আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাতক্ষীরার আইলা দুর্গত মানুষদের অশেষ ভোগান্তি

আমি বেশ চুপচাপ!! ঘূর্নিঝড় আইলা আঘাত হানার পর দু’বছর পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর ইউনিয়ন ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের সহস্রাধিক পরিবার এখনও তাদের বাপ-দাদার ভিটায় ফিরে যেতে পারেনি। অনেকেই ভেড়িবাঁধের উপর মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। আইলার আঘাতে ধ্বসে যাওয়া ভেড়িবাঁধের ক্লোজার গুলোর নির্মান কাজ এক মাস আগে শেষ হলেও বিভিন্ন এলাকায় ভেড়িবাঁধে নতুন করে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ফাঁটল। যে কোন মুহুর্তে ভাঙ্গনকবলিত এসব বাঁধ ধ্বসে বিস্তির্ণ এলাকা আবারও প্লাবিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। আইলা দুর্গত এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট।

ভেড়িবাঁধ সংলগ্ন স্লুইজ গেট দিয়ে নদীর পানি উঠানো বন্ধ ঘোষনা করায় এলাকায় এখনও চিংড়ি চাষ শুরু হয়নি। ফলে অধিকাংশ মানুষ বেকার। আইলা বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট নির্মান কাজ এখনও শুরু হয়নি। এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দু’বছর পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার আইলা দুর্গত এলাকার মানুষের ভোগান্তি এখনও শেষ হয়নি ।

ঘুর্ণিঝড় আইলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের ১৪টি গ্রাম। ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘুর্নিঝড় আইলার আঘাতে ওই তিনটি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ ভেসে যায়। ভেড়িবাঁধের ২৫টি ক্লোজার ধ্বসে পড়ে। এক বছর ১১ মাসের মাথায় (গত এপ্রিল মাসে) ক্ষতিগ্রস্ত ক্লোজার গুলোর নির্মান কাজ শেষ হয়েছে। নদীর পানি লোকালয়ে উঠা-নামা বন্ধ হলেও সহস্রাধিক পরিবার এখনও তাদের বসত বাড়ীতে ফিরে যেতে পারেনি।

তাদের ভীটেবাড়ীর জায়গাটুকুও আইলার আঘাতে নদীতে মিশে গেছে। শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: মাসুদুল আলম জানান, আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্লোজার গুলোর নির্মান কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। কিন্তু খোলপেটুয়া, জেলেখালি, নয় নম্বর সোরা, চাঁদনিমুখা এলাকায় পাউবোর ভেড়িবাঁধে নতুন করে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে এগুলো সংস্কার করা না হলে যে কোন মুহুর্তে ভেড়িবাঁধ ধ্বসে বিস্তির্ণ এলাকা প্লাবিত হবে। ভাঙ্গনকবলিত এসব এলাকা সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যে পাউবো টেন্ডার শেষে কার্যাদেশ দিলেও ঠিকাদাররা কাজ শুরু করছে না।

বার বার পাউবো কর্মকর্তাদেরকে বলা হলেও তারা কাজ শুরুর ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তিনি বলেন, গাবুরা ইউনিয়নের জেলেখালী, গাবুরা, চকবারা, চাঁদনিমুখা ও নয় নম্বর সোরা এলাকায় পাঁচ শতাধিক পরিবার এখনও ভেড়িবাঁধের উপর বসবাস করছে। আইলায় তাদের বসতভীড়া পর্যন্ত নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নেয়া এসব পরিবারগুলো মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এলাকায় দুর্ভিক্ষ চলছে।

ধনী-গরীব বলতে এখন কেউ নেই। সবাই অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছে। চিংড়ি চাষই এলাকার মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস। কিন্তু সরকার ভেড়িবাঁধ ছিদ্র করে চিংড়ি ঘেরে নদীর পানি উঠা-নামা বন্ধ করে দেয়ায় সিংহভাগ জমি পতিত পড়ে রয়েছে। পানির অভাবে চিংড়ি চাষ করা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি নদী থেকে চিংড়ি ঘেরে পানি উঠানোর অপরাধে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১২৭ জন গ্রামবাসীর নামে মামলা দিয়েছে। এদেরকে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে হয়েছে। আইলার পর থেকে এলাকার হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। এই ইউনিয়নে দাতা সংস্থা কারিতাস ছয়’শ বাড়ী তৈরীর কাজ শুরু করলেও তা এখনও শেষ হয়নি। এছাড়া জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে মাত্র ২৫টি বাড়ী বরাদ্দ দিলেও তার কাজ এখনও শুরু হয়নি।

খাবার পানির সমস্যা প্রকট আকার ধারন করেছে। এই ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের মধ্যে ১০টি গ্রামে টিউওবয়েল সাকসেসফুল নয় বিধায় ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এলাকার মিষ্টি পানির পুকুর গুলো আইলার পর থেকে লবনাক্ত হয়ে পড়েছে। যাদের সমর্থ রয়েছে তারা ৫ লিটার পানি ৩০ টাকা দিয়ে কিনে খাচ্ছে। গাবুরা ইউনিয়নের নয় নম্বর সোরা গ্রামের আবু গাইনের স্ত্রী রোকেয়া খাতুন (৫৫) সংসারের অভাব অনটনের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে জানালেন, আমাগের কষ্টের অন্ত নেই।

নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে যদি ভাগ্যে মাছ জোটে তো খাবার জোটে। যে দিন মাছ জোটেনা সেদিন ভাত জোটে না। চকবারা গ্রামের কোপাত মালীর স্ত্রী হামিদা (৪৮) জানায়, আইলার ক্ষতি এখনও কাটাতে পারেনি। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে। খাবার পানির সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদিন ভাত না খেয়ে বাঁচা যায় কিন্তু পানি না খেয়ে তো বাঁচা যায় না।

আইলার পর কয়েকটি এনজিও খাবার পানি দিলেও এবছর কোন এনজিও তা দিচ্ছে না। খুব কষ্টে আছি। গাবুরার চকবারা ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বর রবিউল ইসলাম জানান, আইলার পর থেকে এলাকায় পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতি হয়েছে। আইলা দুর্গত এলাকায় গাছপালায় মড়ক ধরেছে। গাছ বললে সামান্য কিছু নারিকেল গাছ ও খেঁজুর গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই।

যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। বর্ষা মৌসুমে একমাত্র নৌকায় ছাড়া চলাফেরা করা যাবে না। শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনয়নের চেয়ারম্যান মো: আমজাদুল ইসলাম তার ইউনিয়নের সার্বিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আইলায় ধ্বসেপড়া ভেড়িবাঁধের ক্লোজার গুলোর নির্মান কাজ ১৫ দিন আগে শেষ হয়েছে। এলাকায় নদীর পানি উঠা বন্ধ হলেও খোলপেটুয়া নদীর কামালকাটি, ঝাপা, পশ্চিম পাতাখালী এবং কপোতাক্ষ নদের পূর্ব পাতাখালী, চন্ডিপুর এলাকায় ভেড়িবাঁধে ব্যাপক ফাঁটল ধরেছে। যে কোন মুহুর্তে এসব বাঁধ ধ্বসে আবারও প্লাবিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

পাউবো এসব এলাকা সংস্কারের জন্য টেন্ডার আহবান করলেও কাজ শুরু হয়নি। তিনি জানান, এই ইউনিয়নে এখনও শতাধিক পরিবার ভেড়িবাঁধের উপর বসবাস করছে। এদের বসতবাড়ী ও জায়গা নদীতে মিশে গেছে। জমি না থাকায় তাদেরকে পূনর্বাসন করা যাচ্ছে না। এলাকায় সব চেয়ে সমস্যা খাবার পানি।

সরকারী বা বেসরকারী ভাবে খাবার পানি কেউ দিচ্ছে না। সরকারী ও বেসরকারী সাহায্য কমে গেছে। এলাকার মানুষ খবই কষ্টে রয়েছে। পাউবো নদীর পানি ঘেরে উঠাতে না দেয়ায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়নি। এলাকার হাজার হাজার মানুষের কোন কাজ-কর্ম নেই।

রাস্তাঘান নির্মান কাজ এখনও তেমন শুরু হয়নি। আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা দিয়ে পায়ে হেটে ছাড়া চলা যায় না। বিকল্প পথ হিসেবে বিল বা পতিত চিংড়ি ঘেরের মাঝ দিয়ে এলাকার মানুষ চলাচল করছে। সব মিলিয়ে এলাকার মানুষ দূর্বিসহ জীবনযাপন করছে। তিনি বলেন, গত বছর ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার আইলা দুর্গত এলাকায় আসেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার প্রতি ২০ হাজার টাকার চেক হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।

কিন্তু আজও ওই টাকা আইলা দুর্গত এলাকার মানুষ হাতে পায়নি। তালিকা প্রস্তুত নিয়ে স্থানীয় এমপি এইচ এম গোলাম রেজা বাদি হয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করার কারনে ওই টাকা প্রদান কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: জাকির হোসেন জানান, তার ইউনিয়নে গতমাসে আইলায় বিধ্বস্ত ক্লোজার গুলোর নির্মান কাজ শেষ হয়েছে। তবে চাকলা, সুভদ্রাকাটি, কুড়িকাউনিয়া, নাকনা, প্রতাপনগর, হরিসখালী, হিজলিয়া ও রুইয়ারবিল এলাকায় পাউবোর ভেড়িবাঁধে ব্যাপক ফাঁটল দেখা দিয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ভেড়িবাঁধ সংস্কার করা দরকার।

পাউবোর কর্মকর্তাদের এনিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। সুভদ্রাকাটি,রুইয়ারবিল ও চাকলা এলাকায় এখনও আড়াই’শ পরিবার ভেড়িবাঁধের উপর বসবাস করছে। এরা সবাই ভূমিহীন। তাদের জমি না থাকায় বাড়ীঘর তৈরী করে দেয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এই ইউনিয়নে শতাধিক একর সরকারী খাস জমি রয়েছে।

এসব জমি ভূমিহীনদের মাঝে জরুরী ভিত্তিতে বন্দোবস্ত দিয়ে তাদেরকে পূনর্বাসন করা দরকার। এলাকায় খাবার পানির সংকট নিরসনে আরও কয়েকটি গভীর নলকূপ বসানোর দাবি জানান তিনি। এলাকার রাস্তাঘাটের খুব খারাপ অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাঁচা রাস্তার কোন অস্তিত্বই নেই। পাকা রাস্তা দিয়ে পায়ে না হেঁটে চলা যায়না। এলাকায় মানুষের কাজ নেই।

৪০ দিনে কর্মসৃজন কর্মসুচীতে মাত্র ৪২০ জন বর্তমানে কাজ করছে। কাবিটা প্রকল্পের আওতায় মাত্র ২টি প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও কাজ এখনও শুরু হয়নি। কোন বেসরকারী সংস্থা এলাকায় এখন আর কাজ করছে না। কোন সহায়তাও দিচ্ছে না । সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুজিবর রহমান জানান, আইলা দুর্গত এলাকায় একাধিক স্থানে ভেড়িবাঁধে ফাঁটল দেখা দিয়েছে।

বর্ষা মৌসুমের আগেই এসব বাঁধ সংস্কারের জন্য টেন্ডারের কার্যক্রম ইতিমধ্যে শেষ করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদাররা কিছু কিছু এলাকায় এখনও কাজ শুরু করেনি। তারা যাতে দ্রুত কাজ শুরু করে সে ব্যাপারে তাগিত দেয়া হচ্ছে। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভেড়িবাঁধ কেটে নদীর পানি চিংড়ি ঘেরে উঠানো সরকারী ভাবে নিষেধ রয়েছে। বিধায় যত্রতত্র ভেড়িবাঁধ কাটতে দেয়া যাচ্ছে না।

তবে ঘেরে পানি উঠানোর জন্য পাউবো অনুমদিত স্লুইজগেট গুলো খুলে দেয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মো: আবদুস সামাদ জানান, আইলায় যে সমস্ত ভেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা ইতিমধ্যে নির্মান কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এসব বাঁধ গুলো এখন সংরক্ষন করা দরকার। পাউবো কর্তৃপক্ষকে সেভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সামান্য কিছু পরিবার এখনও ভেড়িবাঁধের উপর রয়েছে।

এদের জমি না থাকায় বাড়ীঘর তৈরী করে দেয়া যাচ্ছে না। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ঘুর্ণিঝড় সহনীয় গৃহ নির্মানের জন্য সাতক্ষীরার আইলা দুর্গত এলাকার জন্য ৮ কোটি ৭৮ লাখ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বাড়ীঘর তৈরীর কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আইলা দুর্গত শ্যামনগর ও আশাশুনির প্রতিটি ইউনিয়নে এক হাজার করে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে ৩৪৫ মে: টন আতপ চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আগামী কয়েক দিনে মধ্যে এসব চাল বিতরন করা হবে।

এছাড়া এলাকার মানুষের কর্ম সংস্থানের জন্য কাবিটা ও কাবিখা প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চিংড়ি চাষ শুরু না হলেও এলাকার মানুষের পুরোপুরি কর্মসংস্থান হবে না। ভেড়িবাঁধ না কেটে বা ছিদ্র না করে কিভাবে বাঁধের উপর দিয়ে ঘেরে পানি উঠিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। সূত্র- Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.