আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সঙ্গিনীর শোকে একটি পাখি যখন চরাচর কাঁপিয়ে কাঁদছিল, বিলাপ করে উড়ে বেড়াচ্ছিল গ্রামের আকাশ।

নদীর জলে, হিজল তলে। সঙ্গিনীর শোকে একটি পাখি যখন চরাচর কাঁপিয়ে কাঁদছিল, বিলাপ করে উড়ে বেড়াচ্ছিল গ্রামের আকাশে, তখন মানুষের হূদয়ও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। চোখ ভিজে ওঠে কারও কারও। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে, ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে। গ্রামের আরও অনেকের সঙ্গে আমি টানা প্রায় এক ঘণ্টা শুনেছিলাম একটি পাখির বিলাপ।

দেখেছিলাম মাতম। ওই দৃশ্য ও কান্না সহ্য করতে পারেনি সেদিন গ্রামের মানুষ। সদ্য বিদেশফেরত যে তরুণ শখের বশে এয়ারগান দিয়ে গুলি করে পাখিটিকে সঙ্গীহারা করেছিল, তাঁকে একরকম পাকড়াও করে এনেছিল গ্রামবাসী। পাখিটির কান্নায় সেদিন সেই তরুণ নিজেও অনুতপ্ত হয়। ক্ষমা চায় গ্রামবাসীর কাছে।

প্রতিজ্ঞা করে, জীবনে আর কোনো দিন সে এয়ারগান হাতে নেবে না। পাখির কান্না! সেই কান্না যদি হয় সঙ্গীর বিরহে, সে কান্নার ভাষা শুধু অনুভবই করা যায়; ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। পাখিটির নাম ‘শাহবাজ’ বা ‘শিখাযুক্ত ইগল’। সাতুরিয়ার একটি মেঘশিরীষের গাছে ওই শাহবাজ ইগল-দম্পতি টানা ১৫ বছর ঘর বেঁধে ছিল। বাচ্চা তুলেছিল।

এলাকার সব মানুষের অতি পরিচিত আর আপনজন হয়ে উঠেছিল ওরা। তুখোড় শিকারি, দুর্দান্ত লড়াকু ও ক্ষিপ্র গতির শাহবাজ নামের এই পাখিটি সারা দেশেই ছিল একসময়। কমে গেছে এখন। তীক্ষ দৃষ্টি ও বড়শি-নখর এদের শিকারের অন্যতম হাতিয়ার। লক্ষ্য সহজে ফসকায় না।

খোলা মাঠের ঘাস-মাটির মাত্র ১০-১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জঙ্গি বিমানের মতো দ্রুতবেগে ধাওয়া করে প্রায় ৩০ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করে নখরে গাঁথতে দেখেছি আমি নাগরবাটোই পাখিকে। ঘন বন-বাগান ও নারকেল-সুপারি বাগানের ভেতর দিয়েও শিকারকে ধাওয়া করতে পারে এরা তীরবেগে। দেখতেও সুন্দর পাখিটি। দুই খানা পা পালকে ঢাকা; যেন পরে আছে তুলোট সাদা উলের মোজা। পায়ের পাতা হলুদ।

পিঠের উপরিভাগ হালকা খয়েরি বাদামি, বুক-পেট সাদা, তার ওপরে কালচে বাদামি বা খয়েরি খাড়া খাড়া দাগ। চোখের মণি কালো, রং হলুদ। ঠোঁট ছাইরঙা। বছরে বেশ কয়েকবার শরীরের রং যায় বদলে, আমি তাই এদের বলি ‘বহুরূপী ইগল’। শৈশব-কৈশোরে আমাদের গ্রাম ফকিরহাট-বাগেরহাটে এদের প্রচুর দেখেছি।

এখন অনেক কমে গেছে। তবে একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। এই ২০১১ সালেও খুঁজে দেখেছি তিনটি স্থায়ী বাসা আছে ওদের। শীতের শুরু থেকে বর্ষাকালের আগ পর্যন্ত ডিম-ছানা তোলে ওরা। একই বাসা ব্যবহার করে বছরের পর বছর।

ডিম পাড়ে একটি। মূল খাদ্য এদের ইঁদুর-কাঠবিড়ালি, মাছ, ছোট সাপ, কাঁকড়া, বনকোয়েল, অঞ্জন, বনমুরগি, মথুরার ছানা ইত্যাদি। পোষা মুরগির ছানা কালেভদ্রে তুলে নেয়। ওদের ডাকে বা ডানার ছায়া দেখলেও ছোট পাখিদের হূৎকম্প জাগে। এদের ডাকেও আছে রকমফের—প্রেমের ডাক, ডিমপাড়ার ডাক ও ছানা ফোটার আনন্দের ডাক।

কিন্তু প্রেমিকার বিরহের কান্নাও যে আছে, তা আমি প্রথম শুনি ওই ২০০৮ সালে। শাহবাজ সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জানেন বাঘ-বিশেষজ্ঞ আক্তারুজ্জামান কামাল। তিনি এক যুগের বেশি সময় এ পাখিটি পর্যবেক্ষণ করছেন। পাখিটির ইংরেজি নাম Changeable Hawx Eagele, বৈজ্ঞানিক নাম spizaetus cirrhatus। মাপ ৬০ থেকে ৭২ সেন্টিমিটার।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।