আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘এখানে মাটির বুকে সর্বশেষ জয় মানুষেরি’

১৯৪৪ সনের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। কলকাতা থেকে ট্রেনে চড়ে যাদবপুর স্টেশনে এসে নামলেন দু’জন। একজন মামা, একজন ভাগ্নে। ট্রেন থেকে নেমে দু’জনের চোখ পড়ল একই জায়গায়। একটু দূরে একটি লোক কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে।

তখন দুর্ভিক্ষ। কলকাতায় চালের দাম ৪০-৫০ টাকা। না খেয়ে কত লোক মারা যাচ্ছে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় লাশ দেখা যাচ্ছে। এটাও কি লাশ? মামা এগিয়ে গেলেন।

লোকটার নাকের কাছে হাত দিয়ে বললেন, ‘এখনও বেঁচে আছে, একটু গরম দুধ আনতে পারবি?’ কিশোর ভাগ্নের পকেটে চার আনা পয়সা ছিল। পাশের রেস্তোরাঁ থেকে একটু দুধ আনল। মামা খুব যত্নে লোকটাকে দুধটুকু খাওয়ালেন। তারপর দু’জনে ধরে লোকটাকে যাদবপুরের এক লঙ্গরখানায় পৌঁছে দিলেন। এরপর থেকে মামার খাওয়া কমে গেল।

ঘরে জানিয়ে দিলেন, ‘আমার খাবারের অর্ধেক কাউকে দেবেন। ’ এরপর প্রায়ই তিনি খেতেন না। খাওয়ার সময় হলে বলে যেতেন, ‘আমার খাবার কাউকে দেবেন। ’ মামা তখনও বেকার। তার পকেটে বেশি পয়সাও থাকত না।

দিনের পর দিন তিনি এভাবেই উপোস করে কাটিয়েছেন। এ সময় তিনি রচনা করেছেন তার কালজয়ী ‘লাশ’ কবিতা—‘জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের ’পর/সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর। ’ ১৯৪৬ সাল। কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হলো। সে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল বিহারে।

আরও অনেক জায়গায়। মামা অস্থির হয়ে উঠলেন। ঘন ঘন পায়চারি করতেন। সেই দাঙ্গার মধ্যেই একদিন ছুটে গেলেন কলকাতা বেতারে। রেডিওতে মেজ মামার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—‘এবার দেখেছি নিজের রক্ত—দেখেছি আর/রক্ত নেবার পাশবিক মত্ততা।

’ এতক্ষণে নিশ্চয় এই মামার পরিচয় অনেকের জানা হয়ে গেছে। তিনি আর কেউ নন, বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষ মহাকাব্যের মহাকবি, মহাজীবনের মহাকবি ফররুখ আহমদ, যাকে বহু নামে ডাকা হয়, বহু অভিধায় অভিহিত করা হয়। পারতপক্ষে তিনি মানুষের কবি, মানবতার কবি। সকল আভিজাত্য, কুল-মান-গৌরবের ঊর্ধ্বে তিনি গণমানুষের কাতারে মানবিক মর্যাদাবোধের এক অনন্য প্রতীক। মানুষের পাশবিক মত্ততা তাকে অস্থির না করে পারে না।

ফররুখ আহমদের ভাগ্নে সুলতান আহমদের স্মৃতিকথা থেকে আমরা জানতে পারি এসব ঘটনা। ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪)। ১৯৭৪ স্মরণীয় আরেকটি সন। দুর্ভিক্ষের সন। শাসকগোষ্ঠী যেন ১৯৪৪ সালে রচিত সেই স্মরণীয় পঙিক্তটিরই বাস্তবায়ন ঘটালেন কবির জীবনে।

তারা তার ‘ক্ষুধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার। ’ [দ্রষ্টব্য : সাহিত্য সাময়িকী, দৈনিক আমার দেশ, ১০ জুন, ২০১১] হংকং ভিত্তিক ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকা তাদের ওই সময়ের দুর্ভিক্ষের ওপর রচিত প্রতিবেদনে দাবি করে— ‘না খেতে পেয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি মারা গেছেন। ’ সে সময় যদি ফররুখ আহমদের মুখের গ্রাস সরকার আটক করে নাও রাখত, তার পাওনা যদি তাকে কড়ায়-গণ্ডায়ও যথাসময়ে পৌঁছে দিতো তাহলেও কি ফররুখের মৃত্যু ঠেকানো যেত। তেরোশ পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে যিনি দিনের পর দিন উপোস করে কাটিয়েছেন, সেই ফররুখ মনে হয় ১৯৭৪ সালেও উপোসই করতেন, যখন এ দেশের গণমানুষের জীবন ও জীবিকা গ্রাস করে নিয়েছিল ‘শোষণের ত্রাস’। সত্যিকার অর্থে বিস্ময়ের অধিক বিস্ময় সৃষ্টি করে ফররুখ প্রমাণ করেছেন— ‘এখানে মাটির বুকে, সর্বশেষ জয় মানুষেরি।

’ মানুষকে পরাজিত করার অস্ত্র আজাজিল কোনোদিন হস্তগত করতে পারেনি, পারবেও না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.