আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা-১

ছোটবেলার ঈশপের সেই বুদ্ধিমান কাকের গল্পটি মনে আছে নিশ্চই? গরমে তৃষ্ণার্ত কাক নুড়ি পাথর ফেলে কৌটোর তলানীর পানি সংগ্রহ করেছিল। হাজার বছর ধরে লোকমুখে চলে আসা সেই গল্পের সত্যতা বিজ্ঞানীরা প্রমান করলেন একবিংশ শতাব্দীতে এসে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই তথ্যটি বেরিয়ে আসে প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তার উপর চালানো ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীদের গবেষনায়! বিবর্তনের ধারায় মানুষের মস্তিষ্কের উন্নত ‘সেরেব্রাল কর্টেক্স’(Cerebral Cortex) মানুষকে চিন্তা করার যে অসীম ক্ষমতা দিয়েছে তা কেবল মানুষের একার অধিকার। বর্তমান পৃথিবীতে বিচরনরত ‘প্রাইমেট’(Primate) শ্রেনীর প্রাণীদের মধ্যে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা প্রাণীটির চিন্তার ক্ষমতাও মানুষের সাথে তুলনার অযোগ্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীতে মানুষ তার অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টিকারী যেকোন বাধাকে সহজেই তুচ্ছ করেছে।

কিন্তু আমদের চারপাশের প্রাণীদের আমরা যতটা নির্বোধ ভাবতে অভ্যস্ত, প্রাণীদের সম্পর্কে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষনাগুলো সম্পুর্ন ভিন্ন কিছু তথ্য আমাদের সামনে উপস্থাপন করছে। কিছু অদ্ভুত তথ্য মানুষকে তার আদিপুরুষদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া রাজ্যের ‘গ্রেট এপ ট্রাস্ট’ নামের এক গবেষনাকারী প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন যাবৎ ‘বনোবো’ নামের শিম্পাঞ্জির এক প্রজাতির উপর গবেষনা চালিয়ে আসছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তথ্য হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানে বসবাসরত শিম্পাঞ্জি মানুষের সাথে রীতিমত ভাব আদান-প্রদানে সক্ষম! প্রকৃতি অত্যন্ত রহস্যময় কারনে তাদের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শারীরিক ক্ষমতা দেয়নি, যেটি আমাদেরকে দিয়েছে। তবে তাদের চিন্তার প্রখরতার এই অপ্রকাশিত রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হয়েছে তাদের অনুভূতির ওপর তীক্ষ্ণ নজরদারির কারনে।

‘গ্রে্ট এপ ট্রাস্ট’ এর ‘কানজি’ নামের এক ‘বনোবো’র শব্দভান্ডারে আছে ৩৮৪টি শব্দ। তার যে কোনো প্রয়োজনে সে এই শব্দগুলো ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে। এসব শব্দ সে শারীরিক অক্ষমতার জন্য আমাদের মত মুখে প্রকাশ করতে পারেনা ঠিক,তবে নির্দিষ্ট শব্দের জন্য উপযুক্ত ছবির(symbol) কার্ড সে পছন্দ করতে পারে। শুধু তাই নয় প্রয়োজনীয় শব্দগুলো ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশেও সে অত্যন্ত দক্ষ। যেমন কানজি যখন ‘পিৎজা’ খেতে চায় তখন তার পছন্দের কার্ডগুলো হচ্ছে ‘Bread+Cheese+Tomato=Pizza’।

এবাবে সে তার মনমত বিভিন্ন খাবার অথবা অন্য প্রয়োজনে শব্দগুলোর মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে পারে,যে ক্ষমতা শুধু মানুষেরই আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে প্রানী বলে শুধুমাত্র চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে মনের ভাব প্রকাশেই সে আবদ্ধ থাকেনি। গবেষকরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন তাদের আছে আমাদের মত ব্যাক্তিগত মান-অভিমান ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! যেমন Feel+Kiss+Eat+Kandy=Favourite memory অথবা Big+Water=Flood। এখানে উল্লেখ্য আইওয়াতে সংঘটিত এক বন্যার ঘটনা যখন সে কারো সাথে শেয়ার করতে চায় তখন সে এটি বলে। এখন দেখা যাচ্ছে প্রানীদের ভাব প্রকাশের অন্যতম বাধা তাদের শারীরিক(lack of organs),মস্তিষ্ক বা মানসিক চিন্তাশক্তির অপ্রতুলতা নয়।

কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি,আমরা সৃষ্টির এই অদ্ভুত সুন্দর নিদর্শন গুলোর অনুভূতির প্রতি কতটা সচেতন? আগেই বলেছি মস্তিষ্কের সেরেব্রাল করটেক্স’ই বোধশক্তির(cognition) প্রধান নিয়ামক। সাধারণত ম্যামাল শ্রেণীর প্রানিদের সকলেরই ‘সেরেব্রাল করটেক্স’ রয়েছে যার মধ্যে প্রাইমেটদের মস্তিষ্কের এই অংশটি সবচেয়ে উন্নত। তাই এই শ্রেণির অন্যান্য প্রাণীদের নিয়েও বিভিন্ন গবেষনায় উঠে এসেছে মজাদার এবং ভিন্নধর্মী তথ্য। যার মদ্ধ্যে জঙ্গলে বানরদের অন্যন্য দুর্বল প্রাণীদের সাহায্য করার মানসিকতার কথা আমাদের সবার জানা। এক গবেষনায় দুটি বানরকে দুটি ভিন্ন খাঁচায় রাখা হলো।

তবে তারা একে অন্যকে নিজের খাঁচা হতে দেখতে পারে। তাদের কে শিখানো হলো একটি নির্দিষ্ট চেইন ধরে টানলেই খাবার আসবে। এভাবে কিছুদিন চলা্র পর একটি খাঁচার বানর লক্ষ্য করল সে নিজের খাবারের জন্য চেইন ধরে টানলেই পাশের খাঁচার বানরটি প্রচন্ড ব্যাথায় চিৎকার করে ওঠে। কারন গবেষকরা এটি এমনভাবে এটি ডিজাইন করেছিলে যাতে শিকলটি টানলে পাশের খাচাঁর বানরটি ইলেক্ট্রিক শক খায়। এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করার পর প্রথম বানরটি পাশের বানরটিকে কষ্টের হাত থেকে বাচানোর জন্য খাওয়া বন্ধ করে দিল,এমনকি অভুক্ত থেকে প্রায় অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও অন্যের কষ্টের কথা চিন্তা করে সে খাবার মুখে নেয়নি।

এখানেই শেষ নয়। এই গবেষনাটির বাকি অংশের ফলাফল আমি আপনাদের লেখার শেষে জানাবো। বুদ্ধিমত্তা ও ভাবাবেগ এর এমন উদাহরন পাওয়া যায় অন্যান্য প্রাণীদের মাঝেও। মানুষের সাথে ডলফিনের সখ্যতার চিত্রগুলো আমরা ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ এ প্রায় দেখি। হাতিরা অন্য হাতির দেহাবশেষের প্রতি সংবেদনশীল এবং বৃদ্ধ হাতি মৃত্যুর আগে সাধারনত দল ত্যাগ করে নিঃসঙ্গ হাটতে থাকে এবং গহীন জঙ্গলে একা আশ্রয় নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে থাকে।

এছাড়া সিংহ ও হায়েনার মত দলবদ্ধ ম্যামালরা শিকার করার সময় অসাধারন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। সিংহরা দলবদ্ধভাবে শিকারকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে এবং এসময় তারা দূর থেকে একজন অন্যের প্রতি ইশারাযুক্ত ইঙ্গিতে অভ্যস্ত যা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক! হায়েনারা শিকারে যাওয়ার আগে পারস্পরিক ভাব-বিনিময় করে নির্ধারন করে নেয় আজ কি ধরনের শিকার তারা ধরতে যাচ্ছে!একটি ইদুঁর যখন কষ্টে কাতরাতে থাকে তখন অন্য ইদুঁররাও একই ভাবে,একই ছন্দে তার সাথে শরীর নাচাতে থাকে। হয়তো তাদের বিশ্বাস এতে তার বন্ধুটির কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে। আজ আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ট জীব হয়ে ভাবি অন্যের দুঃখের প্রতি এরকম স্বার্থহীন সমবেদনা আমদের মধ্যে কোনদিন জন্মাবে? সেরা হয়েও আমাদের সবার মাঝে কিসের যেনো অভাব যা প্রকৃতি সাজিয়ে দিয়েছে তার নিম্নশ্রেনীর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে! বানরকে নিয়ে পরিচালিত সেই গবেষনাটি একইরকম মানুষকে নিয়েও করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে কি হয়েছিল জানেন? মানুষ নিজেকে ছাড় দেয়নি।

প্রচন্ড ক্ষুধার্ত হওয়ার পর সহ্য করতে না পেরে সে অন্য একটি মানুষের জন্য কষ্টকে বরণ করেনি(এখানে অন্য খাচার মানুষটিকে অবশ্য সত্যিকারের শক দেওয়া হয়নি,সে ছিল একজন দক্ষ অভিনেতা)। আমরা মনে হয় এবার হেরে গেলাম! (চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।