আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনন্য উত্তম কুমার

তিনি জানতেন, তিনি উত্তম হবেন। তাই নামটা অরুণ কুমার থেকে নিজেই বদলে উত্তম কুমার রেখেছিলেন।
১৯৪৭ সালে দুটো ঘটনা ঘটল-- ভারত স্বাধীন হল, আর উত্তম কুমার ‘মায়াডোর’ ছবিতে অভিনয় করলেন। কিন্তু সেই ছবিতে তিনি স্রেফ এক্সট্রা।
৪৮ সালে করলেন দৃষ্টিদান, এখানে তিনি নায়ক অসিত বরণের কিশোরকালের অভিনয় করলেন।

৪৯ সালে কামনা ছবিতে তিনি নায়ক হলেন, নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। এরপর আট বছরে আটটি ছবি করলেন। সবগুলোই সুপার ফ্লপ। তার নাম হয়ে গেল ফ্লপ মাস্টার।
অরুণ কুমার, অরূপ কুমারের যুগ পেরিয়ে ১৯৫৪ সালে শুরু হল উত্তমযুগ।

তাকে বলা হয় বাংলার রবার্ট ব্রুস। ২৪ জুলাই ১৯৮০ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি অভিনেতা।
এখানে মহানায়ক উত্তম কুমারের মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করছি তার সম্পর্কে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কিছু উক্তি দিয়ে।
মিঠুন চক্রবর্তী, বাংলা ছবির উত্তমপরবর্তী নামকরা নায়ক, মৃণাল সেনের মৃগয়া ছবির মাধ্যমে অভিষেক, প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার। পরবর্তীকালে মুম্বাইয়ের হিন্দি ছবিতে ডিস্কো ডান্সার, রকি, অগ্নিপথের মতো অসংখ্য হিট ছবিতে অভিনয় করেছেন।

তিনি বলেন-- ‘‘এ রকম খাঁটি বাঙালি আমি কম দেখেছি। আমি নিজে ধুতি পাঞ্জাবি, কালোজিরে দিয়ে পারশে মাছের ঝোল, ঘরে পাতা দই, এ সবই পছন্দ করি। তবু বলব উত্তমদার মতো এমন ভাবনাচিন্তায়, হাঁটাচলায়, কথাবার্তায়, খাওয়াপরায় বাঙালি আমি বোধহয় কোনো দিন হয়ে উঠতে পারব না। ’’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার, অপরাজিত, গণশত্রু ইত্যাদি বিখ্যাত ছবির নায়ক। তাকে কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি চর্চা করা যুবকরা উত্তমের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে পছন্দ করত।

তাঁর মতে-- “অনেকেই ভাবেন, আমি উত্তম কুমারের অভিনয়ের তীক্ষ্ন সমালোচক। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। ওঁর মতো বড় মাপের অভিনেতা আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। আমি ওঁর অভিনয়ের ভক্ত, গুণমুগ্ধ। আসলে কিছু ছবিতে ইমেজ সর্বস্ব অভিনয় দেখে এই ভেবে ব্যথা পেয়েছি, এই হ্যাংওভারটা কাটিয়ে উঠতে পারলে ওঁর অভিনয়ের মাত্রা কোন্ জায়গায় গিয়ে পৌঁছাত।

দুঃখটা পেয়েছি একজন গুণমুগ্ধ হিসেবেই। সমালোচনা করেছি উত্তম কুমারের অভিনয়ের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা আছে বলেই। ”
রাজেশ খান্না, হিন্দি ছবির কিংবদন্তি অভিনেতা। এখানে উল্লেখ্য, উত্তমকুমারের ‘নিশিপদ্ম’ ছবির রিমেক ‘অমর প্রেম’। রাজেশ খান্নার ভাষায়-- “আমার তো মনে হয় যেভাবে গোটা বাঙালি জাতির মুখ দেখা যেত উত্তম কুমারের মধ্যে সেভাবে আর কেউ পারবে না নিজের জাতকে তুলে ধরতে।

ওভাবে ধুতির কোঁচাই ধরতে পারবে না কেউ।
‘‘যদিও আমার সঙ্গে উত্তমদাদার কোনো তুলনা হওয়া উচিত নয়, কারণ দুজনে দুই ঘরানার, দুই ভাষার, দুই মেজাজের নায়ক, তবু একই ছবির রিমেক হলে স্বাভাবিকভাবেই তুলনা এসে যায়। অন্তত দর্শক তো করেই। এখানে অবশ্য দায়িত্বটা আমার উপর পড়ায় একটু বেশি কঠিন হয়ে গেল কাজটা। তা কী আর করা যাবে।

‘অমর প্রেম’ সুপারহিট হয়েছিল সবাইজানে, অনেকেই হয়তো বলবে আমি দুর্দান্ত অভিনয় করেছি, কিন্তু আমি নিজে জানি উত্তম কুমার আমার থেকে একশো মাইল এগিয়ে ছিলেন। ’’
গৌতম ঘোষ, পদ্মা নদীর মাঝি, পার, অন্তর্জলী যাত্রা ইত্যাদি ছবির পরিচালক। তিনি বলেন-- “গৌরীশঙ্কর ও শঙ্কর সিং এই দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার। উত্তম যে কতটা শক্তিমান অভিনেতা ‘ঝিন্দের বন্দী’ দেখেই আমি উপলব্ধি করতে পারি। ”
মাধবী চক্রবর্তী, সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরেবাইরে’ ছবিতে অভিনয় করে বিখ্যাত নায়িকা হয়েছিলেন।

তাঁর ভাষ্যমতে-- “গঙ্গার বুকে আমি ও উত্তম এই রোমান্টিক দৃশ্যটা তখন দর্শকদের মুখে মুখে ফিরত। ‘শঙ্খবেলা’ ছবিটি আমি পরে আর দেখিনি। তবে সম্প্রতি টিভিতে ওই দৃশ্যটা আমি আবার দেখলাম। সেখানে একটা কথা বুঝলাম, উত্তম মারাত্মক অভিনয় করেছিলেন। এটা খুবই ঠিক ‘শঙ্খবেলা’ পুরোপুরি রোমান্টিক ছবি।

আর রোমান্টিক ছবির ক্ষেত্রে নায়ক হিসেবে উত্তমকুমারের কোনো বিকল্প নেই। ”
তনুজা, হিন্দি ও বাংলা ছবি নায়িকা। তার কন্যা কাজলও হিন্দী ছবির নায়িকা। তাঁর মতে-- “শিল্পীদের মধ্যেই এমন কেউ কেউ থাকেন যাঁরা অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রেরণা হয়ে থাকেন। যাদের মধ্যে কাউকে দেখে সাহস পাওয়া যায়।

এক কথায় শিল্পীদের শিল্পী। উত্তম কুমার ছিলেন তাঁদের একজন। ”
শত্রুঘ্ন সিনহা, হিন্দি ছবির বিখ্যাত অভিনেতা, অন্তর্জলি যাত্রার মতো বাংলা ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তিনি বলেন-- “সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় তুলনাহীন। আর ওকে ছাড়া যেন কাউকে মানাতও না ওই ভূমিকায়।

‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটা আমি বারতিনেক দেখেছি। ভালো অভিনয়ের ওই আরেক নমুনা। প্রায় প্রত্যেকটা চরিত্রই বেশ জটিল মানসিকতার। ‘গোলাপ কলোনি’ নামের আশ্চর্য বাগান-ডেয়ারিতে রহস্যের জট খুলতে ডাক পড়ে গোয়েন্দার। সেই গোয়েন্দার ভূমিকায় দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার।


“ডিটেকটিভ বলতেই আমাদের চোখে ভাসে ছিপছিপে, ধারালো, শক্তপোক্ত চেহারা। কিন্তু উত্তম কুমার তো ছিলেন এর ঠিক উলটো। নরম-সরম, প্রেমিক-প্রেমিক, আদুরে চেহারা। তাহলে কীভাবে ‘চিড়িয়াখানা’য় সফল হলেন উত্তম? তার থেকেও বড় প্রশ্ন অবশ্য, কেন সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক উত্তমকে বাছলেন। এ দুটো প্রশ্নের উত্তর আমার মনে হয়একই।

উত্তম ভালো অভিনেতা ছিলেন বলে।
“এ দেশের সিনেমা বিশেষ করে বাণিজ্যিক সিনেমা, অনেক ক্ষেত্রেই সংলাপনির্ভর। সংলাপ বলার কায়দাটা উত্তকুমারের স্টাইলের অন্যতম। আর সেই ঘাড় দোলানো, মন-জয়-করা হাসি। উত্তমকুমারের গোড়ার দিকের অভিনয়ে হলিউডি ছাপ পাওয়া যায়।

পরে একান্ত নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করে নেন। হাঁটাচলা কথা বলা সবটার মধ্যেই একটি আভিজাত্য ছিল যে কিছুতেই এড়ানো যেত না। একটু মোটার ধাঁচ থাকলেও এক্সপ্রেশন ফোটাতে পারতেন নিখুঁতভাবে। ’’
বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, বাংলা ছবির অভিনেতা, মূল অ্যান্টি হিরো বা খল নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি বলেন-- “যদিও উত্তমদার আদি ও অকৃত্রিম পরিচয় রোমান্টিক নায়ক হিসেবে, তবুও আমার মনে হয় ‘অবাক পৃথিবী’ ছবিতে উত্তমদা যে চরিত্রটি চিত্রায়িত করেছিলেন, তারই প্রকাশ আমরা দেখেছি, পরবর্তীকালের বিভিন্ন অ্যান্টি হিরোর মধ্যে।

উত্তমদার অভিনয় মেপে দেখার যন্ত্র আমাদের কেন, বিদেশেও আবিষ্কৃত হয়নি। ”
শশী কাপুর, হিন্দি ছবির অভিনেতা এবং রাজকাপুরের ছোট ভাই। তিনি বলেন-- “লালপাথর-এর সেই চিৎকার করে বলা ‘আমাকে মুক্তি দাও’; সংলাপ বলার অনবদ্য সেই কায়দাটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। সেই যে উন্মাদ প্রেমিক, যে প্রেমিকার খুন-রাঙাবেদি মুছত আর হাহাকার করত দিনরাত, উত্তমকুমার কী অপূর্ব ফুটয়েছিলেন! ফতেপুর সিক্রির দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেরা, তার আর্তনাদ আজও কানে বাজে। বাংলা আর হিন্দি দুভাষাতেই ছবিটা হয়েছিল।

দুটোই দেখেছি আমি। তবে ‘লালপাথর’-এর উত্তম কুমার আর ‘লালপাথর’-এর রাজ কুমারের কোনো তুলনাই চলে না। রাজ কুমারের অভিনয় প্রতিভা সম্পর্কে পুরোপুরি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে পারি, উত্তম কুমার অতুলনীয়। ”
শক্তি সামন্ত, হিন্দি ও বাংলা ছবির চলচ্চিত্র পরিচালক। উত্তমকুমারের জন্যেই তিনি ‘অমানুষ’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন বাংলায়।

তাঁর ভাষ্যমতে-- “সংলাপ বলার নিজস্ব কায়দা ছিল উত্তমবাবুর। শঙ্কর সিং আর গৌরীশঙ্কর ডাবল রোলে, বিশেষ করে গৌরীশঙ্করের ভূমিকায় যেখানে এক শহুরে যুবাকে সাজতে হচ্ছে রাজ কুমার, উত্তম এককথায় অতুলনীয়। একজন মদ্যপ, নারীবিলাসী অথচ সাদাসিধে, আরেকজন বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত। এ কিন্তু মোটেই সহজ কাজ নয়। উত্তম কতটা বড় অভিনেতা ছিলেন প্রতিভার বিচারে, তা মাপার চেয়ে আমার মনে হয় আজকের দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই যে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান অভিনেতা।

অ্যাক্টিং ছিল তাঁর কাছে ইষ্টদেবতার মতো, ফুল-বেল-পাতা-চন্দন ঠিকঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে মন এক জায়গায় স্থির রেখে অভিনয় করতেন তিনি। যখন উত্তম দাঁড়াতেন ক্যামেরার সামনে, বাইরের পৃথিবীর সুখ-দুঃখ যেন স্পর্শ করত না তাঁকে। ”
সুচিত্রা সেন, উত্তমের অসংখ্য হিট ছবির জুটি।   প্রায় হাহাকার করে তিনি বলেন-- “উত্তম আমার বন্ধু। এক কথায় গ্রেট, গ্রেট আর্টিস্ট।

তবু যেন মনে হয় ওকে ঠিকমতো এক্সপ্লয়েট করা হয়নি। ”

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।