আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শফিক মামা - ফুল তাও, একদম ফুল .........

ত ৩২৪, আহহানউল্লাহ্‌ হল, বুয়েট। মেহেদীর কল পেয়ে আসলাম। জটিল কার্ড খেলা হচ্ছে। দেখলাম ৭/৮ জনের মতো গোল হয়ে বসে কার্ড খেলছে। সবার মাঝখানে পড়ে আছে বেশকিছু টাকা, বুঝলাম ছোট খাট গ্যাম্বলিং হচ্ছে।

সবার মুখ মোটামোটি গম্ভীর। একজন শুধু সমানে বকবক করে যাচ্ছে আর প্রতি দান শেষে সবাইকে গালাগালি করে বেশ কিছু টাকা তার সামনের টাকার স্তুপে জমা করছে। "কিরে লিটু, এখনও নেংটা হস্‌ নাই!!!", "হীরা, পুরো গাজা হ শালা !!!", "ভাইস্তা, ১০০ টাকা কম আছে, সমস্যা নাই পরের দানে ঐটা সহ যা আছে নিয়ে আসতে হবে !!!" খেলা শেষে সবাইকে আরেকদফা গালাগালি করে কার কতো লস্‌ ঐভাবে হিসেব করে টাকা ভাগাভাগি করে দেয়া হচ্ছে। "শালা, চিকেনের মতো খেইলাও তো লাভে যাইতে পারলি না !!!", "জাহিদ শালা অটো মাল হ" !!!খেলা শেষে তার সাথে পরিচয় হলো । মেহেদীর স্কুল ফ্রেন্ড শফিক।

"আমি শফিক, মানিব্যাগ আছে তো ? !!পরেরদিন আসার সময় মানিব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসবা!!!!" এরপর থেকে ৩২৪ হয়ে গেল আমার ঠিকানা। ভার্সিটি ভ্যাকেন্ট, প্রব্লেম নাই, বুয়েট খোলা আছে। বোর লাগছে, প্রবলেম নাই, ৩২৪ এ ৫/৬ জন পাওয়া যাবেই। ইয়ার ফাইনাল শেষ ? সপ্তাহখানেকের জন্য ৩২৪। এটা শুধু আমার না, মোটামোটি ৯/১০ জন ছেলেপেলে দিনে অন্তত একবার নিয়মিত উঁকি দিতই।

আর চলতো কার্ড খেলা আর মুভি। শফিকের রুমমেট ছিলো সাত্তার, একটু সিরিয়াস টাইপ। প্রায়ই শফিকের আর ওর ফ্রেন্ডদের অত্যাচারে অন্যরুমে গিয়ে থাকতে হতো। কিছু বলেও লাভ নাই, বল্লে উৎপাত আরও বেশি হতো!!!মাঝে মাঝে শফিকই ওর রুমে থাকতে পারতো না, ওর জায়গা হতো না, রুম প্যাক আপ। বুয়েটে আউলা,৩২৪ কে স্টুডেন্ট রা চিনতোই মাস্তবাজির জায়গা হিসেবে, যে রুমে - বুয়েট বন্ধ, সেমিস্টার ফাইনাল, ঈদের ছুটি এইসব বলে কোনো কথা ছিলো না.....সবসময়ই কিছু ছেলেপেলে কার্ড খেলছে, মুভি দেখছে নয়তো জোরে জোরে গান শুনছে.......আর মারামারি, ঝগড়া তো আছেই......শফিক রুমের ডিজাইন ই করে ফেলেছিলো, দুই পাশে দুইটা খাট, মাঝখানে বিশাল বড় একটা বেড যেখানে ৮ জনে কার্ড খেলতে পারতো আর একসাথে ৬ জন ঘুমাতে পারতো !!!!!শফিককে কয়বার যে স্যারেরা বুয়েট থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলো আর প্রভোস্ট এসে ওর রুমে রেইড দিয়েছিলো তার হিসেব নেই।

প্রতিবারই খুব কাচুমাচু হয়ে স্যারদের বলতো, "এবারই শেষ, আর হবে না!!" আর ওখান থেকে এসেই পোলাপান কে কল, "প্রব্লেম সলভ্‌ড, চলে আয়। এবার খুঁজে বের করি রিপোর্ট টা করছে কে!!!!" আমরা ইমপ্রুভ/ক্র্যাশ রাখতাম ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় , একজন দেখলাম ভার্সিটি লাইফ শেষ করেও সে অভ্যাস ছাড়তে পারে নাই। প্রথমবার IELTS পরীক্ষা দিয়ে এসে বল্লো, ইম্প্রুভ রাখলাম মামা, পরেরবার ফুল মনোযোগ দিয়ে দিতে হবে তাও!! আর এবার ভালো নাম্বার আসলেও বিপদ, বড় ভাই কানাডা নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করতেছে!! এত তাড়াতাড়ি গিয়ে লাভ নাই। পরেরবার দিয়ে বল্লো, "মামা, হেডফোনটা নষ্ট ছিলো, তাই লিসেনিং পার্টটা ভালো হয়নাই, অন্যগুলাতে কনফার্ম আট....."। রেসাল্ট দিলে দেখা গেলো লিসেনিং এ মার্কস যথেষ্টই ভালো, ডাব্বা মারছে স্পিকিং এ।

"শালার ইন্ডিয়ানদের দেয় আমাদের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে, ওরা আমার ইংলিশ বুঝলেই না নাম্বারিং করবে!!!কোনো ফরেইনার হইলে কনফার্ম আট পাই!!!" থার্ড বার গেলো একদম সিরিয়াস হয়ে। মামা এবার ফুল সিরিয়াস, নো অবজেকশান!!! পরীক্ষা দিয়ে দেখলাম সেই একই চিত্র। কিরে এবার কি হলো ? "সবই ঠিক ছিলো মামা। বা..., ভাইভা যে নিছে তার গলা পুরাই সিমির মতো!!!" "পুরাতন কথা মনে পড়ে গেছে মামা, আর কনসেন্ট্রেট করতে পারি নাই (চরম দু:খী একটা ভাব মুখে..!)" আমি আর কথা শুনাবো কি ? স্বান্তনা দিয়ে কুল পাই না......। ঢাকা ইউনিভারর্সিটি তে MBA এডমিশন টেস্ট দিলো।

রেসাল্ট দেখতে যাবার সময় আমাকে নিয়ে গেলো। কিরে কোন সাব্জেক্ট পাবি ? "ওরা বড় ধরনের কোনো ভুল না করলে ৫০ এর মধ্যে থাকবো!!", বল্লাম তাইলে ফাইনান্স পাবি কনফার্ম। টোটাল স্টুডেন্ট নিবে ৩৫০। রেসাল্ট শিটে সিরিয়াল দেখলাম ৩৪৭!!!। শফিকের রিআ্যাকশন, "বাল্‌ বাল্‌ বাচ্‌ গেয়া...!!!।

পাস করে বের হওয়ার পরপরই ২৯ তম BCS এর ফর্ম ফিল আপ করলো। বল্লাম সিভিল থেকে পাস করছোস, BCS দিয়ে দ্যাখ, ভালো চান্স আছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, BCS এর প্রসেস শেষ হতে ১/২ বছর লাগে। তার কথা, "লং প্রসেস মামা, এইসবে গিয়ে লাভ নাই। নিয়োগ দিতে দিতে আমি কানাডা থাকবো।

ভালো কথা, ৩০ তম ডেট পড়লো, তখন তার আফসোস, দিলে ২৯তম - ই দেয়া দরকার ছিলো, এখন আর দিয়ে কি হবে!! কয়দিন আগে খুব গম্ভীর মুখে গিয়ে ৩১-তম বিসিএস দিয়ে আসলো এবং যথারীতি পি,এস,সি বড় ধরনের ভুল না করলে ওর ৮০ টা ঠিক হবে কনফার্ম!!! কয়দিন আগে বল্লাম, মামা পোলাপান তো সব বাইরে চলে গেল। আমরা দুইজনে কি পড়ে থাকবো নাকি দেশে ? তুই ব্যাংকে আর আমি জিপি তে ? পিঠ তো দেয়ালে ঠেকে গেলো মামা....."পিঠ তো দেয়ালে ঠেকছে বহু আগেই, এখন দেয়ালের ঐ পাশ দিয়ে বাইর হইতাছি। ঐ পাশে বের হয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে, তার জন্য ওয়েট করতেছি!!" , শফিকের জবাব!!!!মাঝখানে তার ঝোঁক উঠলো শেয়ার ব্যবসা করবে, চাকরী বাকরি ছেড়ে দিলো। সারাদিন ডিএসই -র ওয়েবসাইট আর মতিঝিল। "বুঝলা মামা, ঐসব চাকরী-বাকরি করে লাভ নাই, লং প্রসেসে গিয়ে লাভ নাই, শর্টকাটে কোটিপতি হতে হবে, ফুল কোটিপতি তাও!! কোটিপতি হলেই কোটিপতির মেয়ে পাবো!!!" আমি বল্লাম তা মেয়ের ফ্যামিলিকে কি বলবি ? ছেলে কি করে ? "ছেলে বুয়েট পাস, খুব ব্রিলিয়ান্ট আর শেয়ার ব্যবসা করে !!! নির্বিকার ভাবে সে বল্লো।

তার চাকরী ধরা আর ছাড়ার কাহিনী শুরু করলে শেষ হবে না। পাস করার পর থেকে অন্ততপক্ষে ১০ টা চাকরী ধরেছে আর ছেড়েছে!!আর তার চাকরী ছাড়ার কারণ গুলাও মাজার মজার। শেয়ার ব্যবসা চাঙা, ৩০ হাজার টাকার চাকরী করে লাভ নাই। ফেসবুকে সারারাত POKER খেলে সকালে ঘুম থেকে উঠে চাকরীতে যাওয়া পসিবল না, ছাড়ো চাকরী। একবার টানা দশদিন কাউকে কিছু না বলে চাকরী থেকে লাপাত্তা।

অফিসের ফোন হলেও ধরে না। দশদিন পর ধরলো। তার বস ফোন ধরে বল্লো , "তুমি জয়েন করো, সমস্যা নাই, তোমার সেলারী ও কাটা হবে না, ঐ দশদিনের টাকাও পাবা" সে বল্লো ,"স্যার আমার ঐ দশদিনের টাকাও লাগবে না, বিশদিনের টাকাও রেখে দেন, আমি আর অফিসে যাবো না!!!" আরেকবার চাকরী ছাড়লো যেদিন জয়েন করলো সেদিন। কারণ অফিসের ডেকোরেশন তার পছন্দ হয় নাই আর কলিগরা সবাই বুড়া বুড়া !!! আর এখন তার ব্যাংকের ম্যানেজার আছে দৌঁড়ের উপর, সে নাকি ম্যানেজারকে প্রায়ই হুমকি দেয়, বুয়েটের সিভিল ইন্জিনিয়ার আর পাবেন না !! দুই তিনবার চাকরী ছাড়লো সিমির কথায়(যদিও আমার মনে হয় এইসব বানানো), সিমি নাকি বলেছে, কই চাকরী করো ?, কেউ তো চেনেই না। চাকরী না করে কানাডায় ট্রাই করো........তার অভিযোগের শেষ নাই।

ইদানিং বলা শুরু করেছে আমার জন্য নাকি তার কানাডা যাওয়া হলো না !! আমি এপ্লাই করি নাই বলে সেও করে নাই!!! একা একা যায় কেমনে ?? তার সব ধরনের আব্দার আর পেইন আমার কাছে। সিমির কাছে পেইন খেয়ে আসে তারপর আমাকে পেইন দেয়............. একবার ইন্টারভিউতে গেলো। তাকে বেশ কিছু টেকনিক্যাল কোয়েশ্চন করার পর তার কাছে জানতে চাওয়া হলো তার জানার কিছু আছে কিনা ? সে শুরু করলো একটার পর একটা কোয়েশ্চন। তার জেরায় বিরক্ত হয়ে ওরা বল্লো আপনি তো দেখি ইন্টারভিউ দিতে আসেন নাই, নিতে আসছেন!!তার জবাব, "স্যার অনেক দিয়ে দেখছি, লাভ হয় না এবার নিয়ে দেখি কি হয়!!" এখনও পর্যন্ত তাকে কেউ কথা শুনিয়েছে আর উত্তরে কিছু শোনে নি, আমার চোখে তা পড়ে নি। আমার সব ফ্রেন্ডরাও একমত হবে আমি নিশ্চিত।

আরেকবার আরেকটা চাকরীতে চাইলো ৩ বছরের অভিগ্গতা, ও তখন ফ্রেশ গ্রাজুয়েট কিন্তু এপ্লাই করলো। তাকে জিগ্গেস করা হলো, আমরা তো এক্সপেরিয়েন্সড চাইছি আপনি এপ্লাই করলেন যে ?? তার উত্তর , আপনারা চাইছেন, ৩ বছরের অভিগ্গতা আমার বুয়েটের ইন্জিনিয়ারিং এর অভিগ্গতা পাঁচ বছর!!বুয়েটে তো ইন্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে আন্গুল চুষি নাই, কাজ করছি!! এগুলা হয়তো শুনতে সিনেমাটিক ব্যাপার শোনায় কিন্তু পুরো ব্যাপার গুলাই নির্ভেজাল সত্য। তার লাইফটাই সিনেমাটিক......এক সিমি ছাড়া আমি গত ৬ বছরে তাকে আর কোন কিছুতেই সিরিয়াস হতে দেখি নাই। তার ফ্যামিলীতে সে সবার ছোট, আর তার ঝাড়িতে সবাই থাকে দৌড়ের উপর!! মজার ব্যাপার হচ্ছে তার ডিসিশানই ফ্যামিলির ডিশিসান!!! তার বড় দুই ভাই ও বুয়েটের ইন্জিনিয়ার এবং তাদের সে সম্বোধন করে তুই করে আর তাকে ভাইয়ারা তুমি করে !!! তাদের কাছেও এটা খুব স্বাভাবিক। আন্টি মারা যাওয়ার পর থেকে তার অমতে কোনো ডিশিসান নাকি এখন পর্যন্ত নেয়া হয় নাই (মিলন ভাই হাসতে হাসতে একদিন বলছিলো.....)।

তার ইথিক্যাল ব্যাপার গুলোও দেখার মতো। তার এক্সপেকটেশনও দেখার মতো। প্রথমদিন আমরা গেলাম লংকা-বাংলায়, শেয়ার ব্যবসা দেখার জন্য। লংকা-বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমদিনের তার কথাটা এখনও আমার কানে ভাসে, "মামা একটা লংকা-বাংলা দিতে কয় টাকা লাগে, একটা তো দেয়া দরকার!!!" এখনও আমি মাঝে মাঝে খোটা দেই, কিরে লংকা-বাংলার কতদুর ? "অন দ্য প্রসেস, ফুল তাও !!!" তাকে আমি কখনও রাগতে দেখি নাই, কখনও মন খারাপও করতে দেখি নাই। কখনও খারাপ ব্যবহারও করতে দেখি নাই কারো সাথে।

কিছু কিছু মানুষ আছে হয়তো, যারা তাদের কষ্টগুলো, হতাশাগুলো, দু:খগুলো একান্তেই রেখে দেয় নিজের কাছে। নিজের আনন্দগুলো আর ভালো লাগা গুলোই শুধু সবার জন্য। ঐগুলো সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেই পছন্দ করে। হয়তোবা দিন শেষে একটা দীর্ঘনি:শ্বাস বের হয়ে পড়ে নিজের অজান্তে....কিংবা কে জানে ? এই ধরনের মানুষগুলো হয়তো জানেই না দীর্ঘনি:শ্বাস কি ...................  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।