আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইলেকশন ডিউটি

বৃথা হয়রানি ৭ জুন বিকাল। ভোটের বাক্স-পেটরা নিয়ে গাড়িটা যখন উপজেলা কম্পাউন্ড ছাড়ছিল মনের ভেতরে তখন বিষাদের সুর। আহা, এখানেই যদি ইলেকশনের ডিউটিটা হত। অথচ বছর দেড়েক আগে চাকরিসূত্রে যখন এখানে আসি, চারদিকের এমন হতদশা দেখে বুক ফেটে কান্না এসেছিল। তখন কে জানত এর চেয়েও খারাপ কোথাও ডিউটি পড়ত পারে।

পোলিং সেন্টারে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আগের দিন উপজেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কেন্দ্র দেখতে এসেছিলাম। নইলে এটা খুঁজে পেতে পুরো রাত লেগে যেত। কেন্দ্র বলতে জনবিরল একটা জায়গায় দু'কোঠার একটা মক্তব। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সারি নদী।

এক সময় পুরো জায়গাটা হাওড় ছিল। আশপাশের লোকজনও এখানে আসত না। নদীতে বাঁধ দিয়ে জায়গাটা চাষাবাদের উপযোগী করা হয়েছে। স্থানীয় লোক নাই বললেই চলে। কুমিল্লা-নোয়াখালী থেকে আসা সেটেলাররাই এখন নিজেদের স্থানীয় বলে পরিচয় দেয়।

কিন্তু কথার টানে ধরার পড়ে যায়। তামাবিলের রাস্তা ছেড়ে ছ' কিলোমিটার বন্ধুর মেঠো পথ। পাঁচ-ছ'বার গাড্ডায় পড়ে গাড়ি আটকে গেল। শেষ এক কিলোমিটার সবাই মিলে ধাক্কিয়ে কোন প্রকারে গাড়িটাকে কেন্দ্রের কাছে এনে রাখলাম। গাড়ি ঝাঁকুনি আর ঠেলাঠেলির পরিশ্রমে সবাই একেবারে ক্লান্ত।

কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ নেই। সূর্য ডুবে গেলে আর কোন কাজ করা যাবে না। কারণ বিদ্যুৎ নেই। সবাই মিলে হৈচৈ করে পাশের বাঁশ ঝাড় থেকে ক'টা বাঁশ কেটে এনে পুঁতে দেয়া হলো বুথগুলোর সামনে। ততক্ষণে ছুঁচোর ডন নাড়িভুড়ি চিবিয়ে খাবার অবস্থায় চলে গেছে।

দূরে দুটো দোকান পাওয়া গেলো। খাবার বলতে `শায়েস্তা খাঁর ফেলে যাওয়া ক'টা বনরুটি'। সেটা টিউবলের জলে ডুবিয়ে পরম তৃপ্তিতে খেয়ে নিলাম। আহা কী শান্তি! সেন্টারে ফিরে দেখি আমাদের অনুপস্থিতিতে মশারা পুরো দখল নিয়ে নিয়েছে। লোক পাঠানো হলো মশার কয়েলের খোঁজে।

আশেপাশের তিন গাঁয়ে কোন দোকান নেই যেখানে কয়েল মিলবে। অবশেষে আমাদের সাথে আসা পল্লী বিদ্যুতের এক কর্মকর্তা মোটর সাইকেল নিয়ে বড়ো রাস্তা থেকে কয়েল আনলেন দু'ঘন্টা লাগিয়ে। ততক্ষণে কয়েক পাউন্ড রক্ত চলে গেছে আমাদের। শুরু হলো পরের দিনের কাজ এগিয়ে রাখবার পর্ব। মোমের এক টুকরো আলোয় সবাই যেন আশ্রয় নিল।

জানলা দিয়ে যত দূর চোখ যায় শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। হঠাৎ করে মনে হয় নিজে যেন অন্ধ হয়ে গেছি। এর মধ্যে শুরু হলো ঝড়। অদূরেই মেঘালয়। তাই এখানকার ঝড়ের মেজাজ মর্জিই আলাদা।

চিটচিটে গরমে বেশ আরাম লাগছিল। কিন্তু পরক্ষণেই একটা উদ্বেগ ঘিরে ধরল আমাদের। এই বৃষ্টি যদি কাল শেষ না হয় কোনভাবেই আমরা ফলাফল নিয়ে উপজেলায় যেতে পারব না। আমরা প্রাকৃতিকভাবেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ব এখানে। কোন গ্যাঞ্জাম লেগে গেলে কেউ আমাদের উদ্ধারও করতে আসতে পারবে না।

আমাদের লাশ হয়ত কয়েকদিন হাওড়ের জলে ভেসে ঢোল হওয়ার পর উদ্ধার হবে। রাত এগারটা নাগাদ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অনুগ্রহে রাতের খাবার এলো। অনেক কষ্টে দু গ্রাস খেলাম। খাবারের মেন্যু ও মান দুটো নিয়ে আলোচনা অবান্তর। শুধু বলে রাখি সে রাতে এই `দরিদ্র' মানুষগুলোর ঔদার্য্য আমাদের লজ্জ্বিত করে ফেলেছিল।

আমরা এতো থাকার পরও কী পারি এভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ঈশ্বরকে ডেকে ডেকে বিনিদ্র রাতটা পার করলাম। ভোর হতেই পোলিং এজেন্ট আর প্রার্থীদের ভিড় লেগে গেল। জীবনে প্রথম গাছের আড়ালে গিয়ে প্রাত:কীর্তি সারলাম। ৮ টা থেকে ভোট শুরু হলো।

একটা চাপা আতঙ্ক আমাদের ভেতরে। এই বৃষ্টিতে কিছু একটা হলে সামাল দেয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের। আমরা সবাই মিলে তাই চেষ্টা করলাম একটা স্বচ্ছ্ব ভাবমূর্তি তৈরি করতে । ফলাফল যাই হোক না সবাই যেন মেনে নেয়। দুপুর হতে বৃষ্টিটা ধরল।

সাড়ে ৫ টার মধ্যে ভোট গণনা শেষ হলো। জয়ী পরাজয়ী দু দলই আমাদের নিরপেক্ষতা স্বীকার করল। কোন ঝামেলা ছাড়াই রওনা দিল আমাদের গাড়ি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।