আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিজ্ঞান শকুন্তলা

আমি যেন এক মেঘ হরকরা অভিজ্ঞান শকুন্তলা (১৯৯২ তে লেখা) মোশতাক আহমদ ক- শকুন্তলার মতো ‘বৃথা বাক্য কেন ব্যয়, চলো শারদ্বত, শার্ঙ্গরব, স্কন্ধে তোলো ক্লান্ত দন্ডভার- এ কোন্ রাজার দ্বারে হয়েছো বিনত? স্বপ্নাবৃত সমস্ত সংসার। ”১ বাংলা ভাষার ওপর যথেষ্ট দখল এবং সদিচ্ছা থাকার পরও পাঠক এই কবিতাংশের অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বিভ্রান্তির কুয়াশায় পথ হারাবেন, যদি না শকুন্তলা- দুস্মন্তের উপাখ্যানটি তার জানা থাকে। আমরা জানি রাজা দুস্মন্ত শিকারে গিয়ে শকুন্তলার দেখা পান তপোবনে, তাঁদের প্রণয় হয় ও গান্ধর্ব রীতিতে বিবাহ হয়। রাজা রাজধানীতে ফেরার আগে স্ত্রীকে একটি অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় পরিয়ে দেন যা- কিনা ুদুর্বাশা মুনির শাপে জলগর্ভে হারিয়ে যায়; রাজা বিস্মৃত হন প্রিয় স্ত্রীর মুখখানি। পরে শারদ্বত ও শার্ঙ্গরবকে সাথে করে শকুন্তলা রাজসভায় উপস্থিত হন; রাজার তখন ‘চিন্তাকুল দৃষ্টি, ভ্রুধনু টাঙ্গকার./ ললাটে কুঞ্চিত রেখাবলী’২ স্ত্রীকে চিনতে না পেরে তাঁকে প্রত্যাখান করেন।

এই গল্প-চুম্বক ৩ জানা থাকলে কবিতাটি আর দুর্বোধা থাকে না। অর্থা ‘দুবোধ্যতা’ একটি আপেক্ষিক শব্দ; পাঠক যখন কিবির ভাবনার সাথে সমকক্ষতা অনুভব করতে পারেন না তখনই দুর্বোবধ্যতার অভিযোগ বা অনুযোগ ওঠে। ‘দুর্বোধ্য’- আধুনিক কবিতার প্রতি এ এক অতি পুরনো ও বহুশ্রুত অভিযোগ; অভিযোগকারীদের দুটি দল- একদল কবিতার প্রতি মনোযোগী পাঠকদের মাঝেই আছেন, অন্যদল কবিতা পড়েন না সাধারণতঃ দ্বিতীয় দলের অভিযোগের (বা অপবাদের) উত্তর দেয়া বৃথা কেননা তাাঁরা এই রচনাটি পড়ার আগ্রহ বোধ করবেন না। কবিতাকে যাঁরা ভালবাসেন তাঁদের কেউ যখন অভিযোগ (বা অনুযোগ) করেন তখন কবিতাকে দেখতে পাই আপাত-অচেনা শকুন্তলার মতো আর পাঠককে দেখতে পাই রাজা দুস্মন্ত হয়ে গেছেন, চিনতা পারছেন না তাঁর জন্যে আনন্দবহ কবিতাকে। খ- ‘ভাষা ও ছন্দ’ ‘মানুষের ভাষা তবু অনূভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে নিছক ক্রিয়া, েিবশষন; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল’।

৪ একটা সময় চিল যখন জ্ঞানী ব্যক্তিমাত্রই ‘কবি’ অভিধায় ভূষিত হতেন। কয়েক শতাব্দী আগেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখাগুলো এমন ভিন্ন ভিন্ন ছিলনা। গনিতে যিনি পন্ডিত, তিনি হয়ত দর্শন শাস্ত্রেও পন্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন; পাশাপাশি কাব্য নিয়েও উল্লেখ করার মতো চর্চা থাকাটা তার পক্ষে অস্বাভাবিক চিল না। দিন দিন পরিস্থিতি বদলে যায়, এক-একটা শাখাই বহু বিভাজিত হতে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথাই ধরা যাক-এক সময়ে ‘বৈদ্য’ বলতে বৈদ্য্ই বেঝাতো; এখন কিন্তু চিকিৎসকের ‘ডাক্তার’ পরিচয়টি অসম্পূর্ণ।

জানতে হবে কে চোখের ডাক্তার, কে হৃদরোগের ডাক্তার, কে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। একথা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা যতই বহুধা-বিভক্ত হচ্ছে ততই বাড়ছে তার উকর্ষ; শিল্প মাধ্যমেও একই ব্যাপার। একজন বিজ্ঞানী সর্বশেষ টেকনোলজির প্রয়োগ ঘটাবেন এ যেমন স্বাভাবিক, একজন কবি সবচেয়ে আধুনিক ভাষায় লিখতে চাইবেন এ-ও তেমনই স্বাভাবিক। কথা হচ্ছে, আধুনিক ভাষা (ব্যাকরণগত অর্থে নয়) কোনটি?- কোনো কবির অনুসন্ধান-রব্ধ ভাষাই চুড়ান্ত নয়। প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে কবিতার ভাষা।

সহজ করে বললে, ‘যার সঙ্গে মাটির যোগ আছে, যা আমদানিকৃত নয় বরং স্বতঃ উৎসরিত, যা সময়কে প্রতিবিব্তি করেও শাশ্বত’৫, সে ভাসাই আধুনিক। আধুনিকতার চিহ্ন ফুটে উঠবে কোথায়- বলার ভঙ্গিমায় না কি শব্দ-নির্বাচনে?- এখানেও মেষ কথা নেই, আন্তরিকভাবে নিরন্তর চর্চাই শেষ কথা। এজন্যেই ভাষার সবচেয়ে পরিশীলিত রূপটি কবিতায় পাওয়া যায়। এই আধুনিক ভাষায় রেখা কবিতা বুঝতে হলে প্রস্তুতি চাই, তৈরি হয়ে থাকা চাই কিছুটা। একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে একজন বিজ্ঞানমনস্ক লোক একটা বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ভাল বুঝবেন; তেমনি, বাংলা কবিাতর উল্লেখযোগ্য ফসল সম্পর্কে যাঁর কিছুটা ধারণা আছে তিনি সাম্প্রতিকি কবিতা ভালো বুঝবেন বলে আশা করা যায়।

কবিতার ভাষা কি করে বদলে গেল, ছন্দের কাজটা যে আন্তমিলে সীমাবদ্ধি নয়- এসব প্রাথমিক ব্যাপার না জানা থাকলে পাঠকের কাছে কবিতাকে দুর্বোধ্য বলেই মনে হতে পারে। লাইন শেষে মিলটাকে যাঁরা ছন্দ মনে করেন তাঁদেরকে এ কথা বুঝানো কঠিন যে প্রচলিত ছন্দ তিনটি (অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত) মেনে কবিতা লিখতে অন্তমিল রাখাটা জরুরী কোনো ব্যাপার নয়। অবশ্য প্রথাগত ছন্দও মেষ কথা নয়, সমর সেনের কবিতা দাঁড়িয়ে আছে প্রথাগত ছন্দের বাইরে, অরুণ মিত্র তার দীর্ঘ সৃজনশীল কাব্যজীবনে প্রমান করেছেন ছন্দজ্ঞানহীনতার পরিচয় না দিয়েও ছন্দহীন কবিতা লেখা যায়। ৬ এই স্বাধীনতাকে রবীন্দ্রনাথও অনিবার্য বলেই জেনেছিলেনঃ ‘আইনের লৌহছাঁচে কবিতা কভু না বাঁচে। ’৭ স্বাধীনতার সুযোগে যাঁরা স্বেচ্ছাচারিতা করেন, আমি তাঁদেরকে সমর্থন করে একথা বলছিনা।

ছন্দ আমাদের আলোচ্য বিয়ষ নয়, প্রসঙ্গান্তর করা যাক। গ- শব্দের ইটঃ কবিতার বাড়ি ‘এক ধরনের কবিতা আসলে ভাস্কর্য, কিন্তু শব্দ ও বাক্যের মধ্যে উচ্চারিত হতে চায়। ’৮ কবিতার শরীরে আছে বিপুল গহনার ধারণক্ষমতা- শব্দ উপমা প্রতীক রূপক অনুপ্রাস চিত্রকল্প যমক ইত্যাদি। কবিতায় কী-না ব্যবহৃত হয়- পুরাণ ইতিহাস ভূগোল জ্যামিতি বিজ্ঞান ফ্রয়েড মার্কস ইত্যাদি। কবিতায় কোনো শব্দের অর্থ উৎস বা প্রসঙ্গ যদি পাঠক না বুঝতে পারেন তাহলে কবিতাটির অর্থ তাঁর কাছে পরিস্কার হবে না।

কিিবতায় ভূগোলের প্রসঙ্গ আসছে এমন একটি উদাহরঃ ‘নাথু সংকটে হাঁকে তিব্বতী হাওয়া’৯- অর্থাৎ নাথু-লা- পাসে উত্তরের প্রবল হাওয়া বইছে। আপাত-দুরূহতার কুয়াশায় কবির চমৎকার একটি রসিকতা পাঠকে কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। ডাবলিনের এক কবির বইতে সূচীর বাইরে একটি কবিতা [শিরোনাম ঞরষষু] গ্রন্থিত ছিল; এটিকে মুদ্রন প্রমাদ বলে জানলে রসিকতাটি অজানাই থেকে যাবে। ডাবলিনের দুধ ওয়ালারা যে -আধকাপ দুধ ‘ফাউ’ হিসেবে দেয় তার নাম হচ্ছে ঞরষষু১০; রসিকাতটি উপভোগে এখন নিশ্চয়ই বাধা থাকছে না। এক একজন কবি এক এক ধরনের শব্দ পছন্দ করেন।

শব্দচয়ন কবিকে স্বাতন্ত্র দেয়, তাঁর অবস্থান ও সময়ের পরিচয় দেয়; এ যেন অনেকটা পোষাক দেখে একজন মানুষের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করার মতো ব্যাপার। কবিতা বুঝতে হলে নিষ্ঠা, একাগ্রতা দরকার; জানার আগ্রহটা বহুমূখী হওয়া দরকার। হৃদয় ও মেধা- এ দু’য়েরই মনোযোগ চায় আজকের কবিতা; কবিতাতো বোম্বের ‘হিট’ চলচ্চিত্র নয়, যে, বুঝতে হলে মাথা খাটাতে হবেনা। কবিতা পাঠকদের প্রবণতা এরকমেরই, সহজে র্ধ্যৈ হারান না বা ক্লান্তিবোধ করেন না তাঁরা’১১- বাড়িয়ে চলেন জানার বলয়। তাই আজ যে- কবিতা দুরূহ মনে হয়, কাল তার রস আয়ত্তে এসে যায়, সে-কবিতা হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য, হৃদয়গ্রাহ্য, মেধাগ্রাহ্য।

ঘ-মাধুকরী কাঠগড়া বনলতা ‘গ্রহণ আর বর্জনের সমন্বয়ই সব শিল্পের মূল কথা’। ১২ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক কবিকে তুলনা করেছেন মাধুকরীর সাথে। ’১৩ আহারের জন্য মাধুকরী ঘুরে বেড়ায় দ্বার থেকে অন্য দ্বারে। আধুনিক কবিতার শরীর গড়ে ওঠে পৃথিবীর প্রেক্ষাপটকে গ্রাহ্য করেই। ।

শুধুমাত্র জানা-কথা বা ধারণার প্রতিধ্বনি করা কবিতার কাজ নয়; কবির ভেতরের ‘শিল্পী’টি অতৃপ্ত বল্ইে তার এই বিচিত্রগামীতাঃ ‘মূর্তি তার কোনোই স্থানীয়/রঙে বেঁধেঃ সাধ তো মেটেনা/রূপের উদ্বৃত্ত কাঁদে প্রণে। ’১৪ জীবনানন্দ দাশ যখন বিচ্ছিন্নতাবোধের কথা বলেন১৫ তখন এদেশ বিচ্ছিনতাবোধের ধারণাই ছিল না। আমাদের আজকের ‘বোধ’ তাঁর ধারণায় এসেছিল অর্ধ শাব্দীকাল আগেই! পাঠককে এই বিবেচনা রাখতে হবে যে, শুধু ‘নাগাল ডাল নামিয়ে’১৬ ‘ফল কি ফুল’১৭ পেড়ে দেয়া কবির কাজ নয়। তাই কবির আহরিত ফলের স্বাদ পাঠকের পূর্বজ্ঞাত হতে হবে বা কবির চয়ন-করা ফুলের সৌরভটি পাঠকের জানা থাকতে হবে এমন আাশা করা ঠিক নয়। কবির দেয়া ফল-ফুলে (কবিতা) পরিচিত, বোধ্য স্বাদ-ঘ্রাণ না পেলেই তাকে দুর্বোধ্যতার অপবাদ দিয়ে খারিজ করা ঠিক নয়।

প্রকৃতিতে এমন ফুলও তো অরন্যে আছে যার সুবাস ্আমরা নিজস্ব ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে পাইনি। প্রিয় পাঠক, মধুকর তো শুধু আপনার ঘরের বোরো ধানের চালই সংগ্রহ করেনি, তার হাঁড়িতে আউস আমন ইরি বালামের বিচিত্র সামাহার দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন! অজানা ও নতুন বিষয়ে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে হয়, অচেনা ফুল দেখামাত্র ধুতুরা ভেবে ছুঁড়ে ফেলাটা জ্ঞানীর লক্ষণ নয়, রুচির লক্ষণ নয়, জিজ্ঞাসু-মনের লক্ষণও নয়। এরকম অবস্থায় অপবাদদাতার আলস্যটা ধরা পড়ে আর সবচেয়ে প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে সংস্কারচ্ছন্ন মানসিকতাটি। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মাঝে মধ্যে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়ঃ ‘তোমার সড়ক নম্বর দুঃখ বাড়ি নম্বর কষ্ট’- এর কবিতাগুলো তো তবু বোঝা যায়, এখন পত্র-পত্রিকায় তোমার যে সব লেখা দেখি (লক্্যষ করুন, ‘পড়ি’ নয়, ‘দেখি’) সেগুলো তো বুঝিনা। ’ প্রিয় ফরিয়াদী, আমি অর্ধিিশ্কসত কবি, তাই বলে কি শিক্ষিত হবার চেষ্টা থাকবে না? সে চেষ্টার ছাপ কি কবিতায় থাকবে না? 'উবংরৎব ড়ভভ ঃযব সড়ঃয ভড়ৎ ঃযব ংঃধৎ'১৮ তো সাধারণ ঘটনা।

দুর্বোধ্যতার এই অনুযোগ অভিযোগ অপবাদ রবীন্দ্রযুগেও ছিল, পৃথিবীর সর্বত্রই একই চিত্র; ফ্রান্সের এক কবি একবার অধৈর্য হয়ে বলেছিলেন 'ওভ সু সরহফ রং ৎরপযবৎ, সড়ৎব ৎধঢ়রফ, ভৎববৎ, সড়ৎব ফরং পষরঢ়ষরহবফ ঃযধহ ুড়ঁৎং, হবরঃযবৎ ুড়ঁ হড়ৎ ও পধহ ফড় ধহুঃযরহম ধনড়ঁঃ রঃ'১৯ সাধারণ পাঠকও ছিলেন সব যুগেই; আজ যাঁরা ‘বনলতা সেন’কে দুর্বোধ্য বলছেন না, সেই সাধারণ পাঠকবৃন্দ কিন্তু ‘বনলতা’কে জন্মমাত্র আলিঙ্গন করতে পারেননি। । কারন, কবিতার ভাষা একটু অগ্রবর্তী ভাষা; তাকে বুঝতে হলে আততায়ীর মতো অনুসরণ করলে হবে না, বন্ধুর মতো পাশাপাশি হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। ঙ- হীরে মানিকের খনি ‘যদি তুমি চাও অমরতা তবে সংহত কর বাক, থামাও প্রগল্ভতা। ’২০ আধুনিক কবিতায় অতিকথনের স্থান নেই, স্থান নেই ‘মন্থর পুনরাবৃত্তি’২১র।

কবিতায় মিতভাষন ও পরিমিতি বোধ দরকার, আবেগকে সংযগ করে সংযমী হওয়াটাও জরুরী; এ থেকেই এসে যায় ভাষার একটা স্মার্ট ভঙ্গী। ভাষার এই রূপটাকে জানতে হবে পাঠককে। আধুনিক কবিতা ‘কোনো আগন্তুক নয়’২২; হঠাৎ করে সে চলে আসেনি, কবিতার ঐতিহ্য পরস্পরায় তার এই উপস্থিতি। প্রাচীনকালে কবিতা দাঁড়াতো সুরের ওপরে, তারপর সে পরজীবিতা কাটলো কবিদের বহুবছরের সাধনায়, কবিতা দাঁড়ালো কথার ওপরে। ২৩ সেই থেকে এই শিল্প মাধ্যমটির পেছনে কবিদের নিষ্ঠা শ্রম মেধায় প্রয়োগে এক পরিবর্তনশীল ইতিহাস গড়ে উঠেছে।

কবিতার ভাষা আলাদা, কিছুটা প্রসাধন-কৃত; খবরের কাগজের ভাষায় তো কবিতা দেখা হয়না। কবিদের ঘর-গেরস্থালি সাধনার ‘বন্ধুর দূর্গে’ পাকাপোক্ত হয়ে থাকে, আজকের কবির এই বক্তব্য থেকে ব্যাপারটা স্বচ্ছ করে নেয়া যায়- ‘প্রতি দশকে প্রতি যুগে আবিস্কারকের আগ্রহে কবিরা খনন করেছেন মাতৃভাষাকে; খুঁজে নিতে চেয়েছেন প্রতিটি সম্ভাবনাকে। কারো হাতে বাংলা ভাষা হয়ে উঠেছে অভিজাত্যের প্রতীক। , কারো হাতে অনন্ত্র মাধুর্য, কারো কবিতায় তা চাঁছাছোলা শলাকার মতো তীক্ষè, কারো হাতে ঘুমপাড়ানী মদক। ’২৪ অর্থাৎ কবিরা হলেন ভাষা খনির খননকারী দল- যাঁরা কিনা সেখান থেকে হীরেমানিক তুলে আনেন।

অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ‘খনি’ থেকে হীরেমানিক তোলা হয়; এই শ্রমলব্ধ সম্পদকে ইচ্ছাকৃত-দুব্যোধ্যতার আড়ালে রেখে পাঠক থেকে দূরে সরে যেতে চাইবেন কোন্ কবি? কবির কাছে শব্দই ইশ্বর [ও শব্দ’২৫]- কবিতায় ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই একজন সৎকবির কাছে অনিবার্য: সে কঠিন হলে কঠিন, সহজ হলে সহজ। তাই, অন্যদিকে, ইচ্ছাকৃত-সরলীকরণের মাধ্যমে পপগায়কের ধরনে জনপ্রিয়তা পাবার বাসনাও কবির মনে ঠাই পায়না। কবিরা ‘নিজ হাতে নিজস্ব ভাষায়’২৬ লিখতে-বলতেই সচ্ছন্দ, আরোপিত ভাষঅয় তাঁরা সৃজনশীলতার চর্চা করতে অনীহ। ‘কবিরা অনেক সময় পাঠককে উদ্যমী করার জন্য দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করেন’২৭ (যা আপাত দৃষ্টিতে নিরর্থক); যেমন, ‘বৃষস্কন্ধে সূর্য স্থির বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মের মড়কে’২৮- ‘বৃষস্কন্ধ’ অর্থ আমাদের গৃপালিত প্রাণীটির জোয়াল-টানা কাঁধ নয়, এর অর্থ জ্যৈষ্ঠ মাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় ‘প্রবেশ পত্র’ হচ্্েছ বাংলা অভিধান, বিষ্ণুদের কাব্যজগতে উঁকি দেবার আগে কিছুটা সংস্কৃত জ্ঞান প্রয়োজন, শামসুর রাহমানের ‘দিব্যরথ’- এ চড়াটাকে আনন্দঘন করতে হলে চাই মিথোলজির (বিশেষ করে গ্রীক মিথ) ওপর কিছুটা পড়াশোনা; কবির ব্যক্তিজীবনের টুকিটাকি জানাটাও অনেক সময় কাজে লাগে। এমনতরো অনেক ছোট বড় প্রতিবন্ধক থাকে পাঠক ও কবিতার মাঝখানে; আশার কথা এই, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাথমিক কিছু ধারণা থাকলে বাধাগুলো ডিঙিয়ে কবিতার কাছে যাওয়া যায়।

চ- রহস্যপ্রধান এলাকা’২৯ ‘কথার চেয়ে আরো ঢের নিরিবিলি কথাকল্প আছে- সন্দ্যার দেহলী প্রান্তে.... তারই গল্প হোক। ’৩০ কবিতা কি সত্যিই জরুরী? কবিতা পড়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি? কবিতা না পড়ার কারণে কোটি কোটি মানুষের জীবনযাপনে কোনো সমস্যা হয় বলে তো শোনা যায়না। তবে কি কবিতার কোনোই উপযোগিতা নেই?- এ সবের কোনো হ্যাঁ-না জবাব হয়না; অন্যদিকে, সব কবিতাই যে বুঝতে হবে এমন দাবিও কেউ করছেনা। কবিতায় চিরকালই রহস্যময়তার একটা স্থান আছে; এ রহস্যের কিনারা হওয়াটাও সুখকর অভিজ্ঞতা এনে দেয়। কবিতা পড়ে তো অংকের মত ‘কড়ায়-গন্ডায় বুঝিয়া পাইলাম’- এমন সন্তুষ্টি পাবার দরকার নেই।

কবিতা পড়ে পাঠকের ভালো লাগার বোধ হলো, চেতনাকে স্নিগ্ধ বা শাণিত করলো, অবচেতনে ঘুমিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলো, ‘চেনা আলো’র ঝাড়বাতিটা মনের মদ্যে দুলে উঠলো একবার দু’বার কিংবা কোনো একটা লাইন পড়ে মনে হলো ‘আমারও ছিল মনে’৩১- কবিতা যদি ন্যুনতম এইটুকু কাজ করে থাকে পাঠকের মেধা ও হৃদয়ে, তাহলেই তো যথেষ্ট বলে মনে হয়। কবিতায় বিনোদন আছে। তবে সেটা নিচু তারে বাঁধা, কোমল ও সুক্ষè; নাটক-রোমাঞ্চ কাহিনী-সিনেমা-সঙ্গীতে যে-ধাঁচের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে (প্রতিটি শিল্প মাধ্যম থেকেই ভিন্œ রকম রস অস্বাদন করা যায়) কবিতায় সে-রকমটি আশা করা অনুচিৎ ‘সে আনন্দের স্ফূরণ চিত্তের উর্ধতম অন্তরীক্ষে, সন্দেশ ভক্ষনজাত প্রীতির সমপর্যায়ে তাকে ফেলা যায় না’। ৩২ কবিতার ইতিহাস হচ্ছে তার টেকনিকের ইতিহাস৩৩- কিন্তু রহস্যময়তা সবসময় বিশ্বস্ত দোহারের ভূমিকা পালন করে আসছে। একটি-দুটি শব্দই এমন ইঙ্গিতময়তা ছেিড়য় দেয় যে, কবিতায় আর পুরো প্রসঙ্গটা ভেঙে বলবার দরকার পড়ে না; এই বিশিষ্টতা কবিতাকে যেমন জোরালো করেছে তেমনি শিল্পিত করে তুলেছে।

তবে এই রহস্যের পর্দা সরিয়ে দেখতে পারা চাই, নয়তো ‘প্রসাদ’ লাভ করা যাবেনা; তবে এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করা যেতে পারেঃ যিধঃ'ং হবাবৎ শহড়হি রং ংধভবংঃ রহ ঃযরং ষরভব.’৩৪ ছ- ‘বুঝিবার কিছু নাই’ ‘ওঃ রং (চড়বঃৎু) সবঃধঢ়যড়ৎ, ংধুরহম ড়হব ঃযরহম ্ সবধহরহম ধহড়ঃযবৎ, ংধুরহম ড়হব ঃযরহম রহ ঃবৎসং ড়ভ ধহড়ঃযবৎ.’৩৫ এ রচনাটি কোনো পূর্ণাঙ্গ আলোচনা নয় (সীমিত মেধায় তা সম্ভবও নয়); আলোচনার সূচনাবিন্দু মাত্র। সম্ভবত সমাপ্তি বিন্দুতে পৌঁছাও সম্ভব নয়, কারন আজ অবধি আমরা নিচের সিদ্ধান্তটির চেয়ে ভালো কিছু বলতে পারিনিঃ ‘কিছু একটা বুঝাইবার জন্য কেহতো কবিতা লেখে না। ... এ জন্য কবিতা শুনিয়া কেহ যখন বলে ‘বুঝিলাম না’ তখন বিষম মুশকিলে পড়িতে হয়। কেহ যদি ফুলের গন্ধ শুঁকিয়া বলে ‘কিছু বুঝিলাম না’ তাহাকে এই কথা বলিতে হয়, ইহাতে বুঝিবার কিছু নাই, এ যে কেবল গন্ধ’৩৬ সত্য্ইি তো, এই ‘কিছু বুঝিলাম না’র কোনো যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দেয়া কি সম্ভব! জ- অভিজ্ঞান শকুন্তলা ‘বৃক্ষ আর পুস্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা। ’৩৭ শকুন্তলা দিয়ে শুরু করেছিলাম।

শকুন্তলা-উপাখ্যানের পরিণতি স্মরণ ক’রে শেষ করা যাক। শকুন্তলার হারানো আংটিখানি অনেকদিন পর একটি মাছের পেটে পাওয়া যায়, সে রাজ-অঙ্গুরীয় রাজার কাছে ফেরত আসে। তা দেখে রাজা বিস্মরণ থেকে জেগে উঠে শকুন্তলার কথা মনে করে অনুতাপ করতে থঅকেন; শেষাবধি তাঁদের যোগাযোগ ঘটে, মিলন হয়। ৩৮ লেখার শুরুতে পাঠক ও কবিতাকে তুলনা করেছিলাম যথাক্রমে রাজা ও শকুন্তলার সাথে। এই যৎকিঞ্চিৎ লেখাটি অভিজ্ঞান-অঙ্গুরীয়ের ভূমিকা নেবে-লেখার শুরুতে এমন অভিলাষও ছিল।

ঝ-তথ্য-নির্দেশ ১. নবনীতা দেবসেন। । অভিজ্ঞান, শ্রেষ্ট কবিতা ২. ঐ ৩. সুনীল পঙ্গোপাধ্যায়- কৃত ‘শকুন্তলা’ ৪. জীবনান্দ দাশ। ৫. দীপ্তি ত্রিপাঠী। আধুনিক বাংলা কবিতার অঙ্গিক ৬. নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

ছন্দের ‘সহজপাঠ’ ৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভূমিকা, বিসর্জন ৮. এজরা পাউন্ড। আবু সয়ীদ আইউবের অনুবাদ ৯. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। জাতিস্বর ১০. অশ্রু কুমার সিকদার। আধুনিক কবিতার দিগ্বলয় ১১. নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

কবিতার কি ও কেন ১২. বিমল মিত্র। ‘দেশ’ ১৩. অশ্রু কুমার সিকদার। পূর্বোক্ত ১৪. বিষ্ণু দে। শিল্পের আবেগে ১৫. জীবনানন্দ দাশ। বোধ ১৬. প্রেমেন্দ্র মিত্র।

মুখ ১৭. ঐ ১৮. অজ্ঞাত ১৯. পল ভ্যালেরি ২০. শামসুর রহমান। কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি (গ্রন্থ) ২১. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। ২২. আহসান হাবীব। ‘আমি কোনো আগন্তক নই’ ২৩. শঙ্খ ঘোষ। ছন্দের বারান্দা ২৪. মল্লিকা সেন গুপ্ত।

আধুনিক কবিতা ‘বেঁচে থাকারই একটা লড়্ইা’ ২৫. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। শব্দ দুই, শ্রেষ্ট কবিতা ২৬. নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। প্রেমের কবিতা ২৭. দীপ্তি ত্রিপাঠী। পূর্বোক্ত ২৮. বিষ্ণু দে। কাজলকে ২৯. আবুল হাসানের কবিতার শিরোনাম।

আবুল হাসানের অগ্রঙ্খিত কবিতা। ৩০. বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়। কথারা ঘুমোলে পর ৩১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জুতা আবিষ্কার ৩২. আবু সয়ীদ আইউব। পথের শেষ কোথায় ৩৩. লুই আরাগ।

সূত্র: শিল্পতরু ৩৪. ডিলান টমাস। ৩৫. রবার্ট ফ্রুষ্ট। ৩৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবন স্মৃতি ৩৭. বিনয় মজুমদার। কবিতা- পরিচয়: অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত ৩৮. সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়-কৃত ‘শকুন্তলা’ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।