আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অসাধারণ একটা আর্টিকেল।

ভাল ভাল স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। নিজকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এমন একটি জায়গা, যেখানে দেখা যায় কারও মুখে নির্মল আনন্দের হাসি আর কারও অশ্রু। সেখানে জমি বেচাকেনার নিবন্ধীকরণ হয়। জমি যে কেনে, তার আনন্দ অপার।

জমি যে বিক্রি করে, এবং তা যদি হয় তার শেষ সম্বল, তার বুক ভরে যায় বিষাদে। সে দৃশ্য আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি। কারণ, গত ৪০ বছরে আমাকে যতবার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে, সম্ভবত আমাদের কোনো মাননীয় সাংসদেরই সে প্রয়োজন হয়নি। জমি নিবন্ধনের সময় বিক্রেতার যাওয়া বাধ্যতামূলক। ক্রেতার না গেলেও চলে।

তার প্রতিনিধি কেউ উপস্থিত থাকলেই হয়। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের চত্বরে অনেকবার দেখেছি এক প্রান্তে চলে মিঠাই-মন্ডা খাওয়ার ধুম, অন্য প্রান্তে কেউ চোখ মোছে আঁচলে অথবা লুঙ্গি বা ধুতির খুঁটে। অবশ্য সেসব হয় ব্যক্তিপর্যায়ে কেনাবেচায়। দেশের সবচেয়ে দামি জমির মালিক গণপ্রজাতন্ত্রের রাজধানীর কর্তৃপক্ষ। সেই কর্তৃপক্ষ যখন দেশের সবচেয়ে মাননীয় মানুষদের কাছে জমি বিক্রি করে, তখন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে শুধু আনন্দের ঘটনাই ঘটে, বেদনার লেশমাত্র থাকে না।

সবচেয়ে বেশি আনন্দ বাংলাদেশের ভোটদাতাদের। তাদের আনন্দ এ কারণে যে, তাদের ভোট প্রদান বৃথা যায়নি। মহান জাতীয় সংসদে মাননীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান ৬ মার্চ আনন্দের সঙ্গে জানিয়েছেন, নবম জাতীয় সংসদের ১৯৮ জন সাংসদ, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা রাজধানীর মালিকের থেকে বিভিন্ন আকারের প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। উত্তরা তৃতীয় পর্ব আবাসিক এলাকায় পাঁচ কাঠা আয়তনের ৮২টি, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় ১০ কাঠা আয়তনের ৭৪টি এবং সাড়ে সাত কাঠা আয়তনের ৪২টি প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে। ভাগ্যবান মাননীয়দের নামের তালিকা কাগজে বেরিয়েছে।

১৯৩৭-এ যাঁরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন, কলকাতায় এক বিঘা করে জমি বরাদ্দ নেওয়ার কথা তাঁদের মাথায় আসেনি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচিতদেরও নয়। ১৯৫৪, ১৯৬৪, ১৯৭০ এমনকি ১৯৭৩ বা ১৯৭৯-এর সাংসদদেরও এজাতীয় প্রাপ্তিযোগ ছিল না। তাঁরা কেউ কেউ অবশ্য অন্য কায়দায় সুবিধা নিয়েছেন। বেকুবের মতো ব্যাটা-বেটিরা যখন ভোট দিয়ে বানিয়েছে, সুতরাং কিছু সুবিধা নিতে রাষ্ট্র ও বিধাতার দিক থেকে বাধা নেই।

এর মধ্যে আশির দশকের শাসনকর্তা দেখলেন, সব দলের সাংসদদের পোষ মানাতে রাজধানীতে জমি বরাদ্দের একটা কোটা থাকা প্রয়োজন। রাজউক বরাদ্দ বিধির ১৩/এ ধারায় কোটা প্রথা যোগ করেন জেনারেল এরশাদ। ‘জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন, কিন্তু রাজধানীতে থাকার মতো বাড়ি বা জমি নেই—এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্লট দিতে এই ধারা সংযোজন করা হয়েছিল। ’ সেই যে প্লট দেওয়া শুরু হলো, তা কে রুধিবে দিয়ে বালির বাঁধ। বালির বাঁধ হলো কাগজে লেখালেখি।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, প্লট পেতে হলে আবেদনের সঙ্গে ঢাকায় নিজের অথবা পরিবারের অন্য কারও নামে জমি বা ফ্ল্যাট নেই—এই মর্মে ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে একটি হলফনামা দিতে হয়। আমরা নিকুচি করি হলফনামার। ঢাকায় আলিশান বাড়ি থাকলেও প্লট পাওয়া যাবে না, সে কথা কোন কেতাবে লেখা আছে? বিরাট বাড়ি, জমি ও একাধিক ফ্ল্যাট থাকলেও রাজউকের প্লট পাওয়া যাবে না—আমাদের রাষ্ট্র এত নির্দয় নয়। প্রকাণ্ড প্রাসাদের মতো বাড়ি ও অঢেল ধনদৌলতের মালিক এক মন্ত্রীকে এক অবুঝ রিপোর্টার প্লটপ্রাপ্তির বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। সাফ জবাব দিয়েছেন তিনি: ‘আমি এমপি হিসেবে আবেদন করেছি এবং প্লট পেয়েছি।

এর আগে [রাজউকের] কোনো প্লট আমি পাইনি। ’ অকাট্য যুক্তি। অসত্যের লেশমাত্র এতে নেই। কার বাবার সাধ্য সম্পূরক প্রশ্ন করে। এবার যাঁদের প্রাপ্তিযোগ ঘটেছে, তাঁদের অনেকে নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় পর্যন্ত বাড়িঘর থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।

কী যায়-আসে তাতে! নির্বাচনী জনসভায় কণ্ঠে দরদ ঢেলে আন্তরিকতার সুরে বলেছেন: ভাই ও বোনেরা আমার, আপনারা আমারে নির্বাচিত করেন। ইনশাল্লাহ, ভূমিহীনদের মধ্যে আমি খাসজমি বরাদ্দ দিব। নদীভাঙনে যাঁরা সর্বস্বান্ত হইছেন, তাঁদের বাড়ি বানানোর জন্য জমি দিব। ডিসি সাবের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার আলোচনা হইছে। শুধু জমি দিয়াও তো অনেকে বাড়ি বানাইতে পারবেন না।

ত্রাণ ও পুনর্বাসন থেকে টিনেরও ব্যবস্থা কইরা দিব। নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে ভোটদাতাদের অনেকে সড়কের পাশে ঘর তুলে বাস করে। ভূমিহীনেরা ছাপরা তুলে বালবাচ্চা নিয়ে রোদবৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করে। কিন্তু যাঁরা জনসেবা করেন, তাঁদের তো বাড়িঘর ছাড়া চলে না। ঢাকা জনবহুল শহর।

অসহনীয় আবাসনসংকট। মাননীয়দের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। বড় কষ্ট তাঁদের। একটু আরামে না থাকলে দেশের জনগণের সেবা করা সম্ভব নয়। তাই ১৯৮টি নির্বাচনী এলাকার ভোটদাতাদের আনন্দের শেষ নেই।

তারা ভোটটা না দিলে মাননীয়দের মাথা গোঁজার ব্যবস্থাটা হতো না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যে জমি দেয় তা ধান, আলু বা ভুট্টা চাষ করার জন্য দেয় না। বাড়ি বানানোর জন্য দেয়। দালান ওঠানোর জন্য দেয়। তবে ওস্তাগর ডেকে এনে দড়ি ধরে দাগ দিয়ে বানানো চার-পাঁচ কামরার কোঠাবাড়ি নয়।

লুই কানের কাছাকাছি স্থপতিদের দিয়ে তৈরি হবে নকশা। উঠবে আলিশান ইমারত। সারা দিন জনসেবা করে, নিজের শিল্পকারখানার ঝামেলা মিটিয়ে, যেসব ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা ঋণখেলাপি আছে, তাদের মালিক ও পরিচালকদের ম্যানেজ করে, বেশি রাতে ডিনার সেরে বারান্দায় বসে শরীরটাকে একটু জুড়াবেন নবনির্মিত বাসভবনে। জনগণের জন্যও মনটা কাঁদবে। শুধু একটি কথা একেবারেই মনে পড়বে না, তা হলো ভূমিহীন ও নদীভাঙনে গৃহহারাদের খাসজমি বরাদ্দ দিতে চেয়েছিলেন।

সুখী মানুষ হিসেবে পুরোনো দিনের কোনো গানের কলিই লতিয়ে উঠবে মনে: নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে—। ‘জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদান’ যাঁরা রেখেছেন, অথচ রাজধানীতে থাকার মতো বাড়ি বা জমি নেই—এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও দক্ষিণা পেতেই পারেন। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করায় ব্রজেন দাশকে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান এক টাকায় মতিঝিলে বিঘা খানেক জমি দিয়েছিলেন, এখন মধুমিতা সিনেমা হল। তা কোনো দোষের ছিল না। তা ছাড়া যাঁরা নিজের জন্য কিছুই না করে আজীবন শুধু দেশের জন্যই কাজ করেন, এমন মানুষের কেউ যদি রাষ্ট্রীয় দক্ষিণা পান, তাতে কারও আপত্তি থাকে না।

কিন্তু মাননীয় জনপ্রতিনিধিরা কেন? যাঁরা মোটা বেতন-ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি, লাল পাসপোর্ট, ন্যাম ফ্ল্যাট, বিনা পয়সায় রাষ্ট্রীয় পরিবহনে যাতায়াত, টেলিফোন ভাতা প্রভৃতি সুবিধা ভোগ করেন, তাঁদের জন্য দাতা হাতেম তায়ীর ভূমিকা নেবে কেন রাষ্ট্র? রাষ্ট্রের মালিকানা তো জনগণের, সাংসদদের নয়। তা ছাড়া তাঁদের নিজেদের বাড়ি ও ঢাকায় জায়গাজমি আছে, তাঁদের এই সুবিধা নেওয়া চরম অনৈতিকতা। স্রেফ দুর্নীতি। যাঁরা দেন এবং যাঁরা নেন—দুপক্ষেরই দুর্নীতি। সারাটা জীবন যাঁরা নজরুলের মতো ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সাধনা করেছেন, এমন কীর্তিমান এবং খুব বড় কবি লেখক শিল্পী যদি বিশেষ অবদানের কারণে এজাতীয় সুবিধা পান, তাতে মানুষই খুশিই হয়।

কিন্তু আজকাল বিশেষ অবদানওয়ালাদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। দুই হাতে বিলি করছে রাজউক প্লট। রাজউক বিক্রি করছে প্লট, ওদিকে বিক্রি হচ্ছে বিবেক। ফলে জাতির ঘনঘোর দুর্দিনেও কথা বলার একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জনগণকে আর কিছু দিক বা না দিক, সাংসদীয় সুখ নিশ্চিত করেছে।

সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। প্রথম আলো থেকে কপি পেষ্ট। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।