আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার হুজুর-নামা

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া... তখন আমি বছর সাত/আট হবো। সিলেটের মৌলভীবাজারে সবে মাত্র এসেছি। সিলেটে ভাষা অল্প দিনেই আয়ত্বে চলে এসেছে। বাচ্চাদের যেমন হয় আর কি!!! আমাদের আরবী পড়ানোর জন্য একজন হুজুর রাখা হলো। সিলেটে হুজুরদের ডাকা হতো "মেছাব" পরে আব্বার কাছে জেনেছি মিয়া সাহেব শব্দটি আঞ্চলিকতায় বিকৃত হয়ে মেছাবে রুপান্তরিত হয়েছে।

উনি কোথায় থাকতেন তা মনে নেই। তবে মাঝে মাঝে উনি ২/৩ দিনের জন্য গ্রামের বাড়ী যেতেন। আহ!!! তখন আমাদের আনন্দ দেখে কে!!! কি অজ্ঞাত কারনে হুজুর আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। ফজরের নামাজ পড়েই বাসার সামনে এসে ভাইয়ার ভালো নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করতেন। তারপর আমাদের পাকড়াও করে বাসার সামনের পুকুর-ঘাটে নিয়ে ওজু করাতেন।

মাঘ মাসে পুকুরের পানি থেকে ধোঁয়া উঠতো। কিন্তু আমাদের নিস্তার ছিলোনা। অল্প দিনেই ভাইয়া কায়দা ছেড়ে সিফারায় প্রমোশন পেলো। কায়দা কয়েকবার শেষ করা সত্বেও আমাকে কায়দাতেই আঁটকে রাখা হলো। আমার ঠোঁট কাটা স্বভাবই এ জন্য দায়ী।

পড়া শুরু করার আধ ঘন্টা পরেই হুজুর বলতেন, “ কামরুল যাও নাস্তা লইয়াও”। ভাইয়া পরোটা, ডিম ভাজা নিয়ে আসতো। হুজুর আয়েস করে উপোষি আমাদের সামনে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সে নাস্তা গলাধ্বকরন করে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে পানের ডিব্বা বের করে পান মুখে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়তেন, “এই ফড়ছ না দু” (এই পড়ছিস না দেখি)। মাস খানেক সহ্য করার পর একদিন যখন উনি নাস্তার অর্ডার দিলেন অমনি আমি ফস করে বলে ফেললাম, “মেছাব, ওউ তো আইলা, এক গন্টাও তো অইছেনা”। আর যায় কোথায়!!! খন্নাছ, ফেরত(প্রেত) ইবলিস কুবাইকুর(কোথাকার) সিলেটি ভাষায় এরো নানান বিশেষনে ভুষিত করে বাড়ী থেকে বয়ে নিয়ে আসা বাঁশের চিকন কঞ্চির কয়েক ঘা দিলেন আমার হাতে, পিঠে।

কাঁদতে কাঁদতে আম্মাকে লাল হয়ে ফুলে উঠা কঞ্চির সে দাগ দেখালাম। মনে মনে আশা ছিলো, এইবার আম্মার নির্দেশে মেছাব বিদায় হবেন। আমার সে আশায় এক বালতী বরফ পানি ঢেলে দিয়ে আম্মা বললেন, “ ওস্তাদ যে জায়গায় মারেন, সেই জায়গা বেহেস্তে যায়”। আমি মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। হুজুর তো সাধারনত আমার হাতে আর পিঠে মারেন।

আস্ত আমাকে রেখে শুধু আমার পিঠ ও হাত কি করে বেহেস্তে যাবে? পিঠ আর হাত বাদ দিয়ে বাকি আমিটুকুর কোথায় জায়গা হবে? ভাইয়া তো একদিনও হুজুরের হাতে মার খায়নি। তাহলে ভাইয়ার এক কনাও কি বেহেস্তের হকদার হবেনা? এক নাগাড়ে ৮/১০বার কায়দা শেষ করার পরও যখন আমাকে প্রমোশন দেয়া হলোনা তখন আম্মার কাছে গিয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করলাম। “আমি আর ঐ হুজুরের কাছে পড়বোনা”। এতেই কাজ হলো। পরদিন আম্মা পর্দার আড়াল থেকে বললেন, আমাকে যেনো সিফারা দেয়া হয়।

কোন কথা না বলে আমার দিকে অগ্নি-দৃষ্টি হেনে মুখের ভিতর আরেকটি পান পুরে বিরষ কন্ঠে ভাইয়াকে বললেন, “তুমরার গরো ফান খাইন না ক্যানে”? যেন পান না খাওয়া এক বিরাট দোষের কিছু। তখনকার দিনে সিলেটের যে কোন বাড়ীতে অথিতিকে আগে পান দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। পরে চা,নাস্তা। তারও পরে অবশ্যই ভাত। বাড়ী থেকে আসার সময় হুজুর নিজের গাছের ফল-মূল নিয়ে আসতেন।

আম, কাঁঠাল, কমলা, ডেউয়া, ডেফল, লুকলুকি, ভুবি(লটকন)। একবার কমলার সাথে এক আটি বাঁশের ফুকনি এনে বললেন, “তুমার আম্মারে দিও”। এতোগুলো ফুকনি দেখে আম্মা বললেন,” এতো ফুকনি দিয়ে কি হবে? তাও কাঁচা বাঁশের। ঘরে থেকে তো ঘুনে ঝাঝরা হয়ে যাবে”। পড়ে রইলো ওগুলো রান্না ঘরের কোনে।

পরদিন হুজুর জিজ্ঞাসা করলেন, “খাইছিলাইনি চুঁঙ্গা পিঠা”? আমরা তো হা-, পিঠা? পিঠা কোথায়? ভাইয়া বল্লো, “মেছাব, ফিঠা তো দিছইন না, আফনে তো কমলা আর ফুকনি আনছইন”। চক্ষু চড়ক-গাছ করে হুজুর বললেন, “ ফুকনি? ফুকনি কিতা বা”?আমি বললাম, ক্যানে, ওউ যে উন্দালো চুলাত ফুঁ দেইন”। হুজুর হাঁসতে হাঁসতে গড়াগড়ি। আমরা দু’ভাই-বোন অপ্রস্তুত। কোন মতে হাঁসি থামিয়ে হুজুর যা বললেন তা হলো, “ওগুলো হলো চুঙ্গা পিঠা।

বিশেষ ধরনের লম্বা গাঁযুক্ত বাঁশের ভিতর ভিজানো বিরন চাল ঢুকিয়ে মুখটা কলাপাতা ও খড় দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এখন ওগুলো চুলার আগুনে পুড়ালে ভিতরে আঠালো বিরন ভাত তৈরী হয়ে যাবে। তখন বাঁশগুলোকে আঁখের মতো ছিলে ভিতর থেকে বিরন ভাত বের করে দুধ, নারিকেলের মিঠাই, বা ক্ষির দিয়ে খেতে হবে। হুজুরের অবজ্ঞা, অবহেলা সত্বেও আমি সিফারা শেষ করে ফেললাম। তখন সিলেটের নিয়ম ছিলো বাচ্চারা কায়দা, সিফারা, কোরআন শরীফ যেটাতেই সবক নিক না কেনো সিন্নি করতে হতো।

সে সিন্নি মসজিদ আর পাড়ায় বিলানো হতো। যার যার সাধ্য মত সিন্নি হতো। আখনী, তুষা, ক্ষীর, সাধারনত এগুলিই হতো সিন্নি। তুষা হলো ময়দার হালুয়া। এটা আসলেঈ দারুন মজাদার।

আম্মা তুষার সিন্নিই করতেন। কোরআন শরীফে সবক নেয়ার কিছুদিন পরই আমরা মৌ্লভীবাজার ছেড়ে সিলেটে চলে আসি। সিলেটে যে হুজুরের কাছে আমি কোরআন খতম করি, উনি ছিলেন খুবই নিরিহ, শান্ত এক বৃদ্ধ হুজুর। অনেক বছর পর আমার বিয়ের পরে একদিন আমি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় আমার ঐ হুজুর হঠাৎ আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি অমুক না”? খুব ভালো লেগেছিলো তখন উনাকে দেখে।

...............................................। .................................... এর পরে আমার বাচ্চাদের হুজুর-নামা পেশ করবো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।