আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গগণশিরীষের সিথানে : আমি ও আমাদের অসুখের ঘর

মাঘের দ্বিতীয় সকাল। সময় বিচনায় সূর্যদেবের অনেক আগেই দেখা দেবার কথা। কিন্তু তিনি কথা রাখছেন না। জিউসের রথ চালনায় ইচ্ছাকৃত এ মন্থর গতির কারণ বোঝা যায়। মাঘের গা থেকে তখনও নববধুর ঘ্রাণই যায়নি।

এমন দিনে কেউ কাউকেই অসম্মান করতে চায় না। কী চমৎকার বোঝাপড়া প্রকৃতির। বৈশাখ শুরুর শেষ বিকেলে একটু ঝড়, বর্ষার প্রথমে একটু বৃষ্টি, হবেই। কতোদিন ধরে দেখছি, এতটুকুও হেরফের নেই। কবে, কতোকাল আগে ঋতুরা ছয় বোন জোকাস্টার আঁচল ছুয়ে কিরা কেটেছিল, কেউ কারো সংসারে হানা দেবে না।

আজ এতোদিন পরও তারা তাদের কথা রাখে। কখনো সে কথার নড়চড় হয় না। কিঙ্কিন্ধার কুমারীদেরও এ খবর অজানা থাকে না, তাই তো কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে চারপাশ। আমের পাতা থেকে মুক্তোর দানার মতো ঝরে ঝরে পড়ে শিশির বিন্দু। গাছেরা অলস বালিকার মতো আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে চায়।

কিন্তু তা যেন আর সহ্য হয় না পাগল পাপিয়াটার। পাগলই তো, নয়তো আর কী? নেহায়েতই মাথা খারাপ না হলে, যেখানে দুনিয়ার আর সব পাপিয়া ডাকে বসন্তে সেখানে সে এমন অসময়ে, এই শীতে, অবোধ শিশুর মতো অবেলায়, চিল চেচিয়ে সারা হয়! যাহোক এভাবে ডেকে ডেকে পাগলিনী সে খুজে পাবে কি না সে বিচার নয়, বরং তার ডাকে একদা গাছে গাছে কবিতা ঝুলতো যে ভূমির তার প্রতিটি সত্তার শীতনিদ্রা হালকা হয়। আড়মোড়া ওঠে। দেকার্তের কাছে প্রশ্ন করা শিখে একযুগ ধরে জিজ্ঞাসার অসুখে জর্জরিত যারা, তাদের আগমনের আভাষ পাওয়া যায়। ধীরে পায়ে এগিয়ে চলে সময়।

রোদ্দুরের দেখা মেলে। শ্রান্ত শিশির, সোনামোড়া সকালের সুমিষ্ট রোদ্দুর। লাজুক হাসিতে ভুবন মাতিয়ে দেখা দেয় সব সুকন্যারা। ‘ইশান-বিশানে ওঙ্কার তুলে ছুটে আসে সব শ্রীমানকুল’। কার্ফু ভাঙার গানে মুখরিত হয় চারপাশ।

আরো সতত অসুখবিলাসী, যারা ‘রক্ত দিয়ে শব্দ লিখে একাত্ম হতে চায় ছোটকাগজের প্রতিটি ঘামের’ সঙ্গে, লেপের ওমকে বিদায় বলে বেরিয়ে আসে। বয়সে প্রবীণ যারা তারাও বাদ যান না। তারুণ্যের অরূপের উপাসনায় যোগ দিয়ে, নবীন-প্রবীণ মিলেমিশে একাকার হয়ে, শান্তির কপোত আকাশে উড়িয়ে, সবাই যেন তাদের সময়সীমার উত্তরণ ঘটিয়ে যান। শুরু হয় চিহ্নর যুগবর্ষযাপন উৎসব। আর দেখতে দেখতে শেষও হয়ে যায়।

দেখতে দেখতেই বলছি। দুটি দিন কোন্ দিক দিয়ে চলে গেল যেন টেরই পেলাম না। ভালোলাগার মুহূর্তগুলো এমনই, জাপানী অনুগল্পের চেয়েও সংক্ষিপ্ততম! আশ মিটবার আগেই ফুরিয়ে যায়। তবুও তো কিছু বিষয় থাকে, যা শেষ হবার পরও তার আবেশ লক্ষণীয়ভাবে থেকে যায় স্মরণযোগ্য। এও ঠিক তেমনি।

ছোটকাগজের মেলা শুধু নয়, যেন অন্য এক জীবনের, অন্য কোনো সম্ভাবনার পসরা সাজিয়ে বসেছিল মগজের কার্ফু ভাঙার কারিগরেরা। অন্ন-বস্ত্রের বন্দ্যোবস্তের কথা নয়, দেহজ খুন্নিবৃত্তির কোনো আয়োজন নয়, স্থুল রগরগে রুচির বিনোদন ব্যাবস্থাও সে নয়; শুধু যা না হলে মানুষের আত্মা বাঁচে না তার এবং দিনরাত, মানুষ কেন মানুষ তার সংজ্ঞা খুজে ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবশান্ত যারা, তবুও যাদের এ নিরন্তর অন্বেষণের বিরাম নেই, তাদের মিলনমেলার আয়োজন হয়েছিল এখানে। সবার চোখেমুখে সেদিন কতো আশা, কী যে প্রত্যয়! না দেখলে বিশ্বাস হবে না। স্বপ্ন আর সম্ভাবনার সারথীদের চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন আমার মনে হয়েছিল, কোনো কিছুই যেন অসম্ভব নয়। ইস্! সেই মুহূর্তটা যদি কখনো শেষ না হতো! নীরবেই ঘটছিল সবকিছু, এতো মৌন, চুপচাপ, যেন সূর্য এসে পড়ার আগেই লাজুক রাত্রি লুকিয়ে পড়ছে পাহাড়ের ওপাশে।

তবুও আমরা সরব ও রঙিন করে তুলতে চেয়েছি আমাদের এতোদিনের নিভৃতে লালিত স্বপ্নগুলোকে। আমরা জানি, মিথ্যার রাংতা, এতোই ঝকমকি ও অপ্রতিরোধ্য যে, ন্যুনতম তোয়াক্কাও করে না কোনও নৈতিকতার। তাই তো সত্যকে বুকে ধারণ করার অপবাদ, চিরসুন্দর, কল্যাণ, মঙ্গল, মানবতাকে বুকের বামপাশে হৃদপিণ্ডের মতো সযতনে লালন করার অসুখ আমরা ভাগাভাগি করতে চেয়েছি, সবার সাথে। কিন্তু এইটুকুমাত্র বললেই সবটুকু বলা হয়ে যায় না। নেপথ্যে আরও কথা থাকে, তোগালিত্তির কর্মলিপ্সার বাইরে অদ্ভুত এক জীবনচর্চার সংবাদ থাকে, মধুগড়ের খাড়ারে শতবর্ষ ধরে জমাকৃত পচা হাড়েরে ইতিহাস থাকে, আর থাকে 47, 52, 71-এর স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের অপরিমেয় অতৃপ্তির সাথে যাপিত জীবনের যন্ত্রনা, আত্মসমালোচনা কিংবা ব্যক্তির বিচ্ছুরিত দাহ ও দ্রোহের তীক্ষ্ণ অভিঘাত।

আবার এগুলো তো প্রায় বাইরের ব্যপার, আমাদের আন্তরিক অনুভুতি ও ‍অন্তর্গত ক্ষরণের ইতিহাসটাও এক্ষেত্রে কোনোভাবেই গৌণ নয়। হ্যাঁ, ঠিক তাই। বলতে দ্বিধা নেই, আমার একটি অসুখ আছে, সারা রাত ঘুমাতে পারি না। সারা রাত দুচোখে ঘুম আসে না। যে রাতে চাঁদ থাকে, আকাশ ভাসিয়ে জোছনা নামে, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।

কী তার রূপ আর কী তার শোভা! চান্নি পসর বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে ভর করে ছুটে যায়, মেঘ আর তারাদের বিয়ে হয়, সে রাতের হাহাকার আমাকে টেনে নিয়ে বেড়ায় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। যে রাতে পূর্ণিমা থাকে, ঘর ছাড়ার ডাক আসে; জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে কে যেন হাতছানি দেয়। দিকদিগন্ত চষে বেড়াই নিশায় পওয়া মানুষের মতো। একসময় সে রাতও চলে যায়। আবারো সিদ্ধার্থের মতো গৃহত্যাগি জোছনার লাগি পথ চেয়ে থাকি।

আজ বুঝি, সিদ্ধার্থ, কেন তুমি গৃহত্যাগি হয়েছিলে; কে সে, গৃহী তোমাকে গৃহত্যাগি হতে বাধ্য করেছিল। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, ...মাঝে সুন্দর ফুটফুটে, সাদা ধবধবে শিশু পুত্র শুয়ে আছে, ওপাশে মা। জোছনা রাতের ডাক আসে, মাথাচাড়া দেয় আদিগন্ত বিস্তৃত হৃদয়ের হাহাকার, সন্তানের প্রিয় পিতা, অর্ধাঙ্গীর একমাত্র অবলম্বন তুমি পা বাড়ালে দোরের দিকে। আবার কেন জানি চমকে পেছনে তাকালে, অবোধ শিশু টলমলে চোখে চেয়ে আছে। জানালার শিক গলে এক ফালি চাঁদ এসে পড়েছে শিশুটির চোখে।

সে চোখে ঝিলমিল করছে অবিশ্বাসের অনন্ত বিস্ময়ের হাসি। পিতৃত্বের সুতোয় টান পড়ে। গুণের রশির মতো পাকানো সে চাঁদের সূত্র ধরে জানালার ওপাশে চোখ যায়, যেখানে হিজল আর তমালের ছায়া জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরের কোন বন থেকে চাপার তীব্র অথচ কোমল ঘ্রান ভেসে আসে আদিগন্ত বিস্তৃত কতো নদী-মাঠ-ঘাট পেরিয়ে। হঠাৎই যেই এক অজানা পাখি তার সুরে ডেকে ওঠে আর সবকিছু মিথ্যে হয়ে যায়।

মানবেতিহাসের যেখানে ব্যথার উৎস তারই সন্ধানে, স্ত্রীর প্রেমস্পদ ছোঁয়া, উত্তর প্রজন্মের প্রতিশ্রুতির আহ্বানকে উপেক্ষা করে, এক নিশা পাওয়া যুবক তুমি পা বাড়ালে অজানার দিকে। অনিশ্চয়তাকে আলিঙ্গন না করা পর্যন্ত যেন তোমার শান্তি নেই। সেদিন ছিল আষাড়ি পূর্ণিমা। তাঁরপর থেকে পূর্ণিমা নামক শব্দটি গেঁথে যায় অলিন্দ-নিলয়ের বাঁধনে। বৈশাখি পূর্ণিমায় মহাজ্ঞান লাভ আর শারদীয় পূর্ণিমায় হয় চির বরদান।

ভাদ্র পূর্ণিমায়, (যাকে আমরা মধুপূর্ণিমা বলি) ভুখা তোমাকে বানরেরা দুধ পান করায়। মাঘি পূর্ণিমায় ঘোষণা করলে মহাপ্রয়াণে যাবে। ফাল্গুনি পূর্ণিমায় আবার টান পড়ে রক্তঋণের সূত্রে, একদিন ঘরের মায়া ছেড়ে আসা মানুষটি কেন যেন ঘরেরই টানে পিতা-মাতার সাথে দেখা করতে গেলে কপিলা বস্তুতে। ঘরছাড়া সেই আষাঢ়ি পূণিমার ঝমঝমে এক বৃষ্টির রাতেই আবার পৃথিবী ছেড়েও চলে গেলে। যদি কখনো দেখা হতো তো জানতে চাইতাম, চান্নি পসরে তুমি কী এমন পেয়েছিলে গো? কে সে আমায় বারংবার বিবাগী করে আবার যে রাতে চাঁদ থাকে না সে রাতেও কে সে ডেকে যায় তারার নিমন্ত্রনে? শরতের মেঘের ডানায় ভর করে হানা দেয় কার্তিকের নক্ষত্ররাত, হেমন্তের ধানের ঘ্রাণে দেখা দেয় শুক্লপক্ষের কালতিথী মিশে যাই অন্ধকারে, নিজেকে দেখবো বলে।

যে অন্ধকার আলোর জন্মদাত্রি তার সন্ধানে কেটে যায় অনন্ত প্রহর। এভাবে বৃষ্টির রাত, ঝড়ের রাত, পানসে ম্যাটম্যাটে কুকুর ডাকা রাত অথবা যে রাতে সে ছিল সে রাতের কথা মনে করেও আমার ঘুম আসে না। আট বছর আগের একদিনের অশ্বথের ডাল জেগে থাকে স্মৃতির মিনার হয়ে। অথবা মনে হয়, I have promise to keep/ And miles to go before I sleep./ And miles to go before I sleep. এ অসুখ আমার একার নয়, আমাদের সবার, যারা মৌলবাদের ছোরায় ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়েও গগণশিরীষের সিথানে বসে নব নব কল্পনার জাল বুনি। একজন ‘অসুখি মানুষ’ তার সমস্ত অসুখগুলো আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দেন।

আমরাও আমাদের অসুখগুলো তাঁর সাথে, তাদের সাথে ভাগাভাগি করি। কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, যখন পূঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদকে বগলদাবা করে অথবা সাম্রাজ্যবাদই পুঁজিবাদকে অবলম্বন করে এমন একটা বিশেষ মর্যাদায় উপনিত হয়েছে যে, জতির নিজস্ব সংস্কৃতি বলে আর কিছু থাকছে না, জনগোষ্ঠী থাকতে পারছে না বিশিষ্ট এবং রাষ্ট্র তার স্বাতন্ত্র্য রাখতে পারছে না, ব্যক্তি মুছে যাচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে; তখন এসব ফাঁপা কথার দিন কী আর আছে? ব্যাপারটা একরকম তাই বটে। আমিও ভাবি, দ্বিতীয় সহস্রাব্দ আমাদের ঘাড় মুচড়ে ধরেছে। ভিন্ন সংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি, ধার করা সংস্কৃতি চিরে চ্যাপ্টা করে দিচ্ছে আমাদের। কিন্তু এইসব প্রশ্ন তো মাঝারি মধ্যবিত্ত আর এই আমরা অর্থাৎ নেড়িকুত্তার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত ছাড়া আর কেউ তুলছে না।

আপামর জনতার মাঝে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মহাজাগতিক নৈঃশব্দ, জনগণের বিশাল কোলাহলের মধ্যে অন্তঃসারশুন্য চিৎকার চেচামেচি। সেখানে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো প্রতিকার নেই। বাঙালি সংস্কৃতি কী, বাঙালি সংস্কৃতির ভূত-ভবিষ্যতই বা কী, এরকম কোনো কথা নেই। যেখানে গেলে এক কানের আওয়াজ শত কানের করে তোলা যায়, সেখানে তাদের প্রবেশাধিকার নেই। যারা সেখানে আছে, তাদের মাঝে শুধু ভোগ আর লালসা।

আর জনতার জন্য নির্ধারিত ক্ষুধাভোগ, ব্যাধিভোগ, বন্যাভোগ, খরাভোগ, সিডোরভোগ, আইলাভোগ। তাই সেখানে কথা ফুটতে পারে না, ফুটন্ত বাক্যদের চাপা দেয় নিদারুণ স্তব্ধতা, প্রাণকে চাপা দেয় অকারণ ক্রসফায়ার, ধর্ষণ, নির্মমঘুর্ণিময়দুর্নীতি। এক কথায়, মানুষ জাতটাই মরতে বসেছে। ধনতন্ত্র কোমর বেঁধে নেমেছে মানুষকে নিশ্চিহ্ন করবে বলে। সবদিক থেকেই।

পৃথিবীটাকে নষ্ট করে দেবে, যেন তা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয় আর মানুষের আত্মার পচন শুরু হয়ে গেছে। সামাজিকভাবে এত দীন, এতা নিঃস্ব, এতো তুচ্ছ মানুষ আগে কখনো ছিল না। কিন্ত আর সবার মতো আমরা ‍তাতে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিইনি। নাঁকি কান্নাতেও রুচি নেই। এই বাংলাদেশে যেখানে চালটা-ডালটা-নুনটার সঙ্গে কমরেডশিপ ও তাদের থিসিসটাও আমদানী হয় বিদেশ থেকে, সেখানে আমরা আমাদের ‘সর্বহারা’ তত্ব লিখে নিয়েছি এই বাংলার মানুষ ও তাদের যাপিত জীবনের যা কিছু অনুষঙ্গ তা মাথায় রেখেই।

বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাই আমাদের প্রধান অস্ত্র। এইখানেইে আমাদের স্বাতন্ত্র্য। বিপ্লব কিংবা সন্ত্রাস নয় মানবাত্মার যেখানে ক্ষয়ের উৎস তারই মর্মমূলের সন্ধান ও তার প্রতিকারের পথ খুজি আমরা শিল্পকে সমুন্নত রেখেই। মনে পড়ে গুরু একদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। স্বপ্ন দেখানো মানুষগুলো ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যাচেছ।

অথচ বাঁচতে হলে, এই স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোকে আর মানুষের মুক্তি যাতে নিহিত সেই স্বপ্নগুলোকে, যেকোনো মূল্যে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ’ কিন্তু মূল্যটা নেহায়েতই তুচ্ছ নয়। বাংলাদেশে এখন ভুখা মানুষের পক্ষে কথা বলে যারা তারা নিষিদ্ধ, সত্যবাদীরা অপাংক্তেয়, নির্বাসিত। সময়টাই বড় দুষিত হয়ে গেছে। মুক্তচিন্তার চর্চা ও তার প্রকাশ করছে যারা, এদের পাঁচ বছর এরা বলছে ‘সালা রাজাকার’ আর ওদের পাঁচ বছর ওরা বলে ‘সালা ভারতের দালাল’।

ধার্মিকেরা নাস্তিকতার দোহাই দিয়ে কতল করার সুযোগ খোজে। তাইতো কখনো কখনো গুরুই উৎকণ্ঠিত হয়ে বলেন, ‘একটু সতর্ক হও, মাথায় কিন্তু ভোজালি পড়বে। ’ গুরুর কথা ইতোমধ্যে অনেকটাই মিলে যায়, লোকজন আজকাল কেমন যেন চোখে তাকায়। কখনো মনে হয় সে চোখে রাগ, কখনো ঘৃণা। কারও কারও চোখে করুণাও দেখি।

জিহাদীদের চোখেমুখে আগুন ঝরে। ওরা ওৎ পেতে আছে কখন আমাকে কতল করে অশেষ ছওয়াবের ভাগিদার হবে সে জন্য। কেঁচো, বা কৃমির দিকে মানুষ যেভাবে তাকায় ধার্মিকেরা আমার দিকে তাকায় সেভাবে। আর যারা এখনো ভালোবাসার দাবি ছাড়তে পারেনি তাদের চোখ করুণায় ঝরে পড়ে, মনে মনে বলে―আহা, বেচারা। আমার হাসি পায়।

কোনো কোনো মূর্খতা এমনই, করুণার হাসি ছাড়া তার প্রতিদানে আর কীই বা দেবার আছে? মোজাম্মেল মাওলানার ছেলে, একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার পর পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে পবিত্র থেকে যায়, জামাতের পশ্চিম জেলা আমিরের ছেলে মোটর সাইকেল চুরি করে ধরা পড়ে বিশ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যায়, আহলে হাদিস আন্দোলনের এক কর্মী খুন করে জেল খেটে এলো তবুও তাকেই সবাই ডাকে মাসালা-ফতুয়ার জন্য। অথচ আমি এখনো খুন করিনি, ধর্ষণ করিনি, কোনো অসামাজিক কাজের প্রমাণিত অভিযোগও আমার নামে নেই, অথচ সকলের ঘৃনা, রাগ আর করুণার পাত্র আমিই। কারণ, যা আমি বিশ্বাস করি অকপটে সবাইকে বলে দিয়েছি। মানুষের সাথে, নিজের বিবেকের সাথে প্রতারণা করিনি। আমি শুধু বলেছি―যা বুঝি না, তা আমি পালন করবো না।

ধর্ম জিনিসটা আমি বুঝি না, আমি তা মানবো কেন? সত্যিই নিজের বুকের ভেতর কতো কিছুরই তো আলোড়ন চলে, তার সব খবর কী আর জানা আছে? এক মুহূর্ত পর আমি কী করবো তা কী আমি নির্দিষ্ট করে বলতে পারি? পারি না। যদি তাই হয় তবে ধর্মের মতো অমন দুর্জ্ঞেয় দূরান্বয়ী বিষয়কে বোঝার ভান করে এই ভণ্ডামী কেন? ধর্মগ্রন্থগুলোকে আর দশটা বই এর মতো বই ছাড়া আরতো কিছুই ভাবতে পারি না। ধর্ষক যে, প্রতারক যে, ভণ্ড যে, দেশদ্রোহী যে, মানবতা বিরোধী যে, সে কখনো ওজু করে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে পবিত্র হতে পারে না। কোনো ধর্মগুরুই এ কথা বলেন নি, অন্য কেউ যদি বলে, সে মূর্খ। সত্য কখনো অশ্লিল নয়।

যৌনতার চেয়ে আদিম আর কিছু নেই। যৌনতা চিরন্তন, যৌনকাতরতাই অশ্লীল। যৌনবিদ্বেষ এক ধরনের অসুস্থতা। ধর্ম মানবতার মুক্তির পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। যে দোষে তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধ হয়ে যায়, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগ্রন্থ সে দোষে দুষ্ট।

সব প্রতিষ্ঠানই মানুষের মুক্তির পথ রুদ্ধ করে। গোষ্ঠীচেতনা মানুষের দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। যুক্তির দ্বারা আমি এসব মানি বলে সব কিছুই সইতে পারি। কিন্তু আমার বাবা-মা? তাঁরা তো যুক্তি বোঝে না। এখনও তো তারা এক কিতাবের পাঠক।

ফলে আমার চেয়ে বিব্রত অবস্থা তাদের। সালিসী বৈঠকে আমি শুধু বলেছি, ‘তোমরা নামাজ পড়ে শান্তি পাও, আমি পাই না। তোমাদের ভালো লাগে, আমার লাগে না। এতোদিন আমি ঈশ্বরকে সত্য বলে জেনেছি আর এখন সত্যকেই ঈশ্বর বলে মানি। বলো আমি কী ভুল করেছি?’ আমার সে প্রশ্নের উত্তর তাদের মুখে জোগায়নি, কিন্তু বাবাকে সেদিনই সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

বাবা বাড়ি ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। আমারও কান্না পেল। বাবার এ অপমানের কারণ তো আমিই। কিন্তু আমার কীই বা করার আছে? আপনজন সে যত আপনই হোক, তার চোখের জলকে মূল্য দিতে গিয়ে আমি তো আর আমার সত্য থেকে বিচ্যুত হতে পারি না। আমি শুধু সাদা-কাল-লাল-নীল কতো স্বপ্ন দেখি দিন-রাত, জীবনের স্বপ্ন, মানুষের অমরত্বের স্বপ্ন।

শব্দ ও নৈঃশব্দের আলো-আধাঁরিতে কিংবা আধো-আলোছায়ার পডন্ত বিকালে স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি সঙ্গীহীন গাঙচিলের একাকিত্বে। গভির কালো রাতে, এক আকাশ তারার মেলার নিঃসীমতায় চাঁদের আলোর কার্নিশে, ধুলো পড়া রাজপথে শব্দহীন অনুচ্চারে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি কালোয় কালোয় মিলে যাওয়া জীবনের অনন্ত স্বর্গের চারণভুমিতে। আর ভাবি, চাঁদের বৈধব্য বাড়ে, ইতিহাসের চিহ্ন মুছে যায়, সময় থাকে, যে সময়ের যেকোনো দুটি মুহূর্ত কখনো এক নয়। কোনো কোনোটা আবার চোরাবালির মতো।

বালি থাকলে চোরাবালি থাকেই। নদী টেনে নেয় যাদের জমি-জিরেত, বাড়িঘর এবং আশার শেষ বাতিঘর তারা কী নিয়ে বেঁচে থাকে আর তাদের ঠাঁইবা হয় কোথায়? কেউ রাজধানীর সিগন্যাল স্টপে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাচের আব্রুর রঙিন চশমায় উঁকি দিয়ে হাত পেতে থাকা কোনো অভাগীর করুণ চাহনিতে এর উত্তর খোঁজেন। আর কেউবা রেললাইনের ধারে কোনো মস্তানের গড়ে তোলা 3 তলা জায়গিরে আঁতিপাঁতি করে খোঁজেন ছিন্ন পাতার শতদল একসাথে করার মতো করে; মুখে শোনা বয়ানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন আর ভাবেন, আমি যারে খুঁজি এই কি সেই? এসব হতভাগা-হতভাগিনীর কারো কারো ঠাঁই যে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে হয় তার একটা হিসাব তো পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট জুজু বিদায় নেওয়ার পর পশ্চিম ইউরোপ-আমেরিকার ব্রোথেলগুলো এবং ভবঘুরেদের রগরগে কাহিনীর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। আজিমপুর বস্তি আর গোয়ালন্দ ঘাটের বেশ্যাপাড়ায় যাদের বাস তাদের মধ্যে থেকে কোনো এক শান্তা যদি শেষ পর্যন্ত নর্দমা ফুঁড়ে বেরিয়ে আলো ছড়ান, তখন আমরা সভ্য মানুষরা নিজেদের লাজলজ্জা ঝেড়ে ফেলে অর্থ-মোক্ষ লাভের নেশায় তার পিছু লাগতে দ্বিধা করি না। এই দুনিয়ায় ‘সারভাইবাল ফর দি ফিটেস্ট’ আপ্তবাক্যকেই আমরা প্রায় সবাই জীবনের সার করে নিয়েছি কি-না! তা না হলে সে জোরই বা কোথায় আর সে মেজাজই বা কোথায় যে সব ঝেড়েঝুড়ে খাড়া করে বলবো, আমরাও পারি।

না সে সব বালাই আমাদের নেই। আমাদের নপুংশুক দেহগুলো আর সংবেদী আত্মাগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে কাক ও শকুন। আমাদের শুভ বোধগুলো বুটে আর বুলেটে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মিশে যাচ্ছে ধুলোর সাথে। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের জন্য যে কৌশল আমাদের একান্ত আয়ত্ব হওয়া উচিৎ তার জন্য দরকার স্বপ্ন দেখা ও দেখানোর মতো বাতিওয়ালা স্বপ্নের জাদুকর। যিনি আমাদের তার শৌর্য-বীর্য, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, লোভ-লালসাহীন-নির্মোহতা গুণে সংকীর্ণতাকে ভুলিয়ে সবাইকে এক দেহ এক মন-প্রাণ করে নেবেন।

যিনি আমাদের বলবেন, আটপৌরে গৃহস্থ বাড়ি পদ্মায় টেনে নেওয়ার মাঝে যে সুদীর্ঘকালের মানব বসতির হাসি-কান্না, জীবনের চালচিত্রের ইতিহাস বুকফাটা আর্তনাদ হয়ে নদীর ঢেউয়ে আছড়ে পড়ে, তার মূল্য কতো। গুরুর মুখে একদা এরকম কথা শুনতে শুনতে আর ভাবতে ভাবতে তখন আমি কেন জানি না বিভ্রান্ত বিমূঢ় হয়ে পড়তাম। অকারণেই সিরাজ শিকদার, শ্রীমৎ সেতাবের মতো মুখগুলো ভেসে উঠতো মহাকালের মিনার হয়ে। কখনো কখনো মনে হতো তাঁর কথাগুলো অতি বিশুদ্ধ ও সর্বোৎকৃষ্ট চোলাই, জিভ ছোঁয়ানো মাত্র মগজ নড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন যাবৎ লালিত কতো স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা পচিয়ে তারই নির্যাস থেকে তৈরি হয়েছে এরকম রৌদ্রতপ্ত আরক।

টলটলে স্ফটিকের মতো রঙ তার, ঝকঝকে ছুরির মতো ধার। তখন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম, পাক্কা তিন বছর লাগলো অর্থ বুঝতে। তবু সবটুকু কি বুঝেছি? না বোধহয়। বারো বছর ধরে তপরত রাজু ভাইয়ের বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু এতটুকু বলতে পারি, এইসব কথা একদিনে হয়নি। কতোবার কতো কথার মধ্যে হয়তো এইসব কথাও হয়েছে।

সে কি আর আমার জানা আছে? স্যারের স্বচ্ছ চোখ দুটির তারায় কতো কথাই না খেলা করেছে, কষ্টগুলো গেঁথে রাখা ভাঁজে ভাঁজে স্বপ্নভঙ্গের ঘাম জমেছে, পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য অপার প্রেম ঝাঁঝালো মদের মতো লেপ্টে থেকেছে প্রতিটি শব্দের শিরায় শিরায়। সে কথায় আমরা মাতাল হয়েছি। কখনো তল খুজে দেখার চেষ্টা করিনি। স্যার বলেছেন আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ কখনো মরবে না। মানুষ মরতে পারে না।

এই সব স্বপ্ন যা আপাত অবাস্তব, তবুও মানুষের মাঝে তা আছে বলেই মানুষ বেঁচে থাকবে। হ্যাঁ, ‘মানুষ বেঁচে থাকবে’। আর বেঁচে থাকবে বলেই, যখন পূঁজিবাদের থাবা এতো ভয়ঙ্কর, সাম্রাজ্যবাদের বিস্তৃতি এতো সর্বগ্রাসী, জতির নিজস্ব সংস্কৃতি ক্রমবর্ধমানভাবে ক্ষয়িষ্ণু ও ভঙ্গুর, জনগোষ্ঠী থাকতে পারছে না বিশিষ্ট, রাষ্ট্র তার স্বাতন্ত্র্য রাখতে পারছে না, ব্যক্তি মুছে যাচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে; তখনও যান্ত্রিক বিচারে যেসব ফাপা কথা সেসবই মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগাবে। মানুষ দেহজ প্রয়োজনের সীমা যতো অতিক্রম করবে, ‘আত্মার’ প্রয়োজনের সীমা তাতোই বিস্তৃত হবে। তাই তাকে বাঁচতে হবে শিল্পকে সাথে করেই।

মানুষ যে, তার জন্য শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনো বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। শিল্পবোধের এই বিশ্বাস আর এই বিশ্বাসজাত অসুখ আমাদের বুকের ভেতর এখনও আছে বলেই জীবনটা কখনোই অর্থহীন ভাবতে পারি না। এই দুরারোগ্য অসুখ যতো বাড়ে ততোই আমাদের শ্লাঘাবোধের ক্ষেত্রও বিস্তৃত হয়। রবিবারের পাঁচটা-সাতটায় চিহ্নআড্ডায় বসে আমরা এসব জল্পনা-কল্পনাই করি। এখানে একদিকে যেমন চলে আমাদের ‘সোম থেকে শণির সাতকাহন’ পাঠ তেমনি অন্যদিকে নানা কথার আড়ালে আমরা এই প্রত্যয়ই ব্যক্ত করি বারংবার।

এবং মানুষকে ভালোবাসার অসুখ, আকাশ নদী ঘাস চাঁদ তারা সর্বোপরি শিবসুন্দরের পূজা করার অসুখ, এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে আমাদের প্রতিটি রক্ত কণিকায়; তারপর ছুটে বেড়ায় মস্তিস্কে, হৃদপিণ্ডে, নিরন্ন পাকস্থলিতে। তাই গগণশিরীষের সিথানে আমাদের এই আড্ডাখানাকে আরসব লোকেরা ‘চিহ্নদপ্তর’ বলে থাকলেও আমি বলি, এই হচ্ছে আমি ও আমাদের অসুখের অসুখের ঘর। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.