আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিটোলের জন্য ভালোবাসা আর আমার আকাশে হাঁটার গল্প

নিটোলের সাথে আমার প্রথম দেখা সিদ্ধেশ্বরীতে মনোয়ারা হসপিটালের সামনে। পাশেই আমিনাবাদ হাউজিং-এ ছিল ওদের বাসা। আমি চিনতে পারছিলাম না। তাই আমাকে নিতে আসছে। সন্ধ্যার সেই আবছা অন্ধকারেও নিটোলের কিশোরমুখ দেখে আমার মধ্যে একটা আনন্দের অনুভূতি হয়েছিল- অনেক সুন্দর কিছু দেখার পর যেমন হয়।

আগে আর পরে কখনো আমি ওর চেয়ে সুন্দর, নিষ্পাপ মুখের কাউকে দেখিনি নিটোল আমার ছাত্র, খুব প্রিয় ছাত্রদের একজন। ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো ছিল। প্রথমদিন ও আমাকে বলে- "ভাইয়া, আমি কিন্তু খুব গাধা-গরু টাইপ স্টুডেন্ট! শুধু বয়সের দোষে নটরডেমে পড়তেছি। সার্টিফিকেটে আসল বয়স দিয়ে ফেলছি তো! বকা-ঝকা না দিলে আমার থেকে কখনো পড়া আদায় করতে পারবেন না। " আমার মাথা খারাপ আর কী! এত সুন্দর, এত ভাল ছেলেকে বকা-ঝকা করা যায়? নিটোলকে পড়ানো আমার জীবনের অন্যতম আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা।

পড়ার বাইরে, সিলেবাসের বাইরে চলে যেতাম সবসময়। বিশেষ করে, বিন্যাস-সমাবেশ পড়ানোর সময়। বইয়ের বাইরে কত কী! ওর সাথে আমি আইনস্টাইনের জেব্রা পাজল সলভ করতাম, কিংবা অয়লারের সেভেন ব্রীজ প্রোবলেম। ফার্মার লাস্ট থিওরেমের কথা বললে ও চোখ বড় করে ফেলতো। আমি চেষ্টা করতাম আমার সব স্বপ্ন ওর মধ্যে বুনে দিতে।

নিটোলের অনেক অদ্ভুত আবদার আমাকে মেটাতে হত। ওর জন্য আইপড ভর্তি করে গান নিয়ে যেতে হত। আর অনেক অনেক বই। তবে আমাকেও যে কম দিয়েছে তা না। আমি খুব একটা মুভি দেখতাম না।

ও আমাকে জোর করে অনেক মুভির ডিভিডি দিত। আমার প্রতি ওর ভালোবাসা, শ্রদ্ধাটা আমি বেশ উপভোগ করতাম। সে সময় নিটোল ভাল বেস গিটার বাজাত। নতুন কোন গান তুললে আমাকে বেশ আগ্রহ নিয়ে শোনাত। আমি বুঝতাম না- তাও সে আমাকে গিটারের কর্ড বোঝাত।

নিটোলের বুয়েট এডমিশান টেস্টের দু'মাস আগে আমি চিটাগাং চলে আসি। ও আমাকে অনেক অনুরোধ করছিল অন্তত এডমিশন টেস্ট পর্যন্ত থেকে যেতে। কিন্তু থাকিনি। আসলে তখন ঢাকা থেকে অনেক কারণে আমার মন উঠে গিয়েছিল। চিটাগাং-এ যাওয়ার পরও বেশ ভালোই যোগাযোগ ছিল।

প্রায় প্রতিদিনই ফোনে কথা হত। ভাইয়া, এই ম্যাথটা বুঝতেছিনা- এই ফর্মূলা তো আগে দেখিনি-ইন্টিগ্রেশন কিছুই পারতেছিনা- ভাইয়া, ঢাকা চলে আসেন-হায় হায়, এটা এভাবে করতে হবে! দেখছেন,আপনি চলে যাওয়ার পর আমি কী গাধা হয়ে গেছি! আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল নিটোল বুয়েটেই পড়বে। সম্ভবত বুয়েট এডমিশান টেস্টের সপ্তাহখানিক আগে টেক্সটাইলের পরীক্ষা হয়েছিল। ঐ পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েই নিটোল আমাকে ফোন করে সে কী কান্না! আমার ভীষণ মায়া হয়। নিটোল, আমি তো জানি তোমাকে দিয়ে কি হবে।

নেক্সট উইকের জন্য প্রেপারেশন নাও। নিটোলে যে বুয়েটে টিকলোনা আমার কাছে তা ছিল খুব আশ্চর্যের আর হতাশার ঘটনা। পরে নিটোল খুলনার কুয়েটে মেকানিক্যাল এ ভর্তি হয়। ওর মা চাচ্ছিল না ওকে ঢাকার বাইরে পাঠাতে। নি্টোলের বাবা ব্যাংকার।

ওকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারতেন। নিটোল রাজি ছিল না। এরপর যেমন হয়-ধীরে ধীরে যার যার ব্যস্ততায় যোগাযোগটা একটু কমে আসে। ফেইসবুকে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হত। তখনই জানতে পারলাম ওর ছবি তোলার শখ।

আমি খুব উৎসাহ দিতাম। মাঝে মধ্যে ফেইসবুকে কিছু ছবি শেয়ার করত। দেখতাম, ভাবতাম- ভালই তো ছবি তুলছে ছেলেটা। কিন্তু কখনো প্রশংসা করা হত না। গতকাল ছিল নিটোলের জন্মদিন।

ওর ফেইসবুক ওয়ালে কিছু লিখতে গিয়ে ফ্লিকারে শেয়ার করা কিছু ছবি দেখতে গেলাম। ছবি দেখে আমি হতভম্ব, হতবাক। এত ভাল ছবি! এত সুন্দর ছবি! এত অসাধারণ! আমার ভাষার দীনতায় আমি আমার মুগ্ধতা প্রকাশ করতে পারছিনা। ছবিগুলো দেখার পর আমি বুঝতে পারি নিটোল খুব বড় মাপের ফটোগ্রাফার হবে। আমার যে কী ভালো লাগে।

ফেইসবুকে একটা মেসেজ পাঠালাম। তারপর ফোন করলাম- অনেক অনেক দিন পর। ওর আনন্দটা, ওর উচ্চ্বাস আমি টের পাই। শুনলাম কিছুদিন পর লন্ডনে একটা এক্সিবিশানে ওর সতেরোটা ছবি যাবে। সেই ছবি তুলতে ও কুমিল্লায় গিয়েছিল।

সেখান থেকে মাত্রই ঢাকায় ফিরল। গেল মাসে ঢাকাতেও একটা এক্সিবিশন হল। ওর সাথে ফোনে কথা হওয়ার পর আমার কি যে ভাল লাগল। এক সময় এই ছেলেটা আমার ছাত্র ছিল- এইটা ভেবে নিজের মধ্যে একটা অহংকার অনুভব করি। নিজেকে আমার মনে হয় দশ ফুট উচ্চতার একটা মানুষ।

আমার মনে হয় আমি যেন আকাশে হাঁটছি। আজ সকালে দেখি নিটোল ফেইসবুকে দুইটা ইউটিউব লিঙ্ক পাঠাল। ওদের দুটো গান। বিশেষ করে 'দহন' গানটার লিরিক, কম্পোজিশন, পারফরম্যান্স সবই অসাধারণ। এই গানে চশমা পড়া বাম পাশের ছেলেটা নিটোল।

আর অন্য গানটা আমাদের সবসময়ের প্রিয় জন ডেনভারের 'অ্যানিস সং' এর কাভার। দুইটা গানই খুব ভাল লেগেছে। তাই এখানে শেয়ার করলাম। দহন- অ্যানিস সং- নিটোল, তুমি আরো বড় হও। আমি আরো অনেক কাল আকাশে হাঁটতে চাই।

[ সকালে এই পোষ্ট একবার করছিলাম,। অনেক বেশি ভুল ছিল। তাই আবার নতুন করে পোষ্ট দিলাম। ] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।