আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথের বাঁকে টুকরো স্মৃতি

প্রতিদিনের একঘেয়ে কাজের চাপে চ্যাপ্টা হতে হতে যখন একেবারে হাসফাস অবস্থা, তখনই সবকিছু ছেড়ে সামান্য সময়ের জন্য পালানোর ছোট্ট এক টুকরো সময় হাতের মুঠোয় পুড়ে নিলাম খপ করে। 'চল যাই' বলতেই বোচকা নিয়ে এক নিমিষে রাস্তায়, একেবারে হাইওয়েতে আর লম্বা একটা যাত্রাশেষে সমুদ্রে। রাতের জার্নির একটা অদ্ভুত রহস্যময়তা আছে। বাসের জানালার বাইরে রাস্তার দুধারে ঘুটঘুটে অন্ধকার সাঁই সাঁই করে পার হয়ে যেতে থাকে, আর হঠাৎ হঠাৎই একটা-দুটো আলোর বিন্দু, দূরে ছোট্ট একটা গ্রাম কিংবা একলা নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি। ঝুপ করেই সামনে পড়ে যায় একটা নদী, নদীর বুকে টিমটিমে আলো জ্বেলে ভেসে বেড়াচ্ছে নৌকা।

কিছু একটা অপার্থিব, অলৌকিক সুন্দরকে দেখে ফেলার আশায় সারাক্ষণ উন্মুখ হয়ে জানালায় চোখ পেতে থাকা। এই করতে করতে সকাল। রেলক্রসিঙে সিগন্যাল পেয়ে বাসটা থেমেছে কোথায়। কোথায়? মুখ বাড়ালাম বাইরে। পুরনো একটা সাইনবোর্ড, তাতে বড় বড় করে লেখা "শাসনগাছা, কুমিল্লা"।

রেললাইনটার চারদিকে ময়লা-আবর্জনা, একটু দূরে ছাপড়ামত কিছু ঘর-বাড়ি, রুক্ষ একটা খোলা মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে প্রায় কাল, কালচে বাদামি হয়ে যাওয়া অপুষ্ট এক পাল ভেড়া। ভেড়াগুলো সাদাই ছিল, কিন্তু জন্মের পর এদের কখনো পরিস্কার করা হয় নি। যত দিন গেছে, বদলে গেছে এদের জন্মগত রঙ। রেললাইনটা পার হয়ে একটু সামনেই রাস্তার ধারে টিনের চালের কিছু খাবারের দোকান। সকাল সকাল গরম পরোটা ভাজা হচ্ছে, সাথে সব্জী, ডাল, ডিম ভাজি।

আর পুরনো আমলের হিন্দী ছবির গান। তিন মিনিটের ছোট্ট একটা বিরতি, তারপর হেলেদুলে বের হয়ে গেল ট্রেনটা, আমরাও ছুটলাম রাজধানীর পথে। কিন্তু ওই তিনটা মিনিট যেন আমাকে টাইম মেশিনে করে উড়িয়ে নিয়ে গেল প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে, আমার শৈশবে। এই রেললাইনটার ধার ঘেঁষে কত দিনই না হেঁটে গেছি ছোট ছোট পা ফেলে। এক হাত থাকতো দিদিনানার হাতের মুঠোয়, আর অন্য হাত বাতাসে ঢেউ তুলতো বারবার।

একইভাবে দিদিনানার অন্যহাতে ধরা থাকতো আসিফের হাত। ছেলে বলেই বোধহয়, ওর দূরন্তপনাকে সামলাতে তাঁকে একটু বেশিই শ্রম দিতে হতো। আমরা হেঁটে চলতাম, নেচে চলতাম রেললাইনের পাশ দিয়ে, মোট কয়টা ট্রেন আসল-গেল তার হিসেব কষতাম, ভারিক্কী মালগাড়িটা হেলতে দুলতে যখন বহু সময় নিয়ে স্টেশন পার হতো আমরা একটা একটা করে তার বগিগুলো গুণতাম। এত্তগুলো বগির হিসাব রাখার মত তুখোড় তখনো হয়ে উঠি নি কেউই। তাই চৌষট্টি না ছেষট্টি তাই নিয়ে ভীষণ তর্ক বেধে যেতো দুজনের মধ্যে।

না পেরে শেষে সাক্ষী মানতাম দিদিনানাকেই্। তিনি কাউকেই জিতিয়ে দিতেন না, শুধু তাঁর অদ্ভুত সুন্দর পবিত্র মুখটায় একটা শুভ্র হাসি ছড়িয়ে পড়তো, আরো শক্ত করে চেপে ধরতেন দুজনের হাত। আমার নানাকে আমরা দিদিনানা বলতাম। একদম ছোটবেলায় আপাকে উনি দিদি বলতেন। সেই থেকে আপা উনাকে ডাকতো দিদিনানা।

আর বড়জনের দেখাদেখি আমিও তাই করতাম। অন্য সবার থাকে শুধু নানা, আর আমার আছে দিদিনানা। এই একটা কারণে ওই সময় কি গর্বই না হতো। নানাবাড়ি গেলে রোজ বিকালে উনার সাথে বের হওয়ার জন্য হুড়োহুরি লেগে যেতো, খুব সূক্ষ্ম শীতল একটা যুদ্ধও চলতো মামাতো ভাই আসিফের সাথে। কারণ উনি দুইজনকে একসাথে নিতে চাইতেন না।

তাঁর সাথে যাওয়াটা শুধু তাঁর সঙ্গ পাওয়ার জন্যই না, দিদিনানার সাথে বেরুনো মানে হল একটু বাইরে যাওয়া, রেললাইনের ধারে ইচ্ছামত ঘুরে বেড়ানো, সেখান থেকে ঘুরে দোকানে যাওয়া, আর তারপরে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এক প্যাকেট সিভিটা। কমলার স্বাদের এক প্যাকেট কমলারঙা পাউডার, হাতের তালুতে নিয়ে চেটে চেটে খেতে যেন অমৃতের মত মনে হতো। ছোট্ট প্যাকেটটার দাম খুব বেশি হলে বোধহয় পাঁচ টাকাই ছিল। কিন্তু আমরা বুঝতাম না ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বহুদিন আগে অবসরপ্রাপ্ত কেরানি ভদ্রলোকের পেনসনের টাকা এতই সামান্য ছিল যে রোজ রোজ পাঁচ টাকার ওই ছোট্ট প্যাকেটটা কেনা সম্ভব হতো না। তাই তিনি বিভিন্ন কৌশলে এড়ানোর চেষ্টা করতেন আমাদের।

একান্তই না পারলে নিয়ে যেতেন স্টেশনে। যখন ট্রেন আসতো না, আমরা রেললাইন ধরে হেঁটে যেতাম অনেক দূর পর্যন্ত। স্টেশনের একটু বাইরেই কুমিল্লা শহরটার চেহারা একেবারে অন্যরকম। ছোট ছোট ছাপড়া মত ঘর রেললাইনের পাশের রুক্ষ খালি জমিগুলোতে, নোংরা পরিবেশ, অর্ধ উলঙ্গ বাবা-মায়ের পাশে উলঙ্গ শিশুরা নোংরা গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু তাদের কোমরে মাদুলি বাধা একটুকরো কাইতন ঝুলছে আর নাকে অবিরত গড়াচ্ছে সিকনি।

সেখানেই তারা থাকে, রান্না-বান্না করে, খায়, ঘুমায়, আর প্রাকৃতিক কর্ম সারে রেললাইনের পাশে বসে। যে কারণে খুব ইচ্ছে হলেও প্লাটফর্ম থেকে রেললাইনে নেমে হাঁটা সম্ভব হতো না। এই হল মেথরপাড়া। গায়ের রঙ বদলে যাওয়া ভেড়াগুলোও এদেরই। শূকরও আছে অনেক সেই সাথে।

ট্রেন ছুটে যাওয়ার উচ্ছল আনন্দময় গন্ধটার পাশেই যোগ হতো মেথরপাড়ার পুঁতি দূর্গন্ধ। আমরা নাক চেপে ধরে পা টিপে টিপে ফেরার পথ ধরতাম। স্টেশন রোডের সেই বাড়িটার প্রবেশপথে একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল আমার মায়ের হাতে লাগানো। বাড়িতে আসা প্রত্যেকটা মানুষকে মাথা দুলিয়ে অভ্যর্থনা দিতো গাছটা। মায়াময় সেই মানুষগুলো এখন আর নেই, অভ্যর্থনা জানানোর জন্য গাছটাও দাঁড়িয়ে নেই রাস্তার ধারে, যাওয়া হয় না কুমিল্লা শহরের ভেতরে বহুদিন।

সেই ব্রিটিশ আমলের রাজকীয় বাড়িগুলো, যাদের জন্য শহরের রাস্তায় যেতে যেতে মনে হতো বুঝি কোন অসম্ভব উপায়ে পৌঁছে গেছি দুইশ বছর আগে, সেগুলোও ভেঙে এখন বহুতল ভবন করে ফেলা হয়েছে। ভরাট করে ফেলা হয়েছে বেশিরভাগ পুকুর আর দীঘি। এক লহমায় শহরটা পার হতে হতে দেখলাম স্মৃতিতে আমার শৈশবে যে অদ্ভুত সুন্দর একটা স্কেচ করা ছিল তা যেন কে ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে দিয়ে রঙচঙে, ঝলমলে রাংতা মুড়ে দিয়েছে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে স্মৃতির সেই স্কেচটাকে তুলে রাখি সযত্নে মস্তিষ্কের এক কোণে। এমনি কোন এক ভোরে হয়তো তাকে নামিয়ে নিয়ে ঝেড়ে-মুছে, নেড়ে-চেড়ে দেখার ইচ্ছে জাগবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।