখে জলের ঝাপটা লাগছে। হরিশ ধীরে ধীরে চোখ খুলল।

হরিশ দেখল তার পাশে মেয়েটি বসে আছে। হরিশের চিন্তা ভাবনা লোপ পেয়ে গেছে। সে এখন আর কিছু চিন্তা করতে পারছেনা। "আপনার নামটা কি জানতে পারি?" মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো। হরিশকে এই পর্যন্ত কেউ আপনি করে বলেনি।

সবাই তাকে তুই করেই সম্বোধন করে। "হরিশ" "আমি নীরা। " "ওহ" "আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?" হরিশ মাথা নাড়ল। তা হ্যা না না বুঝাল তা বোধগম্য হলনা। "দেখুন তো কতটুকু কেটে ফেলছেন।

আপনার কাছে সেলাই করার ব্যাবস্থা নেই?" "আছে। " "তাহলে সেলাই করে দিন। " হরিশ পেটের কাটা অংশটুকু সেলাই করে দেয়। মেয়েটা হরিশের সাথে অনবরত কথা বলে যেতে থাকে। "জীবনানন্দের ঐ কবিতাটা পরেছেন, কি যেন লাশকাটা ঘরে।

" "উনি কে?" "আপনি জীবনানন্দ দাশকে চেনেন না। ঠিক আছে আমি কবিতাটা আপনাকে আবৃত্তি করে শুনাচ্ছি। " নীরা গম্ভীর কণ্ঠে আবৃত্তি করে, "যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হল তার সাধ। বধূ শুয়ে ছিল পাশে - শিশুটিও ছিল; প্রেম ছিল,আশা ছিল-জোৎসনায়,- তবে সে দেখিল কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার? অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার। " হরিশ কবিতা শুনে।

হঠাৎ কেন জানি তার মেয়েটিকে অনেক ভালো লেগে যায়। তার মন থেকে সব ভয় দূর হয়ে যায়। তার মনেই থাকেনা সে একটি লাশের সামনে বসে আছে। বাইরে চাঁদ উঠেছে। মধ্যরাতের নিশুতি পাখিরা জেগে উঠেছে।

থেমে থেমে ডেকে উঠছে পাখিগুলো। হরিশের মেয়েটির সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করে। তার জীবনের গল্প। লাশের সাথে তার বসবাসের গল্প। মেয়েটি কথা বলতেই আছে।

হরিশ মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনে। মেয়েটি রুমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেটে যায়। সে গুনগুন করে গান গায়। হরিশ শুনতে থাকে। অদ্ভুত ভালো লাগায় তার মন ভরে যায়।

রাত গভীর হচ্ছে। মেয়েটি দ্রুত গতিতে রুমের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেটে যায়। তার হাটার গতি দ্রুততর হতে থাকে। মনে হয় যেন দৌড়াচ্ছে। মেয়েটি একসময় বসে পরে।

করুন সুরে বিলাপ করতে থাকে। হরিশের মনে আবার ভয়টা ফিরে আসলো। সে দৌড়ে দরজার কাছে যায়। কিন্তু তার আগেই মেয়েটি দরজার নিকটে চলে আসে। হরিশ আতংকে নীল হয়ে যায়।

পরেরদিন সকালে ডাক্তার এসে অনেকক্ষণ ধরে হরিশকে ডাকল। কিন্তু তার খোঁজ পাওয়া গেলনা। মর্গের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ ডেকে সাড়া না পেয়ে অবশেষে দরজা ভাঙ্গা হয়। লাশকাটার টেবিলে হরিশ শুয়ে আছে।

তার পেটের মাঝ বরাবর দু ভাগ হয়ে আছে। ঠিক পাশেই পরে আছে রক্তমাখা ছুরিটা। রুমের ভেতর সেই লাশটি পাওয়া গেলনা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।