আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রার্থনা, যেন ‘মিরাকল’ হয়, যেন আলো ফিরে আসে রুমানার চোখে

আমি নির্বাক হয়ে গেলে তোমার পতন অনিবার্য ! ‘এখন মিরাকলই ভরসা। এছাড়া আর কোনো কিছু করার নেই। রুমানার দু’চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। ’ চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রলয়া ও অরবিন্দ আই হাসপাতালের চকিৎসকরা এমনটাই বলেছেন রুমানা ও তার পরিবারের সদস্যদের। চিকিৎসকদের পরামর্শেই রুমানা ম্যাডামকে চেন্নাই থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

দিনটি ছিল গত বৃহস্পতিবার। দিনের আলো ফুরিয়ে তখন সন্ধ্যা নামছিল। চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের ডাঃ প্রমোদ ভেন্ডের চেম্বার। চিকিৎসকের সামনে বসে আছেন রুমানা ম্যাডাম, তার পাঁচ বছরের কন্যা আনুশাহ আর বাবা মেজর (অব.) মনজুর হোসেন। চিকিৎসক এই সময়টিকেই বেছে নিলেন রুমানা মনজুরকে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর একটি দুঃসংবাদ দেবার জন্য।

সমস্ত রিপোর্টগুলিতে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে ডা. প্রমোদ ভেন্ডে জানালেন, রুমানা আর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন না। বাকিটা মিরাকল। খবরটি শুনেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন রুমানা। জড়িয়ে ধরলেন একমাত্র সন্তান আনুশাহকে। বাবাকে বললেন ‘আমি কি আমার মেয়েকে আর দেখতে পাবো না।

’ তারপরের কয়েকদিন রুমানা আর বেশি কথা বলেননি। সবসময়ই জড়িয়ে ধরে রেখেছেন আদরের একমাত্র সন্তান আনুশাহকে। সারাণই কেঁদেছেন। কখনো উচ্চস্বরে আবার কখনো নীরবে চোখের জল ফেলেছেন। বাবাকে বারবার প্রশ্ন করেছেন, ‘এই চোখে কি আর আলো ফিরবে না।

তিনি কি আর দেখতে পাবেন না। এই কি তার প্রাপ্য ছিল? কী এমন অপরাধ ছিল তার যে তার চোখ দুটো অন্ধ করে দেওয়া হলো। ’ বাবা মনজুর কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তার চোখেও সারাটা সময় ছিল জলে একাকার। কী স্বান্তনা দিবেন তিনি মেয়েকে।

কিছু যে বলার ভাষা নেই তার। সোমবার সন্ধ্যায় ল্যাব এইড হাসপাতালের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে মনজুর হোসেন যখন এসব কথা বলছিলেন, তখনও তার চোখে জলের রেখা। চিকচিক করছে। একবার বাম হাতটা তুলে চোখ মুছলেন। আমার পেশা সাংবাদিকতা।

এতদিন রুমানার ঘটনাটা এক সহকর্মী কাভার করেছে। আজ তার ডেধফ। তাই অ্যাসাইনমেন্টটা ছিল আমার ওপর। দুপুর থেকেই বসে ছিলাম ল্যাবএইড হাসপাতালে। রুমানা ম্যাডাম আসলেন সন্ধ্যা প্রায় ৬টায়।

আর তার বাবার সঙ্গে কথা হলো সাড়ে ছয়টার দিকে। রুমানার বাবা মেজর (অব.) মনজুর হোসেন বললেন, চেন্নাইয়ের দুটি বিশেষায়িত চু হাসপাতালের নামকরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে রুমানাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অসংখ্য পরীা-নিরীার পর চিকিৎসকরা জানালেন, রুমানার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। চোখের ‘আইবল’ ও ‘রেটিনা’ কাজ করছে না। বাইরে থেকে চোখে আলো ফেললে মস্তিষ্ক সেই আলোর সংকেত ধরতে পারছে না।

এ কারণে রুমানা দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। বলেই কাঁদলেন তিনি। এবার তার চোখ থেকে জল গরিয়ে পড়ল, কয়েক ফোটা। আর কথা বলতে পারলেন না তিনি। সাংবাদিকতা করি বলে এমন অনেক ঘটনা আমাদের প্রত্য করতে হয়।

রুমানার বিষয়টি একটু অন্যরকম। লিফটে ওঠার পর নিজের চোখ দু’টি বন্ধ করলাম। অন্ধকার। অনুভব করার চেষ্টা করলাম মানুষ অন্ধ হয়ে গেলে কেমন লাগে। এই কষ্ট বোঝার মতা আমাদের নেই।

আমাদের যাদের দৃষ্টি এখনো আছে, আমরা তারা কখনো এটা অনুভব করতে পারবো না। আমি ভাবছি, যখন অনেক দিন পার হয়ে যাবে, যখন রুমানা ম্যাডামের প্রিয় সন্তান আনুশাহ অনেক বড় হবে, তখন কি ম্যাডাম মনের চোখ দিয়ে তার সন্তানকে কল্পনা করতে পারবেন? কতবড় হলো তার আনুশাহ। আনুশাহকে তো তার শেষ দেখা ৫ জুন, হায়েনা হয়ে যখন তার জীবন সঙ্গী তার ওপর হামলে পড়েছিল, তারপর তো আর কিছুই তিনি দেখেননি। কিংবা এই যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, যেখানে তিনি একদিন ছাত্রী হয়ে টিএসসির সবুজ চত্ত্বরে কতশত আড্ডা দিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে। কিংবা শিক হওয়ার পর টিচার্স কাব, টিচার্স রুমে সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা, আইআর ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং, কোনো কিছু কি তিনি নতুন করে দেখতে পাবেন? রংচটা বিল্ডিংটা হয়তো কোনো একদিন কালারফুল হয়ে যাবে কিন্তু ম্যাডাম কি সেই রঙিন অনুভব করতে পারবেন? তার হয়তো আর কোনোদিন আয়নার সমনে দাঁড়ানো হবে না।

হয়তো না, হয়তো এসবই সম্ভব, মিরাকল কিছু যদি ঘটে। আমি, আমরা, যাদের এখনো এতটুকু বোধ আছে, তারা মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছি, এমন মিরাকল একটা কিছু ঘটুক, আলো ফিরে পাক রুমানা ম্যাডাম। দেশে ফিরেই আবারো নির্যাতনকারী স্বামীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন রুমানা ম্যাডাম। হয়তো বিচারে হাসান সাইদের বিচার হবে, তার জেল হবে কিংবা অর্থের জোরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে তিনি জামিন নিয়ে বেেিয় আসবেন। এতে অবশ্য এখন আর রুমানা ম্যাডামের কিছুই যায় আসবে না।

তিনি আর কোনোদিন পৃথিবীর আলো দেখবেন না। তবু হায়েনারূপী হাসান সাইদের দৃষ্টান্তমূলক একটা শাস্তি যদি হয়, তবে এমন অনেক রুমানা হয়তো হায়েনাদের কবল থেকে বেঁচে যাবে, তাদের চোখ থেকে আলো নিভে যাবে না।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।